আপনি কি সৈয়দ শামসুল হক?

সৈয়দ শামসুল হক
ছবি: অন্য আলো
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণবার্ষকি আজ। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন নব্বইয়ের দশকের এক কবি।

মাঝেমধ্যেই এমন হচ্ছিল যে সৈয়দ শামসুল হকের শরীর খারাপ হচ্ছে, স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়াও সাময়িকভাবে প্রায় বন্ধ; এতে শরীর আরও খারাপের দিকে যাবে, এমনটাই জানতেন তাঁর স্ত্রী ও লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক। লেখক হলেও আনোয়ারা সৈয়দ হক একজন ডাক্তার, মনোবিদ্যা নিয়ে কাজ করেন। তখনো কিন্তু প্রকাশ হয়নি যে সৈয়দ শামসুল হক সদ্য আশি পার করা শরীরে ক্যানসার বহন করছেন। তো এ রকম খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ অবস্থায় হয়তো আনোয়ারা সৈয়দ হক ফোন করে আমাকে জানালেন, ‘বাবু, তুমি কি একটু বাসায় আসতে পারবে?’

গুলশান-১-এর ৬ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িটাই ‘মঞ্জু বাড়ি’। এই বিশাল জায়গা নিয়ে বানানো বাড়ির বাসিন্দা তাঁরা দুজন সৈয়দ হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক। গিয়েই দেখি, হক সাহেব দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। শরীর যে খারাপ, খাওয়াদাওয়া করতে পারছেন না—সে ছাপ লক্ষণীয়। কিন্তু মানুষের মন এমন যে তাকে ঠিক পুরোপুরি ধরে ওঠা যায় না। গল্প শুরু হয়ে যায় সৈয়দ হকের সঙ্গে। কী নিয়ে গল্প?

প্রথমে হকের শরীর খারাপ প্রসঙ্গেই হয়তো দু-একপশলা কথাবার্তা। তারপর কথার যাত্রা কবিতার দিকে বাঁক নেয়, নেবেই। কথা বাঁক নেয় ছোটগল্পে, উপন্যাসে। কথা হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় তাঁর এপিক্যাল রচনা ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বা কথার বিস্তার তখন তাঁর কাব্যনাট্যে। আমাদের আলাপ জমে উঠেছে দেখে বাড়ির ভেতর থেকে গরম পরোটা–মাংস পাঠিয়ে দেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। এবং হক সাহেবের খাদ্যে রুচি ফেরে। তাঁর শরীরে তখন খাবার প্রয়োজনও। কথা চলতে থাকে। কথার তো কোনো শেষ নেই। এরপর কথা বাঁক নেয় চিত্রকলা-ভাস্কর্যে।

সৈয়দ হক কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার। সৈয়দ হক ভাস্কর, চিত্রশিল্পী। বাড়িতেই একটা গ্যালারি করে রেখেছেন, ‘মঞ্জু গ্যালারি’। কথা আর কথা থাকে না। কথা ছবি হয়ে ওঠে। কথা যায় চলচ্চিত্রে। সৈয়দ হক দুটি ছবি পরিচালনা করেছেন, অসংখ্য ছবির কাহিনি লিখেছেন, গীত রচনা করেছেন। তাঁর লেখা অনেক গান প্রবল জনপ্রিয় এখনো। যেমন ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস’। বহু গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, যেসব গানের গীতিকার সৈয়দ হক। এ দেশের চলচ্চিত্রের গুণী নির্মাতা জহির রায়হান ও আলমগীর কবির তাঁর বন্ধু। সুভাষ দত্ত তাঁর বন্ধু।

‘মার্জিনে মন্তব্য’, ‘কথা সামান্যই’, ‘গল্পের কলকব্জা’—কী অসাধারণ রচনা সৈয়দ হকের, যা তরুণ লেখকদের জন্য শিক্ষার উপকরণ হিসেবে কাজ করছে। যদিও সৈয়দ হক নিজেই সর্বদা ছিলেন একজন তরুণ লেখক, যিনি সব সময় তাঁর শিল্পচিন্তা ও এর আকার-প্রকার নিয়ে নিরীক্ষা করতেন। শিশুসাহিত্য করেছেন। শিল্পকলায় একজন মানুষ হিসেবে তিনি কী করেননি?

