নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করুন

নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের নির্ধারিত সময়ের জন্য এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। সময় ফুরিয়ে গেলে চলে যেতে হয়। করোনার জীবাণুর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা কম বেশি সবাই করে যাচ্ছি। দম আটকে আসছে ঘরে থাকতে থাকতে, তাই বাইরে যাচ্ছি। সামাজিক দূরত্ব মেনে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা করছি। মৃত্যুদূত কার জন্য কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, কেউ তা জানি না।
লেক জর্জ আমাদের পরিবারের খুব প্রিয় একটি জায়গা। আমরা সুযোগ পেলেই যাই। গেল রমজানের ঈদেও পরিবারের সবাই মিলে গেছি। এর আগে ২০১৯ সালের আগস্টে আম্মাসহ গিয়েছিলাম। তবে মিনি হা হা জাহাজে চড়ে লেকে ঘোরার সময় ‘সাঁতার কাটা যাবে না —এ রকম নোটিশ লেখা দেখেছিলাম।
বন্ধুরাসহ নৌকা ভাড়া করেই গেছেন। তানভির মিয়া সাঁতার জানেন। পানিতে নামছেন একজন একজন করে। ওরা স্পিডবোট ভাড়া করে মাঝ পানিতে গিয়ে কেন ওরা নিয়ম ভেঙে ঝাঁপ দিল? নাকি পানিতে নামা এখন অনুমোদিত?
লাইফ জ্যাকেট কেউ পরলেন না। যত দূর জানি, বোটে চড়লে লাইফ জ্যাকেট পরতে হয়। ভিডিও করা হচ্ছে। একজন ঝাঁপ দিল। সাঁতার কেটে দূরে গেল আবার ফিরেও এল। জানাল যে, পানি খুব ঠান্ডা। তারপর আবার গেল। ঘূর্ণির কবলে পড়ল নাকি কে জানে। মৃত্যুদূত ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তাই বন্ধুরা ‘হেল্প’ শুনে স্টার্ট দিতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। কিছুতেই স্পিডবোট স্টার্ট হলো না। স্টার্ট হলে হয়তো বাঁচাতে পারত।
তবে বাংলাদেশি যুব সম্প্রদায়কে ধৈর্য ধরতে হবে। ঘরে থেকেও ভিডিওগেম, বই পড়া, মুভি দেখা, গান শোনা, ছবি আঁকা, বাবা–মায়ের সঙ্গে গল্প করা, এভাবেও সময় কাটানো যায়। এত অসহিষ্ণু হলে তো চলবে না।
১৯৭১ সালে নয় মাস যুদ্ধ করেছে আমাদের পূর্বসুরীরা। না খেয়ে না ঘুমিয়ে। বাবা–মা যারা তাদেরও অনুরোধ করব, সন্তানদের সঙ্গে কথা বলুন। একসঙ্গে সময় কাটান। সবাই মিলেমিশে বের হয়ে আসি এই দীর্ঘ ক্রান্তি কাল থেকে। বেঁচে বর্তে থাকলে আবার ঘোরাঘুরি করা যাবে। ফান করা যাবে।
মারজান রহমানের মা ঊষা ভাবির কান্না সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। এই সন্তানহারা মায়ের মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার দুঃসাহস আমার নেই। বাবা মাহবুব রহমান বুকের ভেতর কষ্ট পুষে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন। এই দম্পতির আরও তিনটি সন্তান আছে। তাদের মুখ চেয়ে হয়তো তারা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঊষা ভাবি থেকে থেকেই বিলাপ করে উঠছেন। আমার বুক কেঁপে কেঁপে উঠে। হাত ধরে শুধুই বসে থাকি। ভাবি স্মৃতিচারণ করেন। দুটি সন্তান ১০ মাসের ব্যবধান। টুইনের মতোই বড় করেছেন। তিনটি বাচ্চাকে স্ট্রলারে করে কীভাবে টানতেন। চার বাচ্চার মধ্যে মারজান অন্যরকম। ওরা যা ভালোবাসে, তাই বানিয়ে খাওয়াতেন। ঈদে বানানো খাবার খেয়ে বলেছে, মা আই অ্যাম ফুল। দারুণ মজা হয়েছে।
আহারে মা। এই তো স্মৃতি সব জড় করে করে দিন কাটবে। সেলুলয়েডের ফিতার মতো চলমান স্মৃতি। কখনো শিশুবেলা, কখনো বড়বেলা। ২৫ বছরের স্মৃতি। আজ ছিল তার জন্মদিন। পূর্ণ হতো পঁচিশ, আয়োজন ছিল। করোনাকালীন সব নিয়ম মেনে অনলাইনে অর্ডার দেওয়া ছিল। এই মা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছেন। সঙ্গে তার বাবার দীর্ঘশ্বাস। মায়ের জন্য সব ভালো ভালো উন্নতমানের জিনিস মারজান নিয়ে আসত। মাকে খুশি করা, খুশি রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করত। রাতে ফোন করে জানিয়েছিল, সরি মা আমার একটু লেট হবে। এই শেষ কথা। আর কথা হয়নি। আর হবেও না। তানভির, মারজানের পিতা–মাতা আত্মীয়স্বজনের জন্য আমাদের সহমর্মিতা, সহানুভূতি থাকবে। বাংলাদেশি কমিউনিটির সবার প্রতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করার অনুরোধ রইল। আমরা আর যেন কোন অপমৃত্যুর সংবাদ না শুনি।