অবশেষে কোরবানি
ফোনের রিং বাজতেই আম্মা ফোন ধরলেন। অপর প্রান্ত থেকে শিশু মিয়ার অস্থির গলা
-খালাম্মা বড় বাই কি গরু কিনতে পারছে?
-না, এখনো পারে নাই। বাজারে গরু শেষ।
-বড়ভাইয়ের কন ফেরত আসতে। আমি গাবতলীর বাজারে। গরু আসতেছে। টেরাকের মধ্যে। এখন আছে গাজীপুরে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কোরবানি হবে কী হবে না—প্রথমত এটা ছিল একটা বিষয়। কোরবানি মানে ত্যাগ! এখন গোশত খাওয়া ত্যাগ না করার জন্য অনেক যুক্তি উঠে এসেছে। তার প্রথমটাই হচ্ছে আল্লাহর নামে কোরবানি। তবে আম্মার অনুভূতির জায়গাটা অন্য রকম। গরু এখনো ট্রাকে আছে—এই সংবাদে শিশু মিয়া বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। তাঁর পরিচিত কেউ সংবাদ দিতেছে। সেটার আপডেট সে একটু পরপর দিচ্ছে। আম্মা একের পর এক ফোন রিসিভ করে যাচ্ছেন। আবার নিজেও কল করে যাচ্ছেন। তিনি শোয়াইবকে কল দিলেন—
-চাচি আম্মা গরু আছে। একটু বেশি দাম । কিনে ফেলব নাকি?
-কত বেশি?
-লাখের ওপর চলে যায় চাচি আম্মা। আমি দুটো কিনেছি কিন্তু বাজেট ফেল।
-আমার তো বাজেট ফেল করলে হবে না রে বাবা। তা তোমাদের গরু কত করে নিছে?
-একটা এক লাখ দশ হাজার। আরেকটা তেরো হাজার।
-আমার জন্য অনেক বেশি আব্বু। আমি দেখি হাসান কী করে।
-আচ্ছা, নাকি চার-পাঁচটা খাসি কিনে ফেলব চাচি?
-খাসি কিনবা? আচ্ছা দেখি তোমার চাচা কী বলেন? আমি কথা বলে কল দিতেছি। এর আগে কিনো না।
-আচ্ছা চাচি আম্মা।
খাসির জন্য তিনি নিজেই রাজি না। তবু সরাসরি কিছু বলতে পারলেন না। গরু নিয়ে আম্মা খুব পেরেশান। তাঁর সবকিছু প্রস্তুত। মসলা, কাটা-বাটা থেকে শুরু করে সব। আম্মা কোরবানি দেবেন। সিদ্ধান্ত পাকা। তাঁর একটাই কথা বাজার থেকে যদি শাক-সবজি, পেঁয়াজ সব কেনা যায়, তবে গরু কিনতে সমস্যা কী? কোনো সমস্যা হবে না। এই পরিস্থিতিতে অন্য বাজার করা গেলে গরুও করা যাবে। তা ছাড়া আগামী বছর বাঁচলে তো কোরবানি দেবেন। যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে! এসব কাজ সামাল দেওয়ার জন্য তাঁর লিস্ট করা লোক আছে। তাঁকে শুধু তদারকি করলেই হয়। ব্যস। সেই সঙ্গে গরুর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভাগ বাঁটোয়ারাও হয়ে গেছে। কে মাথা নেবে? কে ভুঁড়ি নেবে? চামড়া কে পাবে? কিন্তু গরুর তো দেখা নেই। আম্মা মনে মনে আহত। দোয়া-দরুদ পড়ছেন, যাতে সব সহি-সালামতে হয়। বড় ছেলে হাসানের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। তবু এই পরিস্থিতি গরুর বাজারে ঘুরছে। অনেক কষ্টে ছোট ছেলে আদিব টিকিট পেয়েছে প্লেনের। ঈদের তিন দিন পর জার্মানি থেকে আসবে। অনেক ভাবনা এসে মাথায় ঘুরপাক খায়।
কোরবানির এক সপ্তাহ আগে প্রথমেই তাঁকে ফোন দিয়েছে তাঁর প্রথম হেল্পিং হ্যান্ড শিশু মিয়া।
-খালাম্মা আপনি কী কোরবানি দেবেন ঢাকায় এইবার?
-হ দিমু, কেন?
-না খালাম্মা, আমনে বললে আঁই কাডাকুডি করণের লাই আরও ২/৩ জনরে সঙ্গে লই চলি আইতাম।
-তারা কী পেশাদার কসাই?
