আমাদের সেই নিউ কলোনির মিতা আপা
গতকাল মারা গেলেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এ শিল্পীর শৈশব-কৈশরের দিনগুলোর কথা লিখেছেন তাঁর অনুজ সহচর শাহানা হুদা।
কলকণ্ঠ খেলাঘর আসর ছিল আমাদের শৈশবের ভালোবাসা ও আনন্দের উৎস। আজকে আমাদের অনেকের জীবনে সামাজিকীকরণের যে ভিত, সেটাও তৈরি হয়েছিল এই খেলাঘরেই। আসাদগেট নিউ কলোনিতে কলকণ্ঠ খেলাঘরের মাধ্যমেই আমাদের শৈশব-কৈশোরে আনন্দের ঢেউ এসে লেগেছিল।
সবাই নিজেদের সৃজনশীলতা দেখানোর সুযোগ পেয়েছিলাম এখানে এসেই। বিতর্ক, বক্তৃতা, নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, দেয়ালপত্রিকা তৈরি করা, ধাঁধার আয়োজন করা—সবকিছু এখানে এসেই শিখেছিলাম। আর আমাদের সেই কলকণ্ঠ আসরের মধ্যমণি ছিলেন মিতা আপা (মিতা হক)। তখন তাঁর বয়স ছিল সম্ভবত ১২ বা ১৪ বছর।
মিতা আপা ছিলেন আমাদের ছোটবেলার আইডল। আসাদগেট নিউ কলোনিতে মিতা আপারা থাকতেন ৯ / ৯ নম্বর বিল্ডিংয়ে। তখন থেকেই মিতা আপা গান গাইতেন। কলোনির সব অনুষ্ঠান—যেমন: একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মিতা আপাকে আমরা পেয়েছিলাম গাইড হিসেবে। শুধু কি গান গাওয়া, নাটক, কবিতা আবৃত্তি—সবকিছুতেই তিনি আমাদের ভরসা।
সেই সময়টাতে, মানে ১৯৭৪–৭৫ সাল থেকে পরের দিনগুলোতে আমাদের সময় কেটেছে মিলেমিশে একত্রে। তখন ছেলে আর মেয়েরা আলাদা আলাদা খেলত না বা আলাদা করে অনুষ্ঠানও করত না। তখন নিউ কলোনির ছোটদের যে পিকনিক বা বনভোজন হতো গ্রিন হেরাল্ড স্কুলের পাশের ফাঁকা মাঠটিতে, সেখানেও মিতা আপাকে পেয়েছি আমরা। সবার বাসা থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের চাল, ডাল, আলু আর ডিম নিয়ে হতো সেই পিকনিক। ছোট আয়োজন। কিন্তু আমাদের আনন্দ ছিল গলা অবধি। মিতা আপা, মুনা আপা, শাহেদা আপারা আমাদের সঙ্গে থাকতেন অভিভাবকের মতো।
১৯৭৪ সালে যখন প্রলয়ংকরী বন্যা হলো, তখন কলোনির বড় ভাইবোনদের উদ্যোগে আমরা ঠেলাগাড়িতে চড়ে হারমোনিয়মে গান বাজিয়ে দ্বারে দ্বারে ত্রাণ ভিক্ষা করেছি। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমরা, দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য কয়েক দিন ধরে দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছি। আর সেই গানের দলে আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন মিতা আপা। ‘সর্বগ্রাসী বন্যারে, তোর নেইকো কোনো মায়া, করাল গ্রাসে গ্রাসে গেল বাংলা মায়ের কায়া।’ সে সময় এই গান গেয়েছিলাম আমরা।
রাতে কলোনিতে যখন বিদ্যুৎ চলে যেত, আমরা সবাই দল বেঁধে নেমে পড়তাম কলোনির মাঠে। আমাদের জন্য সে সময়টা ছিল অফুরান আনন্দের। মিতা আপা অনেক দিনই খোলা মাঠে বসে আমাদের গান শোনাতেন। আমরা অবাক হয়ে শুনতাম আর ভাবতাম, এত মিষ্টি গানের গলা কীভাবে হয় মানুষের!
