আমেরিকায় ফেয়ার হাউজিং আইন না জানলে বিপদ

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আইন হলো আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা কোন অজুহাত নয় (Ignorance of the Law is NO excuse)। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর আইন সবার জন্য সমান এবং আইন মানা বাধ্যতামূলক। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে এবং সবার জন্য তা সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়। আমরা অনেক সময় নিজেদের মতো করে আইনের ব্যাখ্যা দিই কিংবা নিজেদের স্বার্থে আইনের অপব্যবহার করে থাকি। কিন্তু সত্যিকারে কোন ঝামেলায় পড়লে আইনের কারণে আমাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়, এমনকি বড় ধরনের জেল-জরিমানা ভোগ করতে হয়। এসব থেকে বাঁচার উপায় প্রকৃত আইনটা কি, তা আমাদের সবারই জানা উচিত।

১৯৬৮ সালে সিভিল রাইটস অ্যাক্টের মাধ্যমে ফেয়ার হাউজিং আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের মূল কথা হলো, মানুষের মৌলিক অধিকার বাসস্থান নিয়ে কোন বৈষম্য করা যাবে না এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা, লিঙ্গ, পারিবারিক অবস্থা, জাতিগত উৎস ইত্যাদির কারণে কারও প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। সবার জন্য বাসস্থান ও সবাই বাসস্থানের অধিকার পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করবে। এ আইনের মাধ্যমে মানুষের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের ‘সুরক্ষিত শ্রেণি’ হিসেবে আখ্যায়িত অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

সুরক্ষিত শ্রেণি ফেডারেল সরকার, স্টেট ও সিটি কিংবা স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে এবং নিজস্ব দর্শন অনুযায়ী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে সুরক্ষিত শ্রেণি আখ্যায়িত করেছে।

ফেডারেল সরকার: ফেডারেল সরকারের গৃহীত সুরক্ষিত শ্রেণিগুলো হলো জাতি, বর্ণ, ধর্ম, জাতিগত উৎস, লিঙ্গ, শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা এবং পারিবারিক অবস্থা। ফেডারেল সরকারের সুরক্ষিত শ্রেণিগুলোকে প্রতিটি স্টেটে বিশেষ মর্যাদা দিতে হবে।

নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য: নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে গৃহীত সুরক্ষিত শ্রেণিগুলো হলো—জাতি, বর্ণ, ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতিগত উৎস, লিঙ্গ, বয়স, শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা (মেডিকেল মারিওয়ানা সেবনকারী), বৈবাহিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা, লিঙ্গগত আচরণ, মিলিটারি পরিচিতি, অন্তঃসত্ত্বা, পারিবারিক সহিংসতার শিকার, লিঙ্গগত পরিচিতি ও প্রকাশ, যেকোনো ধরনের বৈধ আয় (সেকশন ৮সহ)।

নিউইয়র্ক নগর: নিউইয়র্ক নগর সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত শ্রেণির অধিকার নিশ্চিত করে। ফেডারেল সরকার ও নিউইয়র্ক স্টেটের গৃহীত সব সুরক্ষিত শ্রেণিগুলোর অধিকার প্রদান করে। সেই সঙ্গে আরও যুক্ত করেছে—লিঙ্গ, লিঙ্গ পরিচিতি ও প্রকাশ, বৈবাহিক ও সঙ্গীযুক্ত অবস্থা, বৈধ কিংবা অবৈধ অবস্থান, নাগরিকত্বের অবস্থা, বৈধ যেকোনো আয় (সেকশনের-৮সহ), বৈধ পেশা, বাচ্চাসহ কিংবা অন্য কারও সঙ্গে বাসস্থান ভাগাভাগি, ভেটেরান স্ট্যাটাসযুক্ত কিংবা মিলিটারিতে কর্মরত, পারিবারিক সহিংসতার শিকার, গুপ্তচর, সেক্স ক্রাইমের শিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নাসাউ কাউন্টি: ফেডারেল ও স্টেট সরকারের সব সুরক্ষিত শ্রেণি সংরক্ষণ করে নাসাউ কাউন্টি এবং যেকোনো বৈধ আয় (সেকশন-৮সহ) ও জাতিগতভাবে বৈষম্য করা যাবে না, তা যুক্ত করা হয়েছে।

সাফ্লোক কাউন্টি: নাসাউ কাউন্টির মত সাফ্লোক কাউন্টিতে ফেডারেল ও স্টেটের সব সুরক্ষিত শ্রেণি সংরক্ষণ করে বলা হয়েছে, বৈধ ও অবৈধ অবস্থান, নাগরিকত্বের অবস্থা, বৈধ আয় (সেকশন-৮সহ) এবং ভেটেরান স্ট্যাটাস বিশেষ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে।

নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের প্রকাশিত ফেয়ার হাউজিং নোটিশে কয়েকটি উদাহরণসহ কীভাবে ফেয়ার হাউজিং আইন অমান্য হবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ফেয়ার হাউজিং আইন নিম্নলিখিত কারণে অমান্য বলে গণ্য হবে এবং তাকে জরিমানা ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে—

১) কোনো সুরক্ষিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবিশেষের কাছে সুরক্ষিত শ্রেণির কারণে কোন বাসা ভাড়া, বিক্রি এমনকি ভাড়া বা বিক্রির জন্য দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করলে। 
২) সুরক্ষিত অবস্থার কারণে ক্রেতা অথবা ভাড়াটিয়ার কাছে বেশি মূল্য দাবি করলে। 
৩) বাচ্চা থাকার কারণে ভাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে কিংবা বেশি বাচ্চার কারণে সিকিউরিটি ডিপোজিট বেশি আদায় করলে। 
৪) সুরক্ষিত শ্রেণির কারণে ভাড়াটিয়া কিংবা ক্রেতাকে কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ভাড়া বা ক্রয় করতে না দিলে। 
৫) সেকশন-৮ কিংবা অন্যান্য যে কোন সরকারি অনুদান বা সাহায্য সংক্রান্ত প্রাপ্ত আয় কারণে ভাড়া প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করলে। 
৬) সার্ভিস ও সাহায্যকারী জীবজন্তু কিংবা মানসিক সাপোর্টকারী জীবজন্তুর কারণে ভাড়া প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করলে। এমনকি জীবজন্তু নিষেধ আছে এমন স্থানেও তাদের অনুমতি দিতে হবে। 
৭) বিক্রেতা কিংবা বাড়ির মালিক তাদের নিজস্ব পছন্দের কারণে কোন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করলে। 
৮) পারিবারিক সহিংসতার শিকার কারও কাছে ভাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে।

এসব বৈষম্যের শিকার হলে নিউইয়র্কের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ৫১৮ ৪৭৪ ৪৪২৯ নম্বরে এবং নিউইয়র্ক স্টেটের হিউম্যান রাইটস ডিভিশনের ৮৪৪ ৮৬২ ৮৭০৩ নম্বরে সরাসরি কল করে অভিযোগ জানাতে পারেন।

ফেয়ার হাউজিং আইন শুধু ভাড়া প্রদান কিংবা বিক্রির ক্ষেত্রে নয়, বরং রিয়েল এস্টেট সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভাড়া ও বিক্রির ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে এমন ভাষা ব্যবহার করতে হবে, যেন এই আইন অমান্য না করা হয়। ধরুন, আপনার অ্যাপার্টমেন্টের কোনো ইউনিট ভাড়া দেবেন, আপনি ফেসবুক মার্কেটপ্লেস কিংবা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনার কাছে কল কিংবা মেসেজ আসবে, আপনি সেকশন-৮ ইনকাম কিংবা ভাউচার গ্রহণ করবেন কিনা? আপনি যদি সরাসরি না বলে দেন, তাহলে এই আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন এবং আপনাকে জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে।

অনেক প্রতারক আছে যারা ভাড়াটিয়া সেজে বিপদে ফেলতে ফোন করে কিংবা মেসেজ দেয় এবং অভিযোগ করে অর্থ আদায় করবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রেও খুব সতর্ক থাকতে হবে। বিজ্ঞাপনে ফেয়ার হাউজিং আইন সংক্রান্ত কোন লঙ্ঘনের কারণে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে শব্দ চয়নে সতর্ক থাকতে হবে এবং কিছু উল্লেখযোগ্য শব্দের ব্যবহার করা যাবে না। যেমন শুধু প্রাপ্তবয়স্ক, শুধু ব্যাচেলর কিংবা কোনো ব্যাচেলর নয়, কোন সন্তান থাকা যাবে না কিংবা ১/২জন সন্তানসহ, শুধু বিবাহিত দম্পতি, শুধু সাবালক ,শুধু বিবাহিত, একজন মাত্র, যেকোনো জাতির উল্লেখ করা, অক্ষম ব্যক্তি নয়, ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করা, জাতিগত পরিচয় উল্লেখ করা, শারীরিক সক্ষমতা, সেকশন-৮ গ্রহণযোগ্য নয়, কোনো চেক কিংবা ভাউচার গ্রহণযোগ্য নয়, পার্টটাইম কাজ গ্রহণযোগ্য নয়, বড় পরিবার যোগ্য নয়, প্রতিবন্ধী ও শিক্ষার্থী গ্রহণযোগ্য নয়, বাড়িওয়ালার কোনো পছন্দ বা বর্ণনা, অন্যান্য সুরক্ষিত শ্রেণির কথা উল্লেখ করা যাবে না।

ফেয়ার হাউজিং আইন মেনে চলুন, আপনি সতর্ক থাকুন এবং অন্যকেও সতর্ক করুন।

লেখক: রিয়েল এস্টেট এজেন্ট