-হ, হেতেরা মাংস কাডাকুডির কাম করে।
-শিশু মিয়া, তাঁদের কত করে দিতে হবে।
-খালাম্মা এই ধরেন হাজারে ১৫০ টিয়া (টাকা) দিলে হবে।
-আচ্ছা শোনো, তুমি একলা আসো। তিনজন লাগবে না। আমার লোক আছে।
আম্মা পাকাপোক্ত মানুষ। সব বিষয়ে অগাধ চিন্তাভাবনা রাখেন। আসলে ঢাকা শহরে করোনার জন্য অনেক বেশি দাম নিচ্ছে পেশাজীবী কসাইরা। হাজারে ২৫০ টাকা করে। তাঁর বাজেট ৭০ হাজার টাকা। শিশু মিয়া নেবে ১৫০ করে। মন্দ না । তা ছাড়া পুরোনো লোক। এখন কথা হলো গরু কেনা হলে তো বাকি সব চিন্তা। রাত প্রায় ১২টা বেজে গেছে।
আম্মা গিয়ে বাবাকে খাসি কেনার সংবাদ দিলেন? না, এত খাসি কি খাওয়া যায়? বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, তুমি শোয়াইবকে না করে দাও। হাসান যা পারে ব্যবস্থা করবে। ওর গরু কেনা শেষ। ও আমাদের জন্য বাজারে চক্কর দিচ্ছে।
খুব আশ্চর্য বিষয়। এই কত দিন গরু বিক্রি হয়নি। আর এখন গরু পাওয়া যাচ্ছে না। দেরি করে কেনার চিন্তাভাবনা শোয়াইবের। কিন্তু হঠাৎ করে ঢাকা শহরে গরু ঈদের আগের দিন কমেও গেল, দামও বেড়ে গেল। ডিমান্ড কমোডটি বলে একটা কথা আছে। ব্যবসায়ীরা ষোলো আনা উশুল করছে। ঢাকা শহরে বাড়ির মালিকেরা না করে দিয়েছিল। বাড়ির আশপাশে কোরবানি দেওয়া যাবে না। মানুষ দ্বিধায় ছিল। আম্মার এমন সমস্যা নেই। নিজেদের বাড়ি। কিন্তু শোয়াইব বলেছে গরু কিনে দেবে। তাই নিশ্চিন্তে বসেছিলেন। এখন বেচারা নিজে পড়েছে বিপদে। ওদের অবশ্য টাকার কমতি নেই। সে সানন্দে বাজেট বাড়াতে পারে। তাঁর চাচি আম্মার জন্য খারাপ লাগছে।
আম্মার পুরোনো গাড়ির চালক রুবেল। সেও আগে থেকে তৈরি। তবে সে টাকা পয়সা চায় না। তাঁকে মাংস দিলেই হলো। রুবেলও ফোন দিচ্ছে। হাসান আর শিশু মিয়া এখন এক সঙ্গে গাবতলীর হাটে গরুর জন্য ঘুরছে। আশপাশে গরুর দালালেরা জুয়াড়িদের মতো জেতার চিন্তায় মগ্ন। একটু একটু করে দামের পাল্লা ভারী রেখে সবাই বসে আছে। বেশি দাম পাওয়া যায় কিনা? এই করে করে রাত প্রায় শেষ হয় হয়। হাসান তখন ৬৩ হাজারে একটা সুন্দর ষাঁড় কিনতে পেরেছে। এই খবর শুনে ফজরের নামাজ শেষ করে আম্মা ঘুমাতে গেলেন। তবে কাজ আরও বাকি। আম্মা ফোন দিলেন রুবেলকে। সে বলল, নামাজ পড়ে আসবে। আম্মা তাঁকে বলে দিলেন, আগে আসতে। সে যেন গরু গোসল করায়।
আম্মার ছোটা বুয়া রহিমা, করোনাকালে মার্চে বাচ্চার মা হয়েছে। সব মিলিয়ে সে কাজে আসে না। কিন্তু ফোন দিয়ে বলে
-খালাম্মা সালাম! কুরফানি দিবাইন খালাম্মা।
-হ, দিমু।
-খালাম্মা, বুড়িডা কী করবেন?
-তা তো জানি না।
-আমার লাই রাইখেন। আমি ছাফছুতরা কইরা আধখান আমনেরে দিমু।
-আচ্ছা। আমার লাগবে না। তুমি নিয়ে যাইও।
-কেন লাগব না? আমনের খুব খায়েশ। মনে আছে আমারে দিয়া একবার কিন্না আনাইছিলেন?
-আচ্ছা, রহিমা ঠিক আছে।
-আমার বাচ্চারে লইয়া আমু খালাম্মা।
গরু জবাইয়ের আগে আগে শিশু মিয়া ভুঁড়ি চায়
—খালাম্মা ভুঁড়ি কি খান?
-খাই। তবে ভুঁড়ি রহিমা নিব। রেখে দিয়ো ব্যাগে ভরে। ও পরিষ্কার করব।
-কী কন খালাম্মা? হেরে না করে দেন।
-না, শিশু মিয়া। তারে না করা যাবে না। ঠিক আছে, তুমি অর্ধেক নিয়ে যাইও।
গরু জবাই হওয়ার পরপর শিশু মিয়া ভুঁড়ি পরিষ্কার করে ব্যাগে ভরে রেখেছে। রহিমা এসেছে দিন শেষে বিকেলে। ভুঁড়ি অল্প দেখে তার মন খারাপ। তবু খুশি থাকছে। রাতে ফোন দিয়ে বলল,
-খালাম্মা শিশু মিয়া সব বালাডা নিয়ে গেছে। সাত ঘরটা (এটা সম্ভবত আঁত ভড়) আমারে দেয় নাই। হেইডা খাইতে না টেস্ট বেশি।
এ রকম আরও অনেক জিনিসের কমতি রহিমার ভুঁড়ি ভাগে। শিশু মিয়ারে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘ফেলে দিছি। আম্মা এদের ভবিষ্যতে সব ঠিকঠাক মতো দেওয়ার কথা বলে ফোন রাখেন।’
অবশেষে আম্মার গরু কেনা হয়েছে। বাজেট ঠিক ছিল। সব মিলিয়ে তাঁকে খুশি মনে হলো কিন্তু রহিমার ভুঁড়ি কম পাওয়ায় মনটা খারাপ। আমি বুঝিয়ে বললাম, আপনি রহিমাক ফোন দিয়ে খুশি থাকতে বলেন। আপনিও খুশি থাকেন। তখন সে খুশি ওর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। নতুবা শিশু মিয়ার জন্য এগুলো খারাপ হয়ে যাবে। সে তো অনেক সাহায্য করেছে।