করোনা মোকাবিলায় নিজের কল্পবিজ্ঞান নিয়েই আছেন ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-রয়টার্স
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-রয়টার্স

করোনা মহামারিতে দেড় লাখ মানুষের মৃত্যুর সংবাদ আমেরিকার মানুষকে তাড়া করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো চলছেন উল্টো পথে। কল্পবিজ্ঞান, বিদ্রূপ, ভণ্ডামি আর রাজনৈতিক বিতর্ক উসকে মানুষের মৃত্যুকেই যেন তিনি উপহাস করছেন। আমেরিকায় করোনা সংক্রমণের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের অবস্থান একদিকে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতো অন্য দিকে। শুরু থেকেই ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে একটি রাজনৈতিক ভাইরাস বলেছেন। দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু আমেরিকার মানুষকে বিমর্ষ করছে। এর কোনো ছায়া নেই তাঁর মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকা দ্রুত তাদের কর্মকৌশল পুনর্বিন্যাস করতে না পারলে মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকবে। মৃত্যুর সংখ্যা দুই লাখে যেতে সময় লাগবে না। ডিসেম্বর এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটিই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।

২৯ ফেব্রুয়ারি আমেরিকায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে প্রথম কোনো মানুষের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়। প্রথম ৫৪ দিনের মধ্যেই গত ২৩ এপ্রিল দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ হাজারে পৌঁছায়। এর ৩৪ দিন পর মে মাসে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। মৃত্যুর মিছিলে আরও ৫০ হাজার মানুষের নাম যুক্ত হতে সময় লাগে মাত্র ৬৩ দিন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর পুনর্নির্বাচনের জন্যই অর্থনীতি দ্রুত খুলে দিতে গিয়ে শুরু থেকেই করোনাভাইরাসকে পাত্তা দিচ্ছেন না। কখনো চায়না ভাইরাস বলেছেন, কখনো বলেছেন ভাইরাসটি ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর নয়। বাগাড়ম্বর বক্তৃতা দিয়ে আমেরিকার মানুষের কাছেই হাস্যকর হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞান সভ্যতায় শ্রেষ্ঠ দাবিদার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
ভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই ট্রাম্প এই রোগের চিকিৎসায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের প্রয়োগ নিয়ে উঠে-পড়ে লেগেছেন। আমেরিকার খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এই ওষুধের ব্যবহার করোনা রোগীর জন্য ক্ষতিকর বলে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। অথচ তিনি বলে আসছেন, এই ওষুধ কাজ করে। নিজেও এই ওষুধ সেবন করছেন বলে ঘোষণা দেন। অথচ তাঁর কোনো করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়নি। এমনি এমনি সেবন করছেন। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পরেন না প্রেসিডেন্ট। এমন প্রশ্ন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করলেই চড়াও হচ্ছেন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর।

বিজ্ঞান নয়, কল্পবিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনাভাইরাসে যখন নিউইয়র্কে দিনে ৮০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল, তখন তিনি বলেছেন ডিটারজেন্ট দিয়ে ফুসফুস পরিষ্কার করার কথা। এ নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ হাসাহাসি করলেও তাঁর কিছু এসে যায় না। আমেরিকার সংবিধান প্রেসিডেন্ট পদকে এমন ক্ষমতাই দিয়েছে। যেখানে প্রেসিডেন্ট পাগল হয়ে গেছেন কি না, তা পরীক্ষার জন্য আইন প্রণেতাদের উদ্যোগ প্রেসিডেন্ট নিজেই বাতিল করে দিতে পারেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একা নন, মুক্ত বিশ্বের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত এই দেশে তাঁর সমর্থক ও একই চিন্তার মানুষেরও অভাব নেই। স্টেলা ইমানুয়েল নামের টেক্সাসের একজন চিকিৎসক একটি গির্জা পরিচালনা করেন। স্বপ্নে গর্ভধারণ সম্ভব বলে তিনি বলছেন। এ চিকিৎসক বলছেন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের মতো সাধারণ ওষুধ করোনার জন্য যথেষ্ট। কোনো মাস্ক পরারই দরকার নেই।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সংক্রামক বিশেষজ্ঞ ডা. ফাউসি নয়, এই চিকিৎসক স্টেলার বক্তব্য যুক্ত করে টুইট করে বলছেন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন করোনায় ভালো কাজ করবে। এ নিয়ে গত বুধবার (২৯ জুলাই) হোয়াইট হাউসে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি ইতিউতি করতে থাকেন। বলেন, তিনি শুনেছেন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কাজ করে। তিনি স্বীকার করেন, ডাক্তার স্টেলাকে তিনি জানেনও না। তিনি কোন দেশের চিকিৎসক, তাও তাঁর ধারণা নেই।

