মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর জন্য প্রার্থনা

১৯৯১ সালে মসনুদের সঙ্গে লেখক
১৯৯১ সালে মসনুদের সঙ্গে লেখক

করোনাভাইরাসের দানবিক করালগ্রাস তখন নিউইয়র্কে। মিশিগানেও ক্রমশ বাড়ছে। বন্ধু মসনুদকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম কোভিড ১৯–এর পরিস্থিতি। তখন কাউকে ফোন দেওয়ার একমাত্র প্রসঙ্গই ছিল, ভাইরাসে কার কী শারীরিক অবস্থা তা জানা। মসনুদের কণ্ঠে স্বাভাবিক জবাব, গ্যাস স্টেশনে এসেছি। আমার বুঝে নিতে মোটেই কষ্ট হল না, মসনুদের গ্যাস স্টেশনে যাওয়া মানে গ্যাস নয়, এক প্যাকেট মার্লবরো লাইট সিগারেট কিনতে যাওয়া।
আমার কৈশোরের বন্ধু আবদুল আজিজ চৌধুরী মসনুদ চলনে–বলনে খুবই লাজুক প্রকৃতির মানুষ। কলেজে পড়াকালে আমরা একই বাইসাইকেলে করে যাতায়াত করতাম। চাঁদনি রাতে ভাঙার পুলে বসে অন্যান্য বন্ধুসহ আড্ডা দিয়েছি অনেক দিন।
সুনামগঞ্জ শহরে সাহিত্যমোদী কিছু বন্ধুকে নিয়ে একমাত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠন; আমরা কতিপয় তরুণ সাহিত্যসেবীর সঙ্গে মসনুদ ও আমি ছিলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তখন আমরা আধুনিক কবিতা নিয়ে চর্চা করতাম। তখনকার সময়ে কবি সামছুর রহমান, নির্মলেন্দু গুন, আবুল হাসান, আল মাহমুদ—এই বিশিষ্ট কবিদের কবিতা নিয়ে চর্চা করতাম। মসনুদ এককালে সুন্দর কবিতা লিখত। কিছু সাহিত্যসেবীর উদ্যোগে সপ্তাহে একদিন আমাদের কবিতা আড্ডা বসত। স্থানীয় আদর্শ শিশু শিক্ষা নিকেতনে (বর্তমানে কিন্ডার গার্ডেন) একদিন বিকেলে সবাইকে জানানো হল, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর কবিতার ওপর আবৃত্তির প্রতিযোগিতা হবে, এতে বিচারক থাকবেন সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবদুল হাই যিনি মসনুদের আপন চাচা।
খবর শুনে মসনুদ বেঁকে বসল, চাচা বিচারক, তাই সে যাবে না। লজ্জা বলেতো একটা কথা আছে।
যাক, অনেক বলে–কয়ে তাকে নিয়ে গেলাম। কবিতার দুটি লাইন এখনো মনে আছে, নজরুল লিখেছিলেন, ‘নাই তাজ তাই লাজ, ওরে মুসলিম খর্জুর শিশে তরা সাজ।’ একে একে সবার আবৃত্তি শেষ, মসনুদের পালা। সে তো কাঁপতে কাঁপতে একেবারে নার্ভাস। হাত কাঁপছে, সঙ্গে হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। যদিও অন্য সময় তার আবৃত্তি খারাপ ছিল না। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। আমি চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি। মসনুদ তাদের পুরো পরিবার নিয়ে ভারতের মেঘালয় সীমান্তের ভালাটে। একাত্তরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমিও ভালাট যেতে সক্ষম হই। পরদিন মসনুদ ও তাদের পরিবারের খোঁজ নিয়ে জানলাম, তাদের পরিবারের সবাই একটা বাড়িতে আছেন,যেখানে বাংলাদেশ অস্থায়ী মিশন করা হয়েছে। মসনুদের