জীবন নিয়ে খেলা

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ঢাকা মহানগরের কোলাহল থেমে গেছে; বন্ধ হয়ে গেছে ফার্মগেটের প্রায় সব দোকানপাট। খোলা আছে শুধু ‘হোটেল নিউ স্টার এন্ড কাবাব’; তার ভেতরে ঝলমলে সাদা আলোয় কয়েকটা টেবিলে খাওয়াদাওয়া চলছে। কয়েক গজ দূরে, আনন্দ সিনেমা হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে নবীন বটগাছের গায়ের সঙ্গে হলুদ ব্যানারে বড় বড় লাল হরফে লেখা, ‘বিশেষ বিজ্ঞপ্তি: সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ময়লা ফেলা নিষেধ। আদেশক্রমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।’
রাত সাড়ে ১২টায় ওখানে জমে উঠেছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। বড় সড়কটার দুই পাশের মোট ১০টা হোটেল-রেস্টুরেন্টের সব উচ্ছিষ্ট খাবার ও অন্যান্য বর্জ্য জমা করা হয়েছে ওখানে।
পাতাবহুল শাখা-প্রশাখাময় বটগাছটির তলায় যে আলো-আঁধারি সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে, আবর্জনার স্তূপে চিকা ও মাছিদের সঙ্গে একজন মানুষ দেখতে পাই। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই; তীব্র দুর্গন্ধ ধাক্কা মারে নাকে। সে সামনের দিকে ঝুঁকে আবর্জনা ঘাঁটছিল; আমি ‘এই যে, শোনেন’ বলে ডাক দিলে দুই হাঁটুতে দুহাতে ঠেস দিয়ে কোমর সোজা করে দাঁড়ায়। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় আমার মুখের দিকে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বলি, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। মাত্র ১০ মিনিট।’ সে লাজুক হেসে মাথা নেড়ে সায় দেয়। গল্প শুরু হয়।
ওর নাম মোহাম্মদ পান্না হোসেন। জন্মেছিল ২৬ বছর আগে, যশোর শহরে এক মাছবিক্রেতার ঘরে। বড় দুই ভাই আর একটা বোন আছে ওর। বাবা এখন আর নেই, মা আছেন। ১৪ বছর ধরে মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে ওর কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁরা জানেন না, তাঁদের সবচেয়ে আদরের পান্না এখন ঢাকার কারওয়ান বাজারে আলুর আড়তে কুকুর-বিড়ালের মতো ঘুমায়; প্রতিটি রাতে ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ফার্মগেটের হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর বর্জ্য পরিষ্কার করে রাতের খাবারটুকু আর ১০০টি টাকা পায়।

‘ভালো ছাত্র ছিলাম। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমার ব্রেনই ছিল সবচেয়ে ভালো।’ পান্না আমাকে বলে, ‘কিন্তু খুব চঞ্চল ছিলাম। স্কুল ভালো লাগত না। খালি ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা হতো। একবার মেজো ভাই ট্রেনে করে যশোর থেকে খুলনা বেড়াতে নিয়ে গেল। খুলনায় নদী দেখে আমার খুব ভালো লাগল। তারপর যশোর ফিরে গিয়ে কিছুদিন পরে কজন বন্ধুর সাথে ট্রেনে চড়ে আবার খুলনা চলে গেলাম। বাড়িতে কাউকে কিছু বলি নাই।’ স্পষ্ট উচ্চারণে বেশ গুছিয়ে কথা বলে পান্না।

নদী দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। নদীর টানে মাত্র আট বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল সে। কিন্তু নদীর হাওয়া খেয়ে তো পেট ভরে না। কী করা যায়? বন্ধুদের সঙ্গে সে গেল খুলনার বাস টার্মিনালে; গিয়ে দেখতে পেল ওর বয়সী ছেলেরা সেখানে বাস ধোয়ামোছা করে, ড্রাইভার-হেলপারদের ফুটফরমাশ খাটে। বিনিময়ে টাকাপয়সা পায়, রাতে ঘুমানোর জায়গা মেলে; দরদি কেউ কেউ খাবারের ভাগও দেয়। খুলনা বাস টার্মিনালের বাসিন্দা হয়ে গেল আট বছরের পান্না।

‘একবার মেজো ভাই আইসে ধরে নিয়ে গেল বাড়িতে। ধরে-বেঁধে নিয়ে গেল ইশকুলে। কিন্তু আমার মন বসে না। আবার পালায়ে খুলনা চলে গেলাম। এইবার একলাই,’ পান্না বলে চলে; তার চোখেমুখে ফেলে আসা মধুর দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থনের পুলক। ‘ঢাকা থেকে বাস খুলনা পৌঁছালে সব যাত্রী যখন নেমে যেত, আমরা বাসের ভিতরটা পরিষ্কার করার জন্য ঢুকে টাকাপয়সা কুড়ায়ে পেতাম। ভাগ্য ভালো হলে ১০০ টাকার নোটও পাওয়া যেত।’

