আজ শুধু আঁখিজলে পিছনে চাওয়া

রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হকের জন্মদিন আজ। গেল এপ্রিলে মৃত্যুর পর এই তাঁর প্রথম জন্মদিন। এদিন তাঁকে স্মরণ করেছেন তাঁর এক স্বজন।

মিতার কণ্ঠে আমার শোনা প্রথম গান ছিল ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।/ আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।’
গলার স্বরে মাধুর্য ঝরে ঝরে পড়ছিল। সঙ্গে শুদ্ধ উচ্চারণে ও স্পষ্ট বাণীতে গানটি যেন একেবারে মূর্ত হয়ে উঠল মুহূর্তে। মিতার কণ্ঠে ওই গানে এমন কিছু ছিল, যেন ও ওরই কথা বলছে! এতটাই বিশ্বাসযাগ্য ছিল তার নিবেদন।

এত তৈরি সুরেলা গলা! এ ধরনের তীক্ষ্ণ ও সুরেলা কণ্ঠ হলেই আমরা ধরে নিই, এ গলা নজরুলগীতির জন্য উপযুক্ত বা এ কণ্ঠে নজরুলগীতি ভালো ফোটবে! এ ধারণাকে রীতিমতো চ্যালঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মিতা হক রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এল এবং জয় করে নিল আপামর বাঙালিকে। রবীন্দ্রনাথের গান যে স্পষ্ট করে, অর্থ অনুধাবন করে গাওয়ার বিষয়, এ চর্চা মিতা হক তার পরিবার থেকেই পেয়েছিল। ওর মামার বাড়িতেও গানের চর্চা ছিল। তবে সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের ভাইয়ের মেয়ে হওয়ার কল্যাণে মিতা হকের রবীন্দ্রসংগীতচর্চার বিষয়টি খুব সহজ হয়ে এসেছিল ওর জীবনে। প্রথাগতভাবে ছায়ানট বা শান্তিনিকেতনে গান না শিখেও যে মিতা হক রবীন্দ্রসংগীতজগতে নিজেকে উচ্চ আসনে বসাতে পেরেছিল, তার পেছনে ছিল সংগীতের প্রতি তার নিষ্ঠা ও বিরামহীন চর্চা।

মিতা হকের আয়তচক্ষু, নির্মল হাসির মধ্যে একটা লাবণ্য তো ছিলই, স্বভাবে কোথায় যেন একটা ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাসও ছিল। ছিল খোলা একটি মন। ঠিক এ জায়গাতেই ওকে আমার ভালো লেগেছিল।

মন খোলা না হলে এমন গান হয়! মনে পড়ছে বহুদিন আগে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকারের কথা। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ভালো গাইতে হলে ভালো মন লাগে। মন দিয়ে গাইতে হয় তো।’ এই যে গানের সঙ্গে মনেরও চর্চা করতে হয়, এ বোধ কজনের থাকে!
তারও আগে, যখন ওর কোনো গান শুনিনি, দেখতাম কোনো অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে বাংলা একাডেমির বইমেলার বিকেলগুলোতে যে অনুষ্ঠানগুলো হতো, সেখানে অস্থির, চঞ্চল, একটি মেয়ে চড়ুই পাখির মতো এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে সংকোচহীন।

এই যে কথাগুলো লিখলাম, মিতা থাকলে সাহস হতো কি না, জানি না। স্পষ্টবাদী মিতা হয়তো ধরে বসত, হয়তো বলত, ‘এই শীলু, কী সব লেখো!’ মিতাকে আমি সমীহ করতাম। সমীহ করতাম এ কারণে নয় যে মিতা আমার বড় ভাশুর খালেদ খানের স্ত্রী। সমীহ করতাম। কারণ, যে কাজটি সে করে, করেছে সারা জীবন, সেখানে কোনো ফাঁকি দেয়নি। ধ্যানমগ্ন হয়ে থেকেছে। বিশেষ করে গানে ও প্রেমে—তা সন্তানের প্রতি হোক, ভাইয়ের প্রতি হোক, জীবনসঙ্গী কিংবা সংসারের প্রতি।