আব্বা প্রয়াত আবদুল আহাদ চৌধুরী বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক বিধায় সুনামগঞ্জের নেতৃবৃন্দের জন্য মিশনের আশপাশের বাড়িগুলোতে বসবাস করতে ভারত সরকার ব্যবস্থা করেছে। ওখানে গিয়ে জানলাম, মসনুদ মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। মসনুদের খোঁজে আমি গেছি শুনে চাচি (মসনুদের আম্মা) বাইরে এসে আমাকে মসনুদের খবর জানতে চাইলেন। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, আমি মসনুদের সঙ্গে ছিলাম। আমার কাছ থেকে ছেলের খবর না পেয়ে একটু মনঃক্ষুণ্ন হলেন, কিন্তু আমাকে আপ্যায়িত করতে ভোলেননি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা আবার সরব হলাম। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দুজন পাশাপাশি বসে সম্মানের সঙ্গে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করলাম। ইতিমধ্যে তার চাকরি হল বাংলাদেশ ভোগ্যপণ্যের দোকানে স্টোর ম্যানেজার হিসেবে। কিছুদিন পর ব্যক্তিগত কারণে সে চাকরি থেকে ইস্তফা দিল। ইতিমধ্যে বড় ভাই জামসেদ চৌধুরী ফার্মাসিস্ট হয়ে চলে এলেন আমেরিকায়। তখন থেকে মসনুদ আমেরিকার স্বপ্নে বিভোর। একদিন তার ঘরে গিয়ে দেখি, হস্তরেখা বিষয়ক একটা বই হাতে। আমাকে দেখেই বইটি আমার হাতে দিয়ে দুখানা হাত মেলে ধরে আমাকে বলে, দেখত বিদেশে যাওয়ার কোন রেখা আছে কি না। একদিন সত্যিই বড় ভাইয়ের স্পনসরে পর্যায় ক্রমে পরিবারের সবাই আমেরিকায় পাড়ি জমাল।
দেশে মাঝেমধ্যে আমাকে চিঠি লিখত, আর বলত যান্ত্রিক চাপে সে নিজেও যন্ত্র হয়ে গেছে। তার হাতের লেখা খুবই সুন্দর ছিল, আমি তার লেখা নকল করার চেষ্টা করতাম। আমি প্রথমে ভাবতাম, সে হয়তো আমাকে কিছু আড়াল করছে। কারণ আমার স্বজনেরা দেখতাম, লন্ডন থেকে দেশে এলে দেদারসে পয়সা খরচ করতেন, পিনপিনা সার্টের বুক পকেটে পাঁচ শ টাকার নোট নিয়ে বাজারে যেতেন। বাজারের বড় মাছটা তাদের জন্য বরাদ্দ থাকত। তখন দেশে তিন সাবের নাম ডাক ছিল। লন্ডন সাব, চেয়ারম্যান সাব আর দারোগা সাব।
আশির দশকে দেশে গেল মসনুদ, আমি তখন সিলেটে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। একদিন আমি সুনামগঞ্জ গিয়ে দেখি, পুরোনো বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশায় আসছে সে। আমাকে দেখেই রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর অনেক কথা। কোথায় আছি, কী করছি ইত্যাদি। পরদিন আমার সঙ্গে চলে এল সিলেটে। তারপর আগের মতোই আমাদের ওঠাবসা। আমার বাসায় এক রাত কাটিয়ে পরদিন বলল, সিলেটে এসি রুমের কোন হোটেল থাকলে আমাকে নিয়ে চল। তখন সিলেটে একমাত্র সাহবান হোটেল ছিল এসিযুক্ত। আমার সঙ্গে সারা দিন কাটিয়ে রাতে হোটেলে চলে যেত।
