মণিপুরি থিয়েটারের রজতজয়ন্তী
আমাদের যুগল পঁচিশ
আজ মণিপুরি থিয়েটারের রজতজয়ন্তী। মফস্বলের এই নাট্যদল নিজ যোগ্যতাবলেই দর্শকদের মনোযোগ পেয়েছে। আজ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ২৫ বছরে দাঁড়িয়ে এই নাট্যদলের গড়ে ওঠার গল্প বলেছেন সংগঠনের প্রাণপুরুষ শুভাশিস সিনহা।
নাটক ব্যাপারটা জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে যাবে, আমি কখনো ভাবিনি। কবিতার চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়ব মরণশীতকালে—সেটুকুই ছিল ইচ্ছা। তা আর হয়নি।
আমাদের ঘোড়ামারা গ্রামের সেই বড় রাস্তার ব্রিজে বসে কয়েকজন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ যখন একটি নাটক করার কথা ভেবেছিলাম, তখন ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি, সেই নাটক করাটা আমাদের জীবনে নিয়মিত একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের সমাজে চারপাশে কৃত্যমূলক অনুষ্ঠান আর নানা পারফরম্যান্স দেখতে দেখতে একসময় নতুন কিছু একটা করার তাগিদ নিয়েই ‘মেঘ-বৃষ্টি-রোদ’ নামের নাটকটি করার সিদ্ধান্ত নিই।
মনে পড়ে ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মোমবাতি জ্বালিয়ে গ্রামের এক বন্ধুর বাড়িতে আমরা সেই নাটকের মহড়া শুরু করেছিলাম। নাটকটি ছিল আমারই লেখা। বলা যায় কাঁচা হাতের লেখা। তবে বিষয়বস্তু ছিল ঝাঁজালো। দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, দেশদ্রোহিতা, শাসন-শোষণ, প্রথাভাঙার ডাক—এসব। আর সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম কোনো নাটকের নির্দেশনা। সে হিসেবে এই ২৬ সেপ্টেম্বর মণিপুরি থিয়েটারের যেমন রজতজয়ন্তী, আমার নির্দেশনার ২৫, এমনকি আমার এই নাট্যজীবনেরও।
আমি আর মণিপুরি থিয়েটার বলতে গেলে যমজ। গলায় গলায় চলেছি ২৫টি বছর। কোনোরূপ দূরত্ব কখনোই অনুভব করিনি। মনে হয়, আমি আছি মানে মণিপুরি থিয়েটারও আছে বা মণিপুরি থিয়েটার আছে মানে আমি আছি। এই একই উপলব্ধি এ দলের অনেকেরই, যাঁরা এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কোনো না কোনোভাবে আছেন। কাজ করে চলেছেন।
কমিউনিটি থিয়েটার বলে একটা ব্যাপার আছে। এর মানেটা হলো কোনো একটা কমিউনিটি বা লোকালিটির ভেতর থেকে গড়ে ওঠা থিয়েটার। মণিপুরি থিয়েটারটা আসলে তা-ই। সে কারণেই হয়তো এর সদস্য কতজন, আমরা এখনো তা নিশ্চিত হতে পারি না। যখন হাতের কাছে নানা সমস্যায় অনেককেই পাওয়া যায় না, তখন মনে হয়, কেউ নেই; কখনো-বা গ্রামের একটা সাধারণ লোকও এসে যখন উৎসবমঞ্চ তৈরির কাজে লেগে যায়, তখন মনে হয় অগুনতি। যারা ছিল, এখন দূরে চলে গেছে, তাদের অনুভবের একটা ফোনকল বা এসে দেখা করে যাওয়াটাও মনে করিয়ে দেয়, সে এখনো এই থিয়েটারেরই। নতুন কোনো নাটকের জন্য পারফরমার খুঁজতে গিয়ে যখন আশপাশের বা দূরগ্রামের সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে আসি, তখন অনুভব করি, এই টান বা অধিকারবোধের জায়গাটা। যখন শো–টো হয় না, অনুষ্ঠান হয় না দীর্ঘদিন, তখন গ্রামের এক বৃদ্ধা যখন রাস্তায় জিগ্যেস করেন, ‘এবার যে একেবারে থেমে গেলে, তোমরা কিছু না করলে ভালো লাগে না।’ তখন মনে হয়, সে–ও দলেরই একজন। এই অনুভবই কমিউনিটি থিয়েটারের শক্তি আর সূত্র।
