অন্যরকম জন্মদিন পালন

এই করোনাকালে ৮০তম জন্মদিন পালনে সন্তান ও প্রিয়জনদের নেওয়া উদ্যোগে চমকে গেছেন অঞ্জলি দাস।
এই করোনাকালে ৮০তম জন্মদিন পালনে সন্তান ও প্রিয়জনদের নেওয়া উদ্যোগে চমকে গেছেন অঞ্জলি দাস।

করোনা কেড়ে নিয়েছে আমাদের জীবনের সুখ। মুখ থুবড়ে পড়েছে জীবন। জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক সোনালি মুহূর্ত। বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে করোনার এই দুঃসময়ে। তবে মানুষের আবেগ উচ্ছ্বাস থেমে নেই। কোনো না কোনোভাবে মানুষ তা প্রকাশ করছেই।

বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি তো আছেই, এ ছাড়া নানা সৃজনশীল চিন্তাধারা এতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। অঞ্জলি দাস , সুদর্শনা এই প্রৌঢ়া আজ থেকে আশি বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪০ সালে বৃহত্তর সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন। ছেলেমেয়েরা সবাই আগে-পরে সেটল করেছেন দেশের বাইরে (কানাডার টরোন্টোতে)। তাই সুযোগ পেলেই ছুটে আসেন কানাডায় সন্তানদের কাছে। আবার নাড়ির টানে ফিরে যান সিলেটের নিজ বাড়িতে। এভাবে আসা যাওয়া করেন অঞ্জলি দাস।

অঞ্জলি দাসের জন্মদিন ছিল ২8 জুন। ৮০ বছরে পা রাখলেন অঞ্জলি। ছেলেমেয়েরা এবার সিদ্ধান্ত নেন তাঁদের মায়ের আশিতম জন্মদিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করবেন; কিন্তু বাদ সাধে করোনা। এই করোনাকালে কীভাবে স্নেহময়ী মায়ের এই শুভলগ্নটি উদ্‌যাপন করা যায়, এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে থাকেন সন্তানেরা। স্থির হয় ,সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও ভিন্ন উপায়ে অঞ্জলি দাসের জন্মদিন পালন করার। সিদ্ধান্ত হয় মাকে অনেকটা না জানিয়েই এই বিশেষ অনুষ্ঠান হবে—উদ্দেশ্য তাঁকে চমকে দেওয়া।

২৩ জুন সকালে সবাই জড়ো হয় টরোন্টোর একটি সড়কে, যার অনতিদূরেই অবস্থান করছিলেন অঞ্জলি দাস। উল্লেখ্য, তিনি কানাডা এলে পালা করে সন্তানদের বাড়িতে থাকেন। এই সময় তিনি থাকছিলেন মেজো ছেলে অলোক দাসের টরোন্টোর বাড়িতে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অলোক-বর্ণালি দম্পতি মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ তাঁদের বাড়ির নাম রেখেছেন ‘অঞ্জলি’। নাটকীয়ভাবে অঞ্জলি দাস তাঁর ৮০তম জন্মদিনে বাস করছিলেন সেই ‘অঞ্জলি’-তেই।

সারিবদ্ধ গাড়ি সড়কের দু পাশজুড়ে। প্রতিটি গাড়িতে শোভা পাচ্ছে রং-বেরঙের বেলুন, আছে হ্যাপি বার্থডে লেখা স্টিকার। স্পটে পৌঁছার আগে এখানে কিছু প্রস্তুতি চলছে, চলছে রিহার্সাল। সকাল সাড়ে এগারোটায় অনুষ্ঠানস্থলের দিকে ছুটে চলে গাড়ির বহর। সাইরেন বাজিয়ে এসব গড়ি যখন সড়ক প্রদক্ষিণ করছিল, তখন আশপাশের মানুষজন হর্ষধ্বনি দিতে থাকে। জন্মদিন পালনের এমন শোডাউন দেখে এলাকাবাসীরা অভিভূত। তবে অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা প্রতিবেশীদের এ বিষয়ে আগেই অবহিত করে রেখেছিলেন, যাতে কেউ শব্দদূষণ বা পরিবেশ বিনষ্টের অভিযোগ না করতে পারে।