মানুষকে প্রশংসার ব্যাপারে সে ছিল অকৃপণ। এই তো মাত্র কদিন আগে, মিতা আমাকে বলেছিল, ‘তোমার একটা জিনিস আমার খুব ভালো লাগে।’ আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কী, বলত?’
ও কোনো ভণিতা না করে বলেছিল, ‘তোমার পড়াশোনা। তুমি বেশ পড়ো। খোঁজখবর রাখো। আমার কেন যেন পড়াটা হয় না। মন বসাতে পারি না।’ আমার সাহিত্যপ্রীতির খোঁজখবর ওর কাছে ছিল। ও জানত আমার কণ্ঠে সুর নেই, অথচ প্রাণে বিপুল তরঙ্গের মতো সুর খেলে। ‘গীতবিতান’ তাই আমার কাছে পাঠের, গীত হওয়ার নয়! মিতা শিক্ষা নিয়েছিল জীবন থেকে, মেধাবী সঙ্গ থেকে। ওয়াহিদুল হক, সন্‌জীদা খাতুন, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের মতো সংগীতজ্ঞদের কাছ থেকে।

আমাদের অনেক কমন বন্ধু ছিল। একে অপরকে তাই বিয়ের আগেই মোটামুটি চিনতাম। কিছুটা জানতাম। আমরা যে পরস্পর খুব ভালোবাসায় আঁকড়ে ছিলাম, তা নয়। তবু কখন যে পরস্পরের প্রতি কিছুটা নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলাম, নিজেরাও জানি না!
তখন নিউইয়র্কে থাকি। ১৯৯৭ সাল। আমাদের কন্যা বসুধা এসেছে সদ্য আমাদের জীবনে। মিতা আমেরিকায় গিয়েছিল সে সময় গানের নিমন্ত্রণে। বসুধার দাদার বাড়ির মানুষের মধ্যে প্রথম ও-ই বসুধাকে দেখেছে, ভীষণ উচ্ছ্বাস ছিল সে দেখায়। বারবার বলেছিলও সে কথা। ওকে নিয়ে বোনের বাসা রকল্যান্ড কাউন্টিতে গিয়েছিলাম। আড্ডায়, গানে চমৎকার সময় কাটিয়েছিলাম। এসবই সুখস্মৃতি।

মিতা ধীরে ধীরে যেন বুঝতে পেরেছিল, আমার ওপর আস্থা রাখা যায়। মেয়ে জয়িতার পানচিনির সময় বলেছিল, ‘বেশি কাউকে বলছি না, তুমি কিন্তু থাকবে।’ থেকেছিলাম।

বিয়ের পর নতুন জামাইকে নিয়ে জয়িতা ওর দাদার বাড়িতে যাবে (যেখানে কেউ থাকে না। আমাদের শাশুড়ি মাঝেমধ্যে যেতেন, যত দিন বেঁচে ছিলেন।)। তখন মিতা বলল, ‘শোনো, আমার শরীরটা ভালো না, যেতে পারছি না। তুমি যাও প্লিজ, বেয়াইন প্রথম যাচ্ছেন।’ আমি খুশি মনেই গিয়েছিলাম। মিতাও খুশি হয়েছিল। মিতা মানুষকে আপ্যায়ন করতে খুব ভালোবাসত। রান্নার হাত ছিল দুর্দান্ত। চটপটে, বুদ্ধিমতী, হাস্যমুখ মিতার মানুষের সঙ্গে সহজে মেশার এক আশ্চর্য গুণ ছিল।

‘ছিল’ শব্দটি লিখতে গিয়ে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আসলে মিতার মতো শিল্পীরা কখনো অতীত হয় না। তাঁদের ঐশ্বর্যভরা জীবন নিয়ে সর্বদা থাকে বর্তমান।

লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেল ওর প্রথম ক্যাসেটের একটি গান:
‘ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু,
তোমার নামে বাজায় যারা বেণু।
পাষাণ দিয়ে বাঁধা ঘাটে এই যে কোলাহলের হাটে
কেন আমি কিসের ডাকে এনু।
কী ডাক ডাকে বনের পাতাগুলি, কার ইশারা-তৃণের অঙ্গুলি!
প্রাণেশ আমার লীলাভরে খেলেন প্রাণের খেলাঘরে,
পাখির মুখে এই যে খবর পেনু।’

পূজা পর্যায়ের এই গান ওর স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণে, অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠে শুনে কী অসম্ভব ভালো যে লেগেছিল, এখনো মনে করতে পারছি।

আমি গানের মানুষ নই। একজন নিবিষ্ট শ্রোতামাত্র। মিতা হকের গান নিয়ে কথা বলার মতো অনেকেই রয়েছেন। আমি বলছি একান্ত, একজন ঘরের মিতার কথা। তুলে ধরতে চাইছি মিতার বিশ্বাস ও জীবনাচরণকে। বলতে চাইছি আমার দেখা একজন মানবিক মিতা হকের কথা। একজন মানুষ যখন তার সুকর্ম দিয়ে অনেক পরে উঠে যায়, তার পরিপার্শ্বেরও একটি ভূমিকা থাকে। যেমন পেয়েছিল মিতা হকও। বিয়ের আগে যেমন বাবার বাড়ি থেকে, বিয়ের পর তেমনি শ্বশুরবাড়িতেও পেয়েছে বিপুল এক আনন্দময় ও সংগীতময় পরিবেশ।

তখন নিউইয়র্কে থাকি। ১৯৯৭ সাল। আমাদের কন্যা বসুধা এসেছে সদ্য আমাদের জীবনে। মিতা আমেরিকায় গিয়েছিল সে সময় গানের নিমন্ত্রণে। বসুধার দাদার বাড়ির মানুষের মধ্যে প্রথম ও–ই বসুধাকে দেখেছে, ভীষণ উচ্ছ্বাস ছিল সে দেখায়। বারবার বলেছিলও সে কথা। ওকে নিয়ে বোনের বাসা রকল্যান্ড কাউন্টিতে গিয়েছিলাম। আড্ডায়, গানে চমৎকার সময় কাটিয়েছিলাম। এসবই সুখস্মৃতি।

এক যুগ আমেরিকায় কাটিয়ে আমরা দেশে ফিরেছি ২০০৯ সালে। তারপর থেকে আমাদের জীবনটা অনেকটাই মিতাদের বাসাকেন্দ্রিক ছিল। বছরের বিশেষ কয়টি দিন আমরা ওদের বাসায় যেতামই। বিশেষ করে খালেদ খান, মিতা, জয়িতার জন্মদিন, দুই ঈদ ও পয়লা বৈশাখে। সারা দিন হইচই করে, শুয়েবসে গল্প করে, মজার সব খাবার খেয়ে যার যার বাসায় ফিরে যেতাম। জয়িতার বাবা চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে সেটা কমে যায়।

এসব পারিবারিক জীবনের বাইরে আমি ক্রমশ এক অন্য মিতাকেও যেন আবিষ্কার করি। পুরোদমে সংসার করেও সম্পূর্ণ একটি শিল্পীর জীবন যাপন করেছে মিতা হক। এ ক্ষেত্রে ওর পরিবারের সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার কথা আগেই বলেছি।

একসময় ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান এবং রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিল মিতা হক। সম্মিলন পরিষদের হয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। ওয়াহিদুল হকের যোগ্য শিষ্য মিতা হক গানের ব্যাপারে নিজের কাছে এতটাই দায়বদ্ধ ছিল যে কোনো বাধাতেই পিছু হঠত না। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ওকে প্রতিবাদ করতে দেখা যেত।

ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে গানের আমন্ত্রণে যখন–তখন। ধীরে ধীরে সেসব কমে এসেছিল, তাঁর জীবনসঙ্গী অভিনেতা খালেদ খান অসুস্থ হওয়ার পর থেকে।

মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে মিতা হকের ছিল স্বচ্ছ অবস্থান। কোনোভাবেই এখানে সমঝোতায় বিশ্বাস করত না। মৌলবাদের বিপক্ষে সর্বদাই ছিল সোচ্চার। অনেক সাক্ষাৎকারে সে কথা স্পষ্ট বলেছে।

অনুষ্ঠানে গানের বাইরে যদি কোনো বিষয়ে কথা বলার থাকত, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতাম। স্পষ্ট উচ্চারণ, সাবলীল বলার ভঙ্গি, বিষয়ের গভীরতা, বিশ্বাসের গভীরতা—সব মিলিয়ে ওর কথা বলাটা খুব বিশেষ হয়ে উঠত।

মিতা হক
ছবি: সংগৃহীত

এখন একটু বেশিই ব্যক্তিগত একটি ঘটনা শেয়ার করতে ইচ্ছা করছে। আমরা পরস্পরের সাজসজ্জা ও শাড়ির ভক্ত ছিলাম। কোনো এক উৎসবে একটি তাঁতের শাড়ি উপহার দিই ওকে। সেই শাড়ি পরে প্রধানমন্ত্রীর এক বিশেষ দাওয়াতে গিয়েছিল সে।

এরপর দেখা হলে প্রথমেই সেই কথা খুব খুশিমুখে জানিয়েছিল। আমি তো তাজ্জব! বলে কি! এতটা সাধারণ ছিল সে সাজসজ্জা, পরিধানে। তবু যখন বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর চোখ দুটিতে ঘন কাজল আর একটি বড় টিপ পরত, মুহূর্তে বিশেষ হয়ে উঠত ওর চেহারা। আমার মনে হয়, মানুষের সঙ্গে সহজ ব্যবহারেই ছিল ওর আসল সৌন্দর্য। সহজ হওয়াই যে সবচেয়ে কঠিন! পরিবারের সব বাচ্চারাও ছিল ওর খুব প্রিয়। আমাদের কন্যা বসুধাকে খুব আদর করত। ওর কণ্ঠে ইংরেজি গান শুনতে পছন্দ করত। আফসোস হয় মিতার কাছে বসুধার কোনো রবীন্দ্রসংগীত শেখার সুযোগ হয়নি বলে।

মা–বাবার একমাত্র কন্যা হিসেবে খুবই আদরে মানুষ হয়েছে মিতা। ছোট ভাই রাজনের প্রতি ওর যে ভালোবাসা, স্নেহ, কর্তব্যবোধ দেখেছি, তা এককথায় বিরল। শারীরিক ও মানসিকভাবে রাজন একজন বিশেষ মানুষ। ভাইকে যে সম্মান ও আদরের সঙ্গে মিতাকে সার্বক্ষণিকভাবে সঙ্গ দিতে দেখেছি, তা রীতিমতো শিক্ষণীয়। যেখানেই গেছে, চেষ্টা করেছে ভাইকে নিয়ে যেতে। গত কয়েক বছরে একে একে চিরতরে চলে গেছে কাছের মানুষ। বাবা, মা, স্বামী, শাশুড়ি। অসীম ধৈর্য নিয়ে জীবনের সঙ্গে লড়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। পাশে সাহস হয়ে ছিল একমাত্র সন্তান জয়িতা। যে নিজেও একজন সংগীতশিল্পী। ছিল জয়িতার স্বামী মোস্তাফিজ। আরও ছিল কয়েকজন কাছের আত্মীয়।

অনেক দিন ধরেই ও কিছু শারীরিক সমস্যায় ভুগছিল। চিকিৎসা চলছিল নিয়মিত। তবে ও একটু ভেঙে পড়ছিল, টের পেতাম। মাসখানেক আগে আমাদের বন্ধু টুটুলসহ আমি আর শাহীন গিয়েছিলাম ওদের কেরানিগঞ্জের অসাধারণ সুন্দর বাড়িটিতে।