মিতা আপাদের পরিবার ছিল খুব সংস্কৃতিমনা ও শিক্ষিত। প্রসিদ্ধ সব মানুষের সঙ্গে ছিল সেই পরিবারের ওঠাবসা। রবীন্দ্রসংগীতের গুরু, জ্ঞানতাপস ওয়াহিদুল হক ছিলেন তাঁর বড় চাচা। বড় বড় নামকরা মানুষ তখন ওই বাসায় আসতেন। তাঁদের উচ্চতা ঠাওর বা পরিমাপ করার ক্ষমতা সে সময় আমাদের ছিল না। ওয়াহিদুল হক সাহেব এতটাই রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন যে কলোনির ছেলেপেলেরা তাঁকে মজা করে ডাকত ‘ওয়াহিন্দ্রনাথ ঠাকুর’, মানে রবীন্দ্রনাথের ছোট ভাই। এর জন্য ওরা মিতা আপার হাতে পিট্টিও খেয়েছে। তাঁদের বাসায় হারমোনিয়ামসহ সেতার, তানপুরা, ঢোলসহ আরও বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র ছিল। মিতা আপা সেগুলো নিয়ে গান গাইতেন।
১৯৭৪ সালে যখন প্রলয়ংকরী বন্যা হলো, তখন কলোনির বড় ভাইবোনদের উদ্যোগে আমরা ঠেলাগাড়িতে চড়ে হারমোনিয়মে গান বাজিয়ে দ্বারে দ্বারে ত্রাণ ভিক্ষা করেছি। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমরা, দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য কয়েক দিন ধরে দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবধি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছি। আর সেই গানের দলে আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন মিতা আপা। ‘সর্বগ্রাসী বন্যারে, তোর নেইকো কোনো মায়া, করাল গ্রাসে, গ্রাসে গেল বাংলা মায়ের কায়া।’ সে সময় এই গান গেয়েছিলাম আমরা। আজ এই সময়ে এসে মনে হয়, কী আদর্শ, কী অমলিন বন্ধনই না ছিল আমাদের! বাবা-মায়েরা আমাদের বাধা দেওয়ার বদলে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন তখন।
এখনো মনে আছে, অনেকগুলো খেলাঘর আসরের ছোট ছোট সদস্যের মধ্যে প্রতিযোগিতার পর মিতা আপা আমাদের খেলাঘর থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন ফেস্টিভ্যালে অংশ নেওয়ার জন্য। মিতা আপা যেদিন যাবেন, সেদিন বাস ভর্তি করে আমরা বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম তাঁকে বিদায় জানাতে। সে ছিল এক বড় পাওয়া আমাদের কলকণ্ঠ খেলাঘর আসরের জন্য। এরপর থেকে আমরা গলা উঁচু করে বলতাম, আমরা মিতা আপার খেলাঘরের সদস্য।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে গলায় গামছা ঝুলিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কলোনির ছোট শিশুরা বড় ভাইবোনদের নেতৃত্বে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গান গাইতে গাইতে পৌঁছে যেতাম শহীদ–স্বপ্নের কাছাকাছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আসার আগেই গানগুলো ঝালিয়ে নিতাম মিতা আপার কাছে। সবাই দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে যেতাম আসাদগেট থেকে আজিমপুর কবরস্থান হয়ে শহীদ মিনারে। আহা আমাদের সেই দিনগুলো!
ছোটবেলায় মিতা আপা দেখতে ছিলেন খুব সাধারণ। তাঁর একটি তিল ছিল ঠোঁটের ওপরে, যা আপার হাসিটিকে অতুলনীয় মিষ্টি করে তুলেছিল। এমন তিল তাঁর মায়েরও ছিল। মিতা আপার গুণ ছিল তাঁর অসাধারণ গানের গলা। সেই গুণ দিয়ে তিনি অর্জন করেছিলেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পুরস্কার।
মিতা হক নেই, এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা ফোন ধরছি সেসব মানুষের, যারা একদিন আসাদগেট নিউ কলোনিতে মিতা আপার সঙ্গে গান গেয়েছে, খেলেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে, খেলাঘর করেছে। কত স্মৃতি, কত কথা। শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় কত স্মৃতি মনে পড়ছে!
মিতা আপার বয়স যখন ১২ বছর, তখন জন্ম হলো রাজনের। রাজন ছিল বিশেষ ধরনের শিশু। আমরা তখন এত কিছু বুঝতাম না, শুধু জানতাম বাচ্চাটা সাধারণ নয়, একটু অন্য রকম। মিতা আপা কিন্তু রাজনকে কখনোই ছেড়ে থাকেনি। বড় হওয়ার পর যখন মিতা আপারা কলোনি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে চলে গেলেন, তখন থেকে ফোনেই যোগাযোগ ছিল। মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। যখনই ফোন করেছি, মিতা আপা রিসিভ করেছেন। অসুখ তাঁকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি। আমি এযাবৎকালে মিতা আপাকে কখনো হাসি ছাড়া দেখিনি। জীবনের কঠিন সময়েও তাঁর মুখে হাসি ছিল অমলিন।
২০১৯ সালে ফোন করে বলেছিলাম, মিতা আপা, আমার নাতনি নয়নতারাকে কিন্তু নালন্দায় ভর্তি করাতে হবে। এমনকি লটারিতে নাম না উঠলেও। মিতা আপা মৃদু বকা দিয়ে বললেন, ‘তোরা যে কী কস না, লটারিতে নাম না উঠলে কীভাবে কী হবে।’ তারপর নিজেই বললেন, ‘আমারে মনে করাইয়া দিস, তোর নাতনি মানে তো আমারও নাতনি।’