করোনা ঠেকাতে নতুন স্বাভাবিকতা

বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব মেনে বসাবাস করতে হবে
বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব মেনে বসাবাস করতে হবে

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
করোনাকালীন মহামারিতে বদলে যাওয়া পৃথিবীর নতুন এক অন্যরকম জীবনে আমরা ক্রমশই অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি! করোনার সঙ্গে বসবাসের সময় যেন দীর্ঘতর হয়ে উঠছে। এর সংক্রমণের গ্রাফটির গতি দেশে দেশে ওঠানামার মধ্যই রয়েছে। এই আততায়ীর বিস্তাররোধ করা এখনো সম্ভব হয়নি। আমার নিজের দেশে কোভিড সংক্রমণের ঊর্ধ্বহার জীবন ও জীবিকাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে প্রতিনিয়ত। লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘুরে বেড়ানো দানব কোভিড–১৯ বধ করার সেই অব্যর্থ প্রতিষেধক টীকা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। আপ্রাণ চেষ্টা চলছে ও বাস্তবতা হলো, প্রতিষেধক টীকা না আসা পর্যন্ত আমাদেরকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। বিনা যুদ্ধে দেব না সূচ্যগ্র মেদিনী!
বিজ্ঞান আমাদের সারথি এই যুদ্ধকালীন জীবনযাত্রায়। মহামারি বা রোগবিস্তার বিজ্ঞানের (এপিডেমিওলজির) ভাষায় প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত, এই সময়ে রোগটির যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করাই একমাত্র উপায়। কিন্তু এখনো রোগটি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। নিয়ন্ত্রণহীনের কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইতিহাসের সেই দিনগুলোর পুনরাবৃত্তির ছায়া। ১০০ বছর পরে আবার যা ঘুরে এসেছে পৃথিবীতে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ঘরে ফেরত সৈনিকদের একটি বিরাট অংশ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন স্প্যানিশ ফ্লুর দুর্যোগ! ইতিহাসের সেই মহামারি অতি দ্রুত দক্ষিণ প্যাসিফিক মহাসাগর থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ৫ কোটি মানুষ এই মহামারিতে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় এক পঞ্চমাংশের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে এসে কোভিড–১৯ ভাইরাস প্রায় একই রকম ভয়ংকর রূপ ও প্রতাপ নিয়ে পুরো বিশ্বকে আক্রান্ত করে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাবলিক পলিসি বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ডা. জর্জ সেরেনটলি সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, ১০০ বছর আগের স্প্যানিশ ফ্লু এবং বর্তমান কোভিড–১৯, দুই ক্ষেত্রে কঠিন সত্যিটা হলো—মহামারিকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অক্ষমতা।
যদিও পৃথিবী এগিয়ে গেছে অনেক দূর। বিজ্ঞান, চিকিৎসা, অর্থনীতি, ব্যবসা–বাণিজ্য, সমাজ, বিলাস–বাসন আর ডিজিটাল যুগের এক অপ্রতিরোধ্য সাফল্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে একুশ শতকের মানুষ। তবে বাস্তবতা হলো, সেদিন যে সব কারণে স্প্যানিশ ফ্লুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি; যেমন: টীকা না থাকা, জনস্বাস্থ্যের সীমাবদ্ধতা, জনগণের মধ্য সচেতনতার অভাব, ওষুধ ও চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা, একটি বলিষ্ঠ ও স্বচ্ছ যোগাযোগের অভাব যার মাধ্যমে পুরো মহামারিকে নজরদারির আওতায় আনা যায় বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্তের মাধ্যমে। নিয়ন্ত্রণহীনতার এসব কারণ ইতিহাসের সিন্দাবাদের ভূত হয়ে যেন ১০০ বছর পরে কোভিড=–৯ মহামারিতে ফিরে এসেছে।
প্রতিকার থেকে প্রতিরোধ উত্তম
জনস্বাস্থ্যের এই জনপ্রিয় স্লোগানটি বইয়ের পাতায় যতখানি মহিমায় বিরাজমান বাস্তবে এর প্রয়োগের সীমাবদ্ধতার কারণে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। একটি কার্যকরী প্রতিষেধক টিকার অনুপস্থিতিতে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, স্বাস্থ্যের শিক্ষা ও সচেতনতাকে অব্যর্থ সামাজিক প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করার উপযোগিতা; বিজ্ঞান ১০০ বছর আগেই প্রমাণ করেছে। কিন্তু ২০২০ সালে এসেও আমরা জনস্বাস্থ্যকে অবহেলা করেছি। তাই আজকে কোভিড সংক্রমণে নিয়ন্ত্রণ এত দুরূহ হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল অনেক দেশেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির চিকিৎসা সেবা যেমন ডাক্তার ও রোগী, রোগী ও হাসপাতাল বেডের অনুপাত বা আইসিইউ সেবার অপ্রতুলতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের তো তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিরোধই একমাত্র উপায় বিবেচ্য ছিল। যার মাধ্যমে কোভিড–১৯ এর সংক্রমণ চেইনকে বিচ্ছিন্নকরণ সহজ হতো। মহামারির শত্রু ভাইরাস কোভিডের আচার–আচরণ, চলাচলের গতিবিধি, এর জীবন চক্র এবং এই অদৃশ্য দানবের মাধ্যমে যারা আক্রান্ত তাদেরকে কঠিন নজরদারির মধ্য রেখে, আক্রান্তদের দ্রুততর সময়ে শনাক্ত করে কোভিড–১৯ এর সংক্রমণ চেইনটি বিচ্ছিন্ন করাই মহামারি প্রতিরোধের প্রধান বিষয়।