গাছপালাঘেরা, বাড়ির পাশে খাল, ছাদে উঠলে দেখা যায় দিগন্তবিস্তৃত খেত—সব মিলিয়ে অপার্থিব সৌন্দর্য। শহরের গা–ঘেঁষা, অথচ শহর নয়, নেই শহরের ভিড়ভাট্টা, কোলাহল। একটা শান্তির জীবনযাপন। ওই শান্তির নীড়ে ও মনে হয় শান্তিতেই ছিল।
শুঁটকি পছন্দ করত বলে ওর কথা ভেবে একটু যেন বেশিই যত্ন করে রান্না করে নিয়ে গেলাম। লক্ষ করলাম, খাওয়ার প্রতি তেমন আর আগ্রহ নেই। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত এত বেশি নিষেধের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল যে বোধ হয় কিছুটা ক্লান্তও হয়ে পড়েছিল। তাই বলে এত তাড়াতাড়ি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবে ভাবিনি।

করোনা কতজনকে কেড়ে নিল, এখন আর হিসাব রাখতে পারি না। জয়িতাকে কী বলব! এই শোকের কোনো সান্ত্বনা হয় না। জয়িতার বাবার মৃত্যুর পর মা-মেয়ের সংসার চলছিল সংসারের নিয়মে। হাসি-কান্নায় জড়াজড়ি করে। সে সংসারে আবার নেমে এল বেদনার মেঘ। আমরা সবাই আদর নিয়ে বসে আছি অসাধারণ মানবিক, মেধাবী প্রিয় জয়িতার জন্য। তবু মায়ের আদরের মতো কি কিছু হয়! আর সে আদর যদি হয় মিতা হকের মতো হৃদয়বান ও প্রাণবান একজন মানুষের, যে প্রেম শুধু নিতে নয়, দিতেও জানত অফুরান!

এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মিতা হক বলেছিল, ‘আমি স্বপ্ন দেখি ভালোবাসামুখর এক পৃথিবী, যেখানে মানুষ ভীষণভাবে মানুষকে ভালোবাসবে। মানুষের দ্বারা অন্য কোনো মানুষের অনিষ্ট হবে না।’ বলেছিল, ‘একা বেঁচে সুখ নেই। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হয়।’ সারা জীবন সেটারই চর্চা করে গেছে মিতা। তার গানের প্রতিষ্ঠান ‘সুরতীর্থ’ ছিল তার স্বপ্নের তীর্থস্থান। শিক্ষার্থীরা এখানে এসে নিজের ঘরে বসে গান শেখার আরাম পেত। এতটাই আন্তরিক ছিল সুরতীর্থের পরিবেশ। সফল সংগঠক মিতা হকের বাঙালি সংস্কৃতি ও অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য লড়াই ছিল প্রতিদিনের।

রাষ্ট্রীয় সম্মাননা হিসেবে মিতা পেয়েছে একুশে পদক, শিল্পকলা একাডেমির রবীন্দ্র পুরস্কার, ঢাকা ও কলকাতা থেকে বেরিয়েছে তার অনেক ক্যাসেট, সিডি, যেখানেই বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা আছে, সেখানে ওর গানও আছে—এসব খবর সবাই হয়তো জানে। যেটা অনেকেই হয়তো জানে না, সেটা হচ্ছে মিতা হক ছিল একেবারেই সহজ-সুন্দর অথচ তীক্ষ্ণ মেধার এক উজ্জ্বল নারী। যে আপসহীন, অদম্য ও দেশপ্রেমিক।
মিতা হকের কণ্ঠে গীত স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলোতে যেন সেই মিতা হককেই দেখতে পাই।

‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না’
‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’
‘আমি ভয় করব না ভয় করব না’
‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’
মিতা হকের গান গাওয়ার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল— একেবারে নিমগ্ন হয়ে, খাতার দিকে না তাকিয়ে গাওয়া। ধ্যানমগ্ন হয়ে গাইলে শ্রোতার চিত্তও কতটা নিবিষ্ট হয়ে ওঠে, ও জানত। গান মরমে পৌঁছানোর সব রকম জাদুবিদ্যা মিতা হকের জানা ছিল।
ওকে ভোলা কঠিন।