তার চার বছর পর একদিন খুলনায় রূপসা নদীতে এক রকেট স্টিমারে চেপে বসে পান্না ও তার বন্ধুরা। তখন ওর বয়স ১২। সেই স্টিমার ওদের নিয়ে এল ঢাকার সদরঘাটে। সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে ওরা চলে এল কারওয়ান বাজারে।

‘এরশাদ বিল্ডিং তখন ফাঁকা। আমরা ওইখানে উঠলাম। টাকাপয়সা ফুরায়ে গেলে শুরু করলাম মিন্তিগিরি। তারপর রাতের বেলা সবজির ট্রাক আসলে ট্রাক থেকে মাল খালাসের কাজ। তখন বড় হয়ে গেছি।’

‘আপনি ঢাকা চলে আসার পরে বাড়ি থেকে কেউ আপনাকে খুঁজতে আসেনি?’

‘আসছিল। পায় নাই। অনেক বছর পরে...আজ থেকে আড়াই বছর আগে আমি নিজেই বাড়ি গেছিলাম। তখন সব শুনছি। ভাইয়েরা আমার অনেক খোঁজ করছে।’

‘বাড়ি গিয়ে আবার ফিরে এসেছেন কেন?’

‘ভালো লাগে নাই। মন বসে নাই। ভাই কাজ জোগাড় করে দিছিল। একটা কোম্পানির মাল দোকানে দোকানে সাপ্লাই দেওয়া। বেতন মাত্র পাঁচ হাজার। ভাল্লাগে নাই। আবার চলে আসছি।’

তারপর সে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ পেয়েছিল। বেতন পেত সাত হাজার টাকা। তারপর একদিন, এখন থেকে মাস পাঁচেক আগে, তেজগাঁও রেলক্রসিংয়ে চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে, ‘পিরাই মরে গেলাম। দুই দিন হুঁশ ছিল না।’ আঘাতটা কোথায় লেগেছিল, কীভাবে লেগেছিল, কিছুই সে বলতে পারে না। হুঁশ ফেরার পর দেখতে পায়, চোয়াল বাঁকা হয়ে গেছে, কথা বলতে পারছে না, উঠে দাঁড়ানোর সাধ্য নেই। ‘সূর্য ক্লিনিক’-এর এক ডাক্তার তাঁর চিকিৎসা করেন, শুশ্রূষা করেন, ওষুধ দেন। দুই মাস পর পান্না উঠে দাঁড়ায়।

সিটি করপোরেশনের কাজটা আর ফিরে পায় না। শুরু করে এই কাজ, ফার্মগেটে এখন যা করছে।

‘আপনার বাড়িতে জানে যে আপনি অ্যাকসিডেন্ট করেছেন?’

‘না। কেউ জানে না।’

‘আপনার মায়ের কথা মনে পড়ে না?’

‘আম্মা আমাকে খোঁজার জন্য আসছিল, পায় নাই।’

‘আপনি এ রকম কেন হয়েছেন?’

পান্না মাথা নিচু করে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটি খোঁড়ে। বিড়বিড় করে বলে, ‘এখন বসে বসে চিন্তা করি, জীবনটারে নিয়ে আমি কী করলাম!’

‘বাড়ি চলে যান না কেন?’

‘যাব। আব্বা কবে মারা গেছে জানতে পারি নাই। আম্মা মারা যাওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে যাব। আর আসব না।’

‘এখনো যাননি কেন? কাল সকালেই চলে যান না কেন?’

‘যাব। কিন্তু তার আগে পুরাপুরি সুস্থ হওয়া দরকার।’

‘কিন্তু আপনার শরীরে জখম। হাতে গ্লাভস নাই, মুখে মাস্ক পরেননি। এইভাবে ময়লা-আবর্জনা ঘাঁটাঘাঁটির কাজ করতে থাকলে পুরাপুরি সুস্থ হবেন কীভাবে? বরং ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। চলে যান, বাড়ি চলে যান।’

পান্না আমাকে এড়িয়ে যেতে চায়; জিজ্ঞাসা করে, কটা বাজে। আমি আমার মোবাইল ফোনে দেখি ১টা বেজে ৫ মিনিট। শুনে সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে: ‘এখন যাই, কাজ করি।’ বলতে বলতে চলে যায় আবর্জনার স্তূপের দিকে; আমাকে সুযোগ দেয় না তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর। আমার কেন জানি মনে হয়, এই ছেলে হয়তো আর কোনো দিনই ঘরে ফিরে যাবে না। সে পৃথিবীতে এসেছে নিজের জীবন নিয়ে খেলা করতে। জীবন তার কাছে অ্যাডভেঞ্চার।

তবু ফিরে আসার আগে চিৎকার করে তাকে বলি, ‘পান্না, বাড়ি চলে যান।’

মশিউল আলম: সাংবাদিক  সাহিত্যিক