সার্ভেল্যান্স সিস্টেম
করোনা ও মানুষের মধ্য সংক্রমণ চেইনটি শনাক্ত ও বিচ্ছিন্ন করার কার্যকরী পদক্ষেপ হলো একটি সার্ভেল্যান্স সিস্টেম তৈরি করা। রোগ বিস্তার বিজ্ঞানে যাকে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সার্ভেল্যান্স দলের মূল লক্ষ্য রোগী বা কেস শনাক্তকরণ! সেই সঙ্গে প্রতিটি রোগীর ইতিহাস জানা যেমন তার বয়স, পুরুষ না নারী—দীর্ঘ মেয়াদি অসুস্থতার উপস্থিতি, এলাকাভিত্তিক অবস্থান। এর মাধ্যমে সহজেই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা যাবে। একটি চৌকস দল যারা কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে উপসর্গসহ অথবা উপসর্গবিহীন এই রোগীদের অনুসন্ধান ও অনুসরণের মাধ্যমে নজরদারির আওতায় এনে তাদের প্রয়োজনে আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিন করবে! এই দুইটি সামাজিক প্রতিষেধক ব্যবস্থা কোভিডকে জয় করার অন্যতম হাতিয়ার!! যেহেতু এই মহামারির অধিকাংশ রোগীই থাকেন উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গ নিয়ে, তাই এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রচুর পরীক্ষা ও পরীক্ষাকে সহজলভ্য করার মাধ্যমে ভাইরাসকে আটকে ফেলা সহজতর হবে। যে দেশ যত বেশি টেস্ট করেছে, তারা তত মহামারি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখেছে।
সার্ভেল্যান্স সিস্টেমের মূল লক্ষ্য হলো অনুসন্ধান, অনুসরণ, শনাক্তকরণ! প্রতিটি পদক্ষেপের জন্যই টেস্টের প্রয়োজন ও গুরুত্ব অপরিসীম। এটাই কোভিড সংক্রমণ চেইনকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম। কমিউনিটি পর্যায় থেকে এই গোয়েন্দা কার্যাবলির মাধ্যমে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত নিয়ে যে রিপোর্ট তৈরি হবে, তার আলোকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা রাষ্ট্র এই মহামারি হতে রক্ষা পাওয়ার রণকৌশল ঠিক করবে! সার্ভেল্যান্স সিস্টেমের ফর্মুলা প্রত্যেক দেশের জন্য ভিন্ন। নিজস্ব সংস্কৃতি, পরিবেশ, অর্থনীতি ও অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে একে তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোরিয়ার উদাহরণ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তারা ডিজিটাল সার্ভেল্যান্স সিস্টেমের আওতায় কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে রোগী শনাক্ত ও টেস্টকে প্রাধান্য দিয়ে করোনা মোকাবিলায় সফল হচ্ছ!