আমরা নিত্যসন্ধ্যায় চা খেতে বসে অন্যান্য আলাপের মধ্যেই থিয়েটারের কথা বলি, পরিকল্পনা করি, পথ চলতে চলতে, কোনো এক অনুষ্ঠানে একের সঙ্গে অন্যের দেখা হয়ে গেলে নানা আলাপের মধ্যে আমাদের ভাবনার সঞ্চারণ চলে। খুব একটা আয়োজন করে বসতে হয় না। কবে কে দুইটা নাটক করে চলে গেছে, আর হয়তো সেভাবে আসতেও পারেনি দলের কাজে, সে–ও আজীবন দলেরই একজন হয়ে থাকে অনুভবের জোরে, তারও কোনো না কোনো কৃত্যে দুঃখ–কষ্টে গিয়ে আমরা যুক্ত হই, শুধু সে তো নয়, তার পুরো পরিবারটাই দলের আত্মীয়।
কমিউনিটি থিয়েটার বলে একটা ব্যাপার আছে। এর মানেটা হলো কোনো একটা কমিউনিটি বা লোকালিটির ভেতর থেকে গড়ে ওঠা থিয়েটার। মণিপুরি থিয়েটারটা আসলে তা-ই। সে কারণেই হয়তো এর সদস্য কতজন, আমরা এখনো তা নিশ্চিত হতে পারি না। যখন হাতের কাছে নানা সমস্যায় অনেককেই পাওয়া যায় না, তখন মনে হয় কেউ নেই, কখনো-বা গ্রামের একটা সাধারণ লোকও এসে যখন উৎসবমঞ্চ তৈরির কাজে লেগে যায়, তখন মনে হয় অগুনতি।
কিন্তু তাই বলে এই কমিউনিটির যৌথ অনুভব নিয়ে খুব আরামে–আয়েশে যে এ থিয়েটার করে যাবে, তা কিন্তু নয়। কারণ, কমিউনিটির অন্য বাস্তবতাও কিন্তু আছে। তারা জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত, তারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই করছে, নিজের বস্তুগত জীবনমান উত্তরণের চেষ্টা চালাচ্ছে, তারা বহির্মুখী হচ্ছে, জীবিকার জন্য দূরে চলে যাচ্ছে, তাদের বিয়ে হচ্ছে, বিয়ের পর মেয়েরা নাটক–থিয়েটার আর করে না। এসবও এই রুরাল কমিউনিটিরই সামাজিক বাস্তবতা।...আর থিয়েটার করার জন্য পয়সা দরকার। পয়সাটা এখানে নেই। একদমই নেই।
তবু নানা আনন্দ-গঞ্জনার মধ্যে ঘেমে-নেয়ে-অশ্রুতে ৩০–৩৫টি নাটকের মঞ্চায়ন হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, ও’হেনরি, অনুকূল, ব্রজেন্দ্রকুমার, স্মৃতিকুমার, বিমল, কোউতো, বেকেট... যখন যাকে আপন মনে হয়েছে, তাকে ডেকে নিয়ে এসে তৈরি করতে চেয়েছি মঞ্চের শিল্পপ্রসাদ। রবীন্দ্রনাথের ওই যে কথা, ‘প্রাচ্যদেশের ক্রিয়া-কর্ম-খেলা-আনন্দ সমস্ত সরল-সহজ। কলার পাতায় আমাদের ভোজ সম্পন্ন হয় বলিয়া ভোজের যাহা প্রকৃততম আনন্দ, অর্থাৎ বিশ্বকে অবারিতভাবে নিজের ঘরটুকুর মধ্যে আমন্ত্রণ করিয়া আনা সম্ভবপর হয়।’ সেই সহজতার শক্তিতেই রচনা করেছি এই শিল্পের আত্মীয়তা। তাই বড় জ্ঞানবুদ্ধির নাট্যজনেরা সার্টিফাই করার আগে গ্রামের সাধারণ লোকজনের প্রতিক্রিয়া জানাটাই আমাদের পয়লা বাঞ্ছা। তারা বলে, ‘নুন কম, ঝাল বেশি বা টক নাই...’ আমরা ভাবি।
কিন্তু এটা বড় আনন্দের, গ্রামের জল-কাদার মাঝখানে বেড়ে ওঠা গাছটার পুষ্পমুকুরগুলো আমরা বিছিয়ে দিয়ে এসেছি নগরের নাট্যগৃহে। তারাও বলছে, এ সুবাস অন্য রকম!
