‘আসামি ল্যান্সার মহিউদ্দিনের বিলম্ব মার্জনার আবেদনে বলা হয়, তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে এসে জেনেছেন, তাঁকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। জেলখানায় প্রবেশের পর জেনেছেন, এ মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে ল্যান্সার মহিউদ্দিন হলফনামা দিয়ে বলেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় জড়িত। দেশে ফিরে এলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হবে।’গতকাল বৃহস্পতিবার ২৪তম দিনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আপাতত উপস্থাপনা শেষ করেছেন। মহিউদ্দিনের বক্তব্যকে সর্বৈব মিথ্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন বক্তব্য দিয়ে ল্যান্সার মহিউদ্দিন আদালত ও তত্কালীন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। যদিও ল্যান্সার মহিউদ্দিনের বিলম্ব মার্জনা মঞ্জুর করা হয়েছে। তাই বিষয়টি অকার্যকর। আদালত বলেন, ওই সময় আপনাকে কয়েকবার সময় দেওয়া হয়েছে এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য। জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘আমারও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’ গতকাল সকাল নয়টা ৫০ মিনিটে শুনানিতে অংশ নিয়ে শুরুতে ঘটনা ও সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে আনিসুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অভিন্ন উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তি আনিসুল হককে খুন করা নিয়ে কথা বলছি না। বলছি তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করার প্রসঙ্গে। এ জন্য আসামিদের রেডিও স্টেশনে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।’প্রসঙ্গ রেডিও স্টেশন: কারণ ব্যাখ্যা করে আনিসুল হক বলেন, যাঁরা রেডিও স্টেশনে ছিলেন, তাঁরাও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। উপস্থিতি এখানে বিবেচ্য বিষয়। আদালত বলেন, ষড়যন্ত্রে উপস্থিতি প্রশ্নে বলুন। জবাবে আনিসুল হক বলেন, দণ্ডবিধির ৩৩ ধারা অনুযায়ী অভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হলে অভিযুক্ত দোষী হবেন। তিনি বলেন, সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফারুক রহমান, রশিদ, ডালিম, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ ও মেজর নূর রেডিও স্টেশনে গিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করেই আসামিরা রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘোষণা দেওয়ার জন্য। আদালত বলেন, অপরাধের ক্ষেত্রে উপস্থিতির বিষয়টি তাত্পর্যপূর্ণ। সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে আনিসুল হক বলেন, যদি আসামিরা রেডিও স্টেশনে দখল না নিতেন, তত্কালীন উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী রেডিও স্টেশনে যেতেন, তাঁরা ঘোষণা দিয়ে বলতেন, বেরিয়ে আস। তাহলে উল্টো চিত্র হতো, প্রতিবাদ হতো ও হত্যাকারীদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। তাই যাঁরা রেডিও স্টেশনে ছিলেন, তাঁরাও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নীলনকশার অংশ হিসেবে ক্ষমতার দখল নেওয়ার জন্যই রেডিও স্টেশনে গিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাই রেডিও স্টেশনে যাওয়া ও ঘোষণা দেওয়া মূল ষড়যন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদালত বলেন, উপস্থিতির বিষয়টি না হয় প্রতিষ্ঠিত হলো। আনিসুল হক বলেন, ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রথমত অভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে তাঁদের অংশগ্রহণের বিষয়টি। তাই ঘরে বসে ১০ জন পরিকল্পনা করলেন, কাজ ভাগ করে দেওয়া হলো। পরে একজন অংশ নিয়েও ঘটনা সম্পন্ন করলে অভিন্ন উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে। অংশ নিলেই অভিন্ন উদ্দেশ্যের বিষয়টি পূর্ণতা পেল। তাই আসামিদের রেডিও স্টেশনে যাওয়া ষড়যন্ত্রেরই অংশ। দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা উদ্ধৃত করে আনিসুল হক বলেন, অভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে যদি কেউ যড়যন্ত্রে যুক্ত থাকেন এবং উদ্দেশ্য সফল হলে অপরাধীরা সমভাবে দায়ী হবেন। হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র মহাপরিকল্পনা। এ জন্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের দরজায় উপস্থিত থাকতে হবে, এমন তো নয়। একজন সাধারণ ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনা নয় ছিল না এটি। সার্বিকভাবে বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রসঙ্গে: সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, বলা হয়েছে, ফারুক রহমানকে টানা ৩২ দিন আটক ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে ২৭ দিন আটক রাখার পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। আসামিপক্ষ বলেছে, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আইনসম্মত হয়নি। যুক্তি খণ্ডন করে আনিসুল হক বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এর সপক্ষে তিনি ঘটনা বিশ্লেষণ ও নথি থেকে দিন-তারিখসহ তথ্য তুলে ধরেন। এ সময় নজির তুলে ধরে আদালত মন্তব্য করেন, যখন সাক্ষ্য-প্রমাণে অপরাধ প্রমাণিত হয়ে যায়, তখন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আমলে না নিলেও হয়। দুই পক্ষের বক্তব্য: শুনানির শেষে আদালত থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপাতত আমার বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হয়েছে, রোববার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম বলবেন। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন এবং হাইকোর্ট তা বহাল রেখেছেন। এর সপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছি।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুর রেজাক খান প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য উপস্থাপন শেষে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু জবাব দেওয়া হবে।