১৯৮৯ সালের একদিন আমিও মসনুদের পথ অনুসরণ করে আমেরিকায় চলে এলাম। ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে এক পরিচিত লোকের ওখানে বেশ কিছু দিন ছিলাম। আমরা আমেরিকা পৌঁছলাম খবর শুনেই মসনুদ প্রায় প্রতিদিন ফোন করে আমাকে তাড়া দিত, নিউইয়র্ক চলে আসতে। একদিন ঠিকই তার সান্নিধ্যে চলে এলাম। আমাকে পেয়ে যে তার কি আনন্দ, তার স্মৃতি এখনো আমাকে আপ্লুত করে। রাতের জ্যাকসন হাইটসে ঘুরতে গিয়ে জনমানবহীন রাস্তায় গাড়qি থামিয়ে কি আনন্দের বহিঃপ্রকাশ, তা আজ যেন নস্টালজিয়ার অদম্য তাড়না।
দুসপ্তাহ আগে তার সঙ্গে ফোনে কথা হল, আমাকে জানাল সে হাসপাতালে আছে। তার গল ব্লাডারের অসুখ দেখা দিয়েছে এবং তার ওজন নাকি অনেক কমে গেছে। কারণ খাওয়ার রুচি নেই। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়েছি, বলেছি তুই সুস্থ হয়ে যাবি। এরপর আমি প্রায় প্রতিদিন ফোন করি, কিন্তু তার শারীরিক সুস্থতার কোন খবর আমাকে দিতে পারেনি। শুধু বলে, আমার জন্য দোয়া করিস যেন নিউইয়র্ক এসে তোর সঙ্গে দেখা করতে পারি।
সেদিন মসনুদের ছোট ভাই মারুফ চৌধুরী আমাকে মেসেজ পাঠিয়ে মসনুদের গুরুতর অসুস্থতার কথা জানাল। মেসেজ পেয়ে মারুফকে ফোন দিলাম। কিন্তু মারুফের কথা শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মারুফ জানাল, তার ছোট ভাইয়া (মসনুদের) ক্যানসার ধরা পরেছে। কিন্তু মসনুদকে জানতে দেওয়া হয়নি। তৎক্ষণাৎ মসনুদকে ফোন দিয়ে আলাপ না করেই জানতে চাইলাম, তার আশপাশে কেউ আছে কি না। সে জানাল, তার বড় মেয়ে জাসিয়া চৌধুরী বিনি পাশে আছে। শুনে আশ্বস্ত হলাম। আমি জানি, জাসিয়া মেডিকেল সায়েন্স কার্ডিওলজিতে ডিগ্রি নিয়ে নিউইয়র্কে এক প্রাইভেট ডাক্তার ফার্মে চাকরি করছে। জাসিয়ার সঙ্গে আলাপ করে বিস্তারিত জানলাম। সে জানাল, তার বাবার ক্যানসার একেবারে চরমে পৌঁছে গেছে। হার্ট, কিডনি মারাত্মক সংক্রামিত হওয়ায় তাকে চিকিৎসা দেওয়ার মত কোন সুযোগ এখন আর নেই। তবুও আশা ছাড়েনি মেয়েটি। বলছে, নিউইয়র্ক নিয়ে শেষ চেষ্টা করে দেখবে।
পরে মসনুদকে নিউইয়র্ক আনা হয়েছে। শুনেই তাঁকে ফোন দিলাম, কিন্তু ফোন ধরেনি। কিছুক্ষণ পরই আমাকে কলব্যাক করে জানাল, তাকে লং আইল্যান্ডের নর্থ শোর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুনেই বললাম, আমি আসছি। আমার স্ত্রী তখন পাশে থেকে বলল, আগে জেনে নাও হাসপাতালে রোগী দেখতে দেয় কি না। স্ত্রীর কথা ভেবে জাসিয়াকে ফোন দিলাম। সে জানাল, হাসপাতালে এখন মাত্র দুজনের নাম দিতে হয়। এ দুজন ছাড়া কেউকে ঢুকতে দেয় না। মন খারাপ হল শুনে। মসনুদকে আবার ফোন দিলাম। তার কণ্ঠস্বর শুনে কান্না পাচ্ছিল। এখন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছি, এ অবস্থায় তাকে এক নজর দেখেই বা কী হবে। তার চেয়ে তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে রোগমুক্তির প্রার্থনা করি।