নতুন স্বাভাবিকতা-কোভিডের বিরুদ্ধে রক্ষাবুহ্য
দীর্ঘ তুষার ঝরা দিনের শেষে কানাডার প্রকৃতিতে এখন বসন্তের রঙিন সজীবতা। এ সময়ে এ দেশের লোকজন ঘরের বাইরের খোলা হাওয়ায় তাদের দিনগুলো উৎসবে পরিণত করে। কিন্তু করোনায় অন্যরকম পৃথিবীতে জীবন যেন একটি নতুন অধ্যায়ের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নেমেছে। কোভিড মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে লকডাউন একটি কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সেই সময় কোভিড–১৯ ঠেকাতে অবরুদ্ধ লোকালয় লাগসই সামাজিক প্রতিষেধক হিসাবে পুরো বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু জীবন–জীবিকা যখন হুমকির মুখে তখন একাধারে সংক্রমণকে কমাতে হবে ও অর্থনীতির চাকাকে ধাপে ধাপে চালু করতে হবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের নতুন স্বাভাবিকতার অন্যরকম জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। বিজ্ঞানকে সাথি করে এই নতুন জীবনধারার অনুশাসন মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমেই কোভিড থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।
পুরোনো পৃথিবীর কোলাহলপূর্ণ জীবনে ফেরত যাওয়ার সুযোগ এই মুহূর্ত অন্তত নাই। বন্ধু–বান্ধব, আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত পুরোনো পৃথিবীর মিলনমেলাকে ফটোফ্রেমের স্মৃতির পাতায় রেখে আমাদের নিজস্ব একলা জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। তবে প্রতিবেশী ও বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে মানসিক নৈকট্য বাড়াতে হবে। উৎসব– পার্বণ পারিবারিক পরিসরে সীমিতভাবে উদ্‌যাপন করতে হবে। ছয় ফুটের সামাজিক দূরত্বকে মানতে হবে রাস্তাঘাট, অফিস আদালত, পার্ক, বাজার–হাটে! তৃতীয় এই বিশ্ব যুদ্ধের সৈনিক এখন আমরা প্রত্যেকে। সচেতনতা আর বদলে যাওয়া জীবনে বিজ্ঞানসম্মত জীবনযাপন আমাদের এই যুদ্ধের অন্যতম যুদ্ধাস্ত্র! মাস্ক ব্যবহারকে জীবনের অন্যতম সঙ্গী করতে হবে।
কানাডা লকডাউন খোলার দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। এই সময়ে কানাডার বিভিন্ন শহরে সব পাবলিক প্লেস মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাসে, সাবওয়ে ট্রেনে, দোকানে, অফিসে, আবদ্ধ জায়গায়, লোক সমাগম এলাকা যেখানে শারীরিক দূরত্ব মানা কঠিন, সে সব জায়গায় মাস্ক ব্যবহারে আইন করা হয়েছে। এর মধ্য মাস্ক ব্যবহারে অনিচ্ছুক লোকজনকে বিশাল জরিমানাও গুনতে হচ্ছে। তবে আইন তো শেষ কথা নয়।
সচেতনতা বাড়াতে টরন্টো শহরের মেয়র জন টোরি সাবওয়ে স্টেশনে লোকজনের মধ্যে দিনভর মাস্ক বিলিয়েছেন। হাত ধোয়া আরেকটি প্রযুক্তি, যা এখন করোনাবধের অন্যতম প্রতিষেধক। ২০ সেকেন্ড করে দিনে বেশ কয়েকবার করে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। বদলে যাওয়া জীবন ধারাকে মনেপ্রাণে ধারণ করা খুব সহজ নয়। এই নতুন অভ্যাসে নিজেদের অভ্যস্ত করতে মানসিক শক্তির ওপর জোর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যের সেই অমোঘ সংজ্ঞাটি—সুস্থতা মানে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকের একত্রিত সহাবস্থান। কোন একটির অপূর্ণতায় পুরো সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। কোভিড–১৯–এর এই যুদ্ধে স্বাস্থ্যের এই সংজ্ঞাটি নতুন করে আমাদের নিজেদের জীবনে প্রতিনিয়ত বাস্তবায়ন করতে হবে। যুদ্ধটা দলগতভাবে করতে হবে। সব রকমের বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। নতুন স্বাভাবিকতায় বিজ্ঞানসম্মত জীবনধারা নিয়ে এখন আমাদের অপেক্ষা করোনামুক্ত একটি পৃথিবীর! অপেক্ষা সেই আরাধ্য প্রতিষেধক টীকার জন্য! তত দিন পর্যন্ত জীবনের গল্পটা হোক সামাজিক দূরত্ব মেনে ও একতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার, পারস্পরিক নৈকট্যের!!

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, কমিউনিটি মেডিসিন
টরন্টো, কানাডা