এই করোনাকালে ৮০তম জন্মদিন পালনে সন্তান ও প্রিয়জনদের নেওয়া উদ্যোগে চমকে গেছেন অঞ্জলি দাস।
এই করোনাকালে ৮০তম জন্মদিন পালনে সন্তান ও প্রিয়জনদের নেওয়া উদ্যোগে চমকে গেছেন অঞ্জলি দাস।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাড়ি থেকে না নেমে সবাই হাত নেড়ে প্ল্যাকার্ড, স্টিকার উঁচিয়ে অঞ্জলি দাসকে শুভেচ্ছা জানায়। এ সময় অঞ্জলিকে সহাস্যে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর জন্মদিন পালন উপলক্ষে কিছু একটা হচ্ছে এটা তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারেননি কত চমক অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। তাই বাড়ির বাইরে পা দিয়ে তিনি হতচকিত হয়ে যান। সব আয়োজনই করা হয়েছিল বাড়ির সামনের আঙিনায়। অঞ্জলি ভাবতেই পারেননি তাঁকে ঘিরে এত আয়োজন। এত মানুষ, এত কাণ্ড দেখে তিনি রীতিমতো অবাক। এত কিছু চোখের সামনে দেখে তিনি অনেকটা নির্বাক। ঠায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার চৌকাঠ ধরে। বর্ণালি (মেজো ছেলের বউ) তাঁকে সিঁড়ি ভেঙে নামালেন নিচে, বসালেন তাঁর জন্য রাখা বিশেষ আসনে। বাড়ির চৌহদ্দি জুড়ে অঞ্জলিকে উইশ করে লেখা হয়েছে ফেস্টুন।

জন্মবার্ষিকী সম্বন্ধে, তিনি কিছুই বলতে পারেননি। শুধু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছিলেন। বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী বলবেন। ওই মুহূর্তে তিনি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এমন আবেগঘন মুহূর্তে বলতে পারার কথাও নয়। তবে তাঁর মনের অভিব্যক্তি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম। কি এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাঁর অন্তরজুড়ে; দুঃখের নয়, সুখের সে ঝড় পরম শান্তির। জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপন হয়তো একটা উপলক্ষ। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে যেটি সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তা হলো মায়ের প্রতি সম্মান। এটি এক বিরল সম্মাননা। অঞ্জলিকে শুভাশীষ জানাতে আসা অনুরাগীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল শিশু-কিশোর। তাদের জন্য এই অনুষ্ঠান ছিল শিক্ষণীয়ও বটে। তারা আজ স্বচক্ষে দেখল, কীভাবে বড়দের সম্মান করতে হয় এবং ইচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকলে তা যে করা সম্ভব, তাও অনুধাবন করল তারা। সেদিক থেকে বিচার করলে, অঞ্জলির আশিতম জন্মবার্ষিকী পালন ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে।

অনুষ্ঠানের অন্যতম সংগঠক অঞ্জলি দাসের পুত্রবধূ বর্ণালি দাসের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন তারা এমন ব্যতিক্রমী একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একজন তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন ছেলেমেয়ে বড় করার জন্য। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মা কত কষ্টই না করেন, সেই মাকে তাঁর উপযুক্ত সম্মান ও ভালোবাসা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সেই বোধ থেকে, সেই তাড়না থেকে আমরা উদ্যোগী হয়েছি মায়ের জন্মদিন উদ্‌যাপন করার।’ বর্ণালির মতে, ‘আমাদের ছোট এ জীবনে সব আশাই হয়তো পূরণ হয় না। প্রতিটি মায়ের আশা থাকে যে, তাঁর সন্তানেরা যেন তাঁকে ভুলে না যায়, যেন তারা তাঁকে মনে রাখে। মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা মায়ের সেই আশা পূরণের জন্য আমরা সবাই যেন চেষ্টা করি।’

অনুষ্ঠানের শেষদিকে বৃষ্টি নামে,গাড়ি স্টার্ট দিই চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। লুকিং গ্লাসে দেখলাম অঞ্জলিকে ঘিরে উৎসব তখনো চলছিল। খুশির এ বন্যায় যোগ দিতে চায় বৃষ্টিও। বৃষ্টি যেন আর থামেই না। এ বৃষ্টি আনন্দের। এ বৃষ্টি ভালোবাসার।