'নারী ওবামা' কামালা হ্যারিস বাইডেনের রানিংমেট

জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস
জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস

আফ্রিকান-আমেরিকান ও ভারতীয়-আমেরিকান সিনেটর কামালা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিজের রানিংমেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জো বাইডেন। আগামী নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা। গত মঙ্গলবার সমর্থকদের এক ই-মেইলে তিনি বলেন, ‘দারুণ খবর। কামালা হ্যারিসকে আমি নিজের রানিংমেট হিসেবে নির্বাচন করেছি।’

আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে আরও দুজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেছেন। ১৯৮৪ সালে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ওয়াল্টার মন্ডেলের রানিংমেট হিসেবে জেরাল্ডিন ফেরারো ও ২০০৮ সালে রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাককেইনের রানিংমেট হিসেবে সারাহ প্যালিন নির্বাচন করেন। কিন্তু এই প্রথম একজন অশ্বেতকায় নারী প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

বারাক ওবামা, যিনি প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, কামালা হ্যারিসের নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালনে তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ‘কামালা তাঁর সারা পেশাদারি জীবনে মার্কিন শাসনতন্ত্র রক্ষায় ও ক্ষমতাহীনদের পক্ষে লড়াই করে কাটিয়েছেন।’ ওবামা বলেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে জো বাইডেন নিজের বিচারক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের প্রমাণ রেখেছেন।

অনেকেই বলেছেন, কামালা হ্যারিস প্রার্থী হিসেবে ‘নারী ওবামা’। ওবামার মতোই তিনি মিশ্র বর্ণের, যদিও তাঁরা উভয়েই নিজেদের আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। ওবামার মা শ্বেতকায় হওয়ায় আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে তাঁর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ভারতীয় মা ও জ্যামাইকান বাবার কন্যা হিসেবে কামালার বর্ণপরিচয়ও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তবে কামালার নিজের এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা নেই। ‘আমি একজন আফ্রিকান-আমেরিকান, এ ব্যাপারে ভিন্ন কথা বলার কোনো সুযোগ নেই,’ একজন প্রশ্নকর্তাকে থামিয়ে দিয়ে এ কথা বলেছেন কামালা হ্যারিস।

বাইডেন আগাগোড়াই বলে এসেছেন, তিনি একজন নারীকে নিজের রানিংমেট হিসেবে নির্বাচনে আগ্রহী। সেই নারী যদি একজন অশ্বেতকায় হন, তাহলে সবচেয়ে ভালো। নিজের কথা রেখেছেন বাইডেন। নভেম্বরে জিততে হলে অন্য কোনো বিকল্পও বাইডেনের হাতে ছিল না। আফ্রিকান-আমেরিকানদের কাছে তাঁর বিপুল ঋণ। বাছাইপর্বে পরপর দুটি প্রাইমারিতে পিছিয়ে পড়ায় অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে পারবেন না। কিন্তু সাউথ ক্যারোলাইনার চতুর্থ প্রাইমারিতে তিনি বিপুল ব্যবধানে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সকে পরাজিত করে লড়াইয়ে ফিরে আসেন। এরপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এই অঙ্গরাজ্যে প্রধানত আফ্রিকান-আমেরিকান নারী ভোটারদের বিপুল সমর্থনে এ বিজয় সম্ভব হয়। নভেম্বরের নির্বাচনে জিততে হলেও তাঁকে এই নারী ভোটারদের ওপর আবারও নির্ভর করতে হবে।

কে হতে পারেন বাইডেনের লড়াই-সঙ্গী, সে প্রশ্নে বিস্তর জল্পনাকল্পনা থাকলেও কামালা বরাবরই সব সম্ভাব্য তালিকার শীর্ষে থেকেছেন। বাইডেন জানিয়েছিলেন, তিনি এমন একজন ব্যক্তিকে নিজের রানিংমেট হিসেবে চান, যিনি প্রথম দিন থেকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং তুখোড় মার্কিন সিনেটর হিসেবে কামালা অবশ্যই দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

৭৭ বছর বয়সী বাইডেন ও ৫৫ বছরের কমলার মধ্যে প্রজন্মগত ব্যবধান থাকলেও তাঁরা উভয়েই অধিকাংশ প্রশ্নে মধ্যপন্থী। তাঁদের এই সহমত দায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে। বলা হয়, আমেরিকার ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা ও বাইডেন জুটি সবচেয়ে সফল। তার কারণ, উভয়েই নীতিগত প্রশ্নে অভিন্ন মত পোষণ করতেন। অনেকেই বাইডেন-হ্যারিসের মধ্যে সেই সহমত দেখতে পাচ্ছেন। কোনো কোনো প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটের জন্য তাঁদের মধ্যপন্থী অবস্থান অস্বস্তির কারণ হলেও নভেম্বরের নির্বাচনে স্বতন্ত্র ও ট্রাম্পের প্রতি অসন্তুষ্ট রক্ষণশীল ভোটারদের দলে টানতে তা সহায়ক হবে।

কামালাকে নির্বাচনের পেছনে আরও একটি হিসাব কাজ করেছে। দুই মাস আগে মিনিয়াপোলিসে শ্বেতকায় পুলিশ হাঁটুর নিচে চেপে ধরে জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বর্ণভিত্তিক ন্যায়বিচারের আন্দোলন সোচ্চার হয়েছে। কামালা হ্যারিস বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁকে রানিংমেট করায় বাইডেন এ আন্দোলনের উত্তাপকে ব্যবহারে সক্ষম হবেন।

বাইডেন আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে দুর্বল, ট্রাম্পের এমন অভিযোগ খণ্ডনেও কামালা তাঁকে সাহায্য করতে সক্ষম হবেন। শ্বেতকায় ভোটারদের প্রভাবিত করতে ট্রাম্প নিজেকে ‘আইনশৃঙ্খলার প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন। কামালার পেশাদারি জীবনের প্রায় পুরোটাই গেছে আইন ব্যবস্থাপনায়। তিনি একসময় নিজেকে ‘টপ কপ’ বা ‘এক নম্বর পুলিশ’ হিসেবেও পরিচয় দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে তাঁর কঠোর অবস্থান অনেক আফ্রিকান-আমেরিকানের চোখে সমালোচিত হয়েছে। এমন একজনকে আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে দুর্বল দেখিয়ে ট্রাম্প সহজে পার পাবেন বলে মনে হয় না।

কামালার অন্য একটি বড় গুণ তাঁর জিবের ক্ষুরধার। সিনেটর হিসেবে তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন্স ও বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে ট্রাম্প কর্তৃক মনোনীত প্রার্থী ব্রেট ক্যাভানাকে তিনি রীতিমতো কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন।

কামালা বাইডেনের রানিংমেট—এ খবরে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় মঙ্গলবার ট্রাম্প তাঁকে ‘ন্যাস্টি’ বা জঘন্য এবং ‘মিন’ বা ইতর বলে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলা বাহুল্য, কথায় শ্লেষ ও নীচতা প্রকাশে ট্রাম্পকে হারানো কঠিন। তবে কামালা হ্যারিস তাঁর প্রতিটি কথাই যে সমান শ্লেষ নিয়ে ফেরত দেবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ডেমোক্রেটিক সিনেটর কোরি বুকার সেদিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, কামালা কাউকে ভয় করেন না, বরং ট্রাম্পের উচিত হবে তাঁকে ভয় করা।