প্রশ্ন করাই যেতে পারে, সৈয়দ হক ব্যতীত রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে এত সমৃদ্ধি আর কে দিয়েছেন? কার নাম বলতে পারব আমরা? আমাদের কথা হয়, কথার মধ্যে তিনি খাবার গ্রহণে ইচ্ছুক হয়ে ওঠেন। এবং একটা সময় তুমুল হাস্যলাস্য একটা পরিস্থিতি উপস্থিত হয় মঞ্জু বাড়িতে। আনোয়ারা সৈয়দ হক খুশি হন, হয়তো আমাকে ফোন করে বাসায় নিয়ে যাওয়ার ফল মিলেছে। সৈয়দ হক তখন রীতিমতো সুস্থ বোধ করছেন। আমি চলে আসি। হক সাহেব এগিয়ে দেন তাঁর বাড়ির সামনের বিস্তৃত অঙ্গন পর্যন্ত। মাঝেমধ্যে হক সাহেব নিজেই ফোন করেন, ‘কী করছ, চলে আসো, কথা আছে।’ আজ সেসব কেবলই স্মৃতি। ঠিক আজকের এই দিনে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখ তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে কর্কট রোগের চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় চলে গেলেন। আর জন্মেছিলেন ২৭ ডিসেম্বর, কুড়িগ্রামে।

বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে পৃথিবীর নানান দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর বইয়ের ফ্ল্যাপের ‘লেখকের বসবাস’-এর জায়গায় লেখা থাকত, ‘ঢাকা-লন্ডন’। মেট্রিকুলেশনের আগে আগেই তিনি একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন ১৮–১৯ বছর বয়সে। কুড়িগ্রাম থেকে প্রথমে কলকাতা, কলকাতা থেকে মুম্বাই বা তখনকার বোম্বে। এক চলচ্চিত্র পরিচালকের চতুর্থ সহকারী ছিলেন। বোম্বের সে পরিচালকের লেখার খাতা-পেনসিল এগিয়ে দিতেন। তদানীন্তন পুরান ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ১৯৫২ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। দুই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার পর হক সাহেবের মনে হলো, গড় ছাত্রছাত্রীরা চাকরিবাকরির জন্যই অনার্স-মাস্টার্স করে। তিনি গড় নন। সৈয়দ হক লিখেছেন এ প্রসঙ্গে, ‘দুবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই বুঝলাম, এভাবে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলাম।’ বিশ্ববিদ্যালয় একটি ছাদ। বাইরে খোলা আকাশ। বাইরে উন্মুক্ত ব্রহ্মাণ্ড। বাইরে জীবন। সৈয়দ হক বেরিয়ে পড়লেন। আজ বাংলা সাহিত্য তাঁর সেই বেরিয়ে পড়ার কারণে এত সমৃদ্ধ। এই মতের সঙ্গে দ্বিমত করার সাহস দেখাবেন কেউ? কী হতো, একাডেমি থেকে বেরিয়ে রুটিরুজির বাইরে একটা বাড়ি বানাতেন, বিয়ে-সংসার করে নিজের বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য কিছু সম্পদ রেখে যেতেন।

কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে বললাম, ‘আচ্ছা, আপনি কি সৈয়দ শামসুল হক?’ তিনি হ্যাঁ–সূচকতার সঙ্গে মাথা নাড়ালেন এবং আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কী করো?’
বললাম, ‘এইখানে কলেজে পড়ছি। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। আমি প্রচুর পড়ি। আপনার লেখাও অনেক পড়া হয়ে গেছে। শুধু “খেলারাম খেলে যা”টা হাতে পাইনি এখনো।’

এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ছেলেমেয়েরা তাদের সব উন্নতিই শেষ পর্যন্ত তিন–চারজন মানুষের জন্য রেখে যায়, সেই তিন–চারজন বলতে তাদের বউ-বাচ্চাকাচ্চা। একাডেমিকে থোড়াই কেয়ার করা মানুষ নিজেকে রাখে আরও বেশি মানুষের কাছে। কখনো লাখো মানুষের চেয়েও বেশি মানুষের কাছে। সৈয়দ হক একাডেমির অধ্যাপককে বলতেন, ‘কেরানি’। সেই দাঢ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে।

বইমেলা, এফডিসি, বাংলা একাডেমির ভেতরে, কোনো পত্রিকার গোলটেবিল আলোচনা বা কবিতা পাঠের আসর, আর সি মজুমদার মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার হাকিম চত্বর, চারুকলায়, বিদেশি দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—বিশেষ করে কবিতা পাঠের আয়োজনে, রাজশাহী সার্কিট হাউস, ঢাকা ক্লাব, শামসুর রাহমানের বাড়িতে—ঠিক কত কত জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে আমার আড্ডা হয়েছে সৈয়দ হকের সঙ্গে; আজ আর সব মনে নেই। তবে একান্ত দ্বিপক্ষীয় বাতচিত বা বন্ধুত্ব হয়েছে তাঁর গুলশানের বৃন্দাবনে। কিন্তু কীভাবে আমাদের প্রথম দেখা হলো, সেই কথা বলে আসার দরকার আছে। তখন আমি ঝিনাইদহের কেশবচন্দ্র সরকারি কলেজের ছাত্র। কেসি কলেজ ক্যাম্পাসের ছবেদা গাছতলায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন দুনিয়ায় একটাই টেলিভিশন সেন্টার, সেটা বিটিভি। বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার আন্দোলনের শাখা সংগঠন ছিল সারা দেশেই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অঞ্চলের শাখা সংগঠন ‘ঝিনেদা থিয়েটার’। আমি তার নবীন সদস্য তখন। আর আমি এতই বইপোকা ছিলাম যে বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখকের ছবি দেখেও পরে সামনাসামনি দেখা হলে সেই লেখককে চিনে ফেলতাম। ফ্ল্যাপ ছাড়া তো আর লেখকের ছবি দেখাও যেত না তখনকার দিনে। তো কলেজের ছবেদা গাছতলায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। পাশেই পাঁচিল।

পাঁচিলের ওপারেই ঝিনেদা শহরের অন্যতম প্রধান সড়ক ‘অগ্নিবীণা সড়ক’ এবং এই ঝিনেদা শহরেরই আরেকটি প্রধান সড়ক ‘গীতাঞ্জলি সড়ক’। একটি ছোট্ট শহরের প্রধান দুটি সড়ক বাংলা ভাষার দুটি কাব্যগ্রন্থের নামে, এ রকম আর অন্য কোথাও দেখিনি। যাহোক, পাঁচিলের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, একটি রিকশা যাচ্ছে শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। সেই রিকশায় দুজন যাত্রী। একজনের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার মাথার উপরিতলে ঠিকঠাক চুল না থাকলেও কানের কাছে কলি বা জুলফি আছে বেশ।

সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

হঠাৎ মনে হলো, আরে, এই লোককে তো আমি চিনি, অনেক বই পড়েছি, বইয়ের ফ্ল্যাপে ছবি দেখেছি। ইয়েস, মনে হচ্ছে উনিই সৈয়দ শামসুল হক। কিন্তু রিকশায়, ঝিনেদায় কেন? চুয়াডাঙ্গা বাসট্যান্ডের দিকে কোথায় যাচ্ছেন? আমার বন্ধু হুমায়ুনের বাইসাইকেল ছিল। বললাম, ‘চল তো!’