ওই অন্য রকমের জন্য ২৫ বছর পার করেছি আমি আর মণিপুরি থিয়েটার।
আমি আর মণিপুরি থিয়েটার মোহাম্মদ রফিকের কবিতার ভাষায়, একই দেহে পরস্পর বেড়ে উঠেছি আমরা। আমার নাট্যভাবনার আজ অবধি একমাত্র প্রয়োগক্ষেত্র বলা যায় এই থিয়েটারের ভূমি। কবিতায়, আখ্যানে, যেকোনো লেখায় আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে প্রান্তিক যে হৃদয়, তারই ভেতরে অনুরণন তোলা আমার আরাধ্য, সেই আরাধনা থিয়েটারেও। ফলে কবিতার সঙ্গে এই থিয়েটারের, এই নির্দেশনাকাজের কোনো ভেদ আমাতে নেই। কিন্তু জীবন্ত শরীরের ক্রিয়াকলাপে, স্বরে ও অভিব্যক্তিতে তাকে লোকের ভিড়ে ধারণ করা, প্রকাশ করা কঠিনতম বটে। সেই কঠিনতম কাজে যাঁরা আমার সঙ্গে পথ হেঁটেছেন, তাঁরাও গোঁয়ার কিংবা সাধক। ২৫ বছরের পথ চলায় আজ অবধি টিকে থাকায় ভক্তিতে ও সদর্পে প্রধানতমা জ্যোতি। জ্যোতি সিনহা। আমার, মণিপুরি থিয়েটারের নাট্যভাষার প্রায়োগিক পূর্ণতার এক নির্বিকল্প প্রতীক সে।
তারও অভিনয়দীপ্তিতে অন্যতর রেখা খচিত এই নাট্যপথরেখায়। আর এ নাট্যের নেপথ্যে সংগীতের সুরলহরি যে প্রাণের আবেগের স্রোতস্বিনী তৈরি করে দেয়, তিনি শর্মিলা সহোদরা। আর সেই বিধান কি বাবুচান, যাদের বাদ্যের বোল জুগিয়ে চলেছে হৃৎস্পন্দনের সমতুল এক সুষম নাট্যপ্রতিবেশ। আরও যাঁরা দীর্ঘ এ পথে যুক্ত আছেন দীর্ঘকাল, তাঁরাও অংশ এই সুকঠিন নাট্যযাত্রার—শুক্লা, স্বর্ণালী, অঞ্জনা, অরুণা, শ্যামলী, সুজলা, অনামিকা, সুশান্ত, উজ্জ্বল, বিধান, সজল, সুব্রত, সুনীল, সমরজিৎ, অঞ্জন, সুমন, সুশীল, সত্যজিৎ... আর দূরের হয়েও যাঁরা কর্মে–সৃজনে এসে নিকটাত্মীয়—পাভেল, শাহনাজ, রেওয়াজ, আসলাম, অপু, সম্রাট, সউদ, পারভেজ, শাকিল, হাসান, আশিক, প্রসেনজিৎ, শাহজাহান...আরও কত তরুণ প্রাণময় শিল্পী, কারিগর, বন্ধু, স্বজন। আর ছিল আমার পরিবার, সমাজ। সবার প্রেমে–ঘামে–অশ্রুতে ২৫ বছরের এ ফসল কালের সোনার তরিতে হয়তো-বা যাবে কালান্তর।
খুব বড় কিছু নয়, সমাজকে নাড়িয়ে দেবে, বদলে দেবে—এমন শক্তিধর কিছু নয়, সে চাওয়া আমাদের ছিলও না কখনো। হই-হট্টগোল আর চিৎকারে কোথাও আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্তরের নীরব আকুতি, তারই এক সুচারু উৎসার—এই ছিল আমাদের শিল্পের মর্ম।
আজ ওই বিশাল মাঠের মধ্যখানে নটমণ্ডপের সামনে দাঁড়ালে সে সসব মর্মচোরা ফসলের গন্ধ ভেসে আসে বুঝি।
বাংলার শিল্পের হেমন্তে যেন সে–ও নবান্নের উপচার হয়, সেটুকু আকাঙক্ষা।