সিএনএনের সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুললে ট্রাম্প তড়িঘড়ি সংবাদ সম্মেলন ত্যাগ করেন। তিনি বলেন, তিনি ডাক্তার স্টেলার বক্তব্যে খুবই অনুপ্রাণিত। তিনি মনে করেন, তাঁর বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার অধিকার রাখে। অবশ্যই তাঁ বক্তব্য শোনা উচিত।

এসব কথা বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার স্বাস্থ্যসেবীদের সতর্কবাণী এখনো অবজ্ঞা করছেন। ডা. ফাউসি বারবার বলছেন, করোনা মোকাবিলা ও প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণাকে প্রাধান্য দিয়েই এগোতে হবে। ট্রাম্প মাস্ক পরা নিয়ে আগে উপহাস করেছেন। এখন যদিও সবাইকে মাস্ক পরতে বলেছেন। তিনি নিজে মাস্ক পরার ছবিও প্রকাশ করেছেন। তাঁর এসব বক্তব্য অনেকটা উপহাসের মতোই শোনায়। মঞ্চে দেওয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্য মানুষ বিনোদন হিসেবেই নিচ্ছে।

করোনাভাইরাস নিয়ে ট্রাম্পের কথা আমেরিকার মানুষ বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে ডা. ফাউসির কথা। ট্রাম্প প্রশ্ন রেখেছেন, ডা. ফাউসি তাঁর প্রশাসনে কাজ করে এত জনপ্রিয়, অথচ লোকজন তাঁকে কেন পছন্দ করছে না?

হার্ভার্ড গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আশিস ঝা বলেন, ‘এই ভাইরাসকে সামাল দিতে সব হাত কাজে লাগাইনি, এটা খুব হতাশাজনক। এখন উপায় বের করতে হবে, কী করে পরের দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু রোধ করা যায়। আমি মনে করি, আমাদের পক্ষে এটা সম্ভব।’

জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি সেন্টারের বিশেষজ্ঞদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকাকে করোনা প্রতিরোধে নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে। ফেডারেল, রাজ্য ও স্থানীয় পর্যায়ে নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আমেরিকায় এখন গড়ে প্রতিদিন সাড়ে সাত লাখ মানুষের করোনা টেস্ট করানো হচ্ছে। মাইক্রোসফট প্রধান বিল গেট বলেছেন, এসব টেস্টের ফলাফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে। ফলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এত বেশি টেস্টও খুব কাজে লাগছে না। অথচ ট্রাম্প বাগাড়ম্বর করেই বলে আসছেন, আমেরিকায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লোকের টেস্ট করা হচ্ছে।

অধিকাংশ মানুষের মধ্যে কোনো উপসর্গ ছাড়াই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাওয়া সমন্বিত হিসেবে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে বর্তমানে ৫৭ হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ৩২টি অঙ্গরাজ্যে জনসমাগম এলাকায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদিও দেশজুড়ে তা বাধ্যতামূলক করার আদেশ দিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অস্বীকার করেছেন।

নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও কানেকটিকাটের মতো রাজ্যে সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য নির্দেশনাবলি মেনে চলার কারণে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমেরিকার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের অবস্থা নাজুক হচ্ছে দিন দিন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভাবছেন বাগাড়ম্বর দিয়ে পরিস্থিতি থেকে উতরে যাবেন। এসব করে রাজনীতি করা গেলেও জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা যায় না, কথাটা আমেরিকার মানুষ জীবন দিয়ে টের পাচ্ছে। আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় আমেরিকার মানুষ দেখছে ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সময়ে দেশের প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ড। এ নিয়ে বাইরের বিশ্বে উপহাস হচ্ছে।