ঝিনেদা শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসট্যান্ড মোড় চতুর্মুখী। পশ্চিমে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখ। দক্ষিণে যশোর অভিমুখ, একটি অভিমুখ শহরের ভেতরের দিকে, যে রাস্তা মাগুরা-ফরিদপুর-রাজবাড়ী হয়ে পদ্মার ফেরিঘাটে নিয়ে যায়, তারপর ঢাকা যাওয়া যায়। আর একটি অভিমুখ কুষ্টিয়ার দিকে। চারদিকেই ছোট ছোট টিকিট কাউন্টার-ঘর। কী কারণে যেন কুষ্টিয়া অভিমুখের কাউন্টার-ঘরগুলো আগে দেখা শুরু করি এবং দেখি যে একটি ঘরের মধ্যে বেঞ্চে বসে আছেন রিকশাযাত্রী সেই দুজন, যাঁদের একজনকে আমি তাঁর কানের কাছে বিরাট জুলফি দেখেই সৈয়দ শামসুল হক মনে করেছি। ফরিদ কবির সম্পাদিত দুটি কবিতার সংকলনে ঢাকা ও কলকাতার বড় ও বিখ্যাত কবিদের ছবিও দেখেছিলাম। সৈয়দ শামসুল হককে সৈয়দ হক মনে করার একটা সূত্র বা সোর্স ফরিদ কবিরের সেই সংকলনের দেখা ছবিও বটে। কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে বললাম, ‘আচ্ছা, আপনি কি সৈয়দ শামসুল হক?’ তিনি হ্যাঁ–সূচকতার সঙ্গে মাথা নাড়ালেন এবং আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কী করো?’

বললাম, ‘এইখানে কলেজে পড়ছি। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। আমি প্রচুর পড়ি। আপনার লেখাও অনেক পড়া হয়ে গেছে। শুধু “খেলারাম খেলে যা”টা হাতে পাইনি এখনো।’

সৈয়দ শামসুল হক তাঁর পাশে থাকা লোকটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘একে চেনো?’
বলি, ‘না। ওনার নাম কি?’
হক বললেন, ‘সেলিম আল দীন। পড়েছ?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনাকেও তো চিনি। আমাদের ঝিনেদা থিয়েটার তো এখন “বাসন”-এর রিহার্সাল চলছে। আপনারা যাচ্ছেন কোথায়?’

হক সাহেব বললেন, ‘কুষ্টিয়ায়। আগামীকাল গ্রাম থিয়েটারের জাতীয় সম্মেলন হবে ওখানে।’

সেলিম আল দীন বললেন, ‘ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার? সেকেন্ড ইয়ার শেষ করে জাহাঙ্গীরনগর চলে আয়?’
‘ওখানে কী করব?’

সেলিম আল দীন বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বি। তোকে ভর্তি করে নেব।’
সৈয়দ শামসুল হক ও সেলিম আল দীন বাসে উঠে পড়লেন, কুষ্টিয়ার দিকে যাত্রা করল গাড়ি। আমরা দুজন বাইসাইকেলে চড়ে আবার কলেজের দিকে গেলাম। যেতে যেতে আমি ভাবছিলাম, সত্যিই একটু আগে আমার সঙ্গে সেলিম আল দীন আর সৈয়দ শামসুল হকের দেখা হইছে? আলাপ হইছে? এ কথা একদিন হক সাহেবকে বলামাত্রই তিনি বললেন, ‘এটা কি কোথাও লিখেছ?’
বললাম, ‘না।’
হক বললেন, ‘লেখো লেখো। লিখলেই থেকে যায়।’

প্রিয় হক, লিখে দিলাম আমাদের প্রথম সামনাসামনি দেখা হওয়ার স্মৃতিভাষ্য। আপনি আর পড়বেন না এটা। একটা কথা কি জানেন, সব সময় খুব মিস করি আপনাকে।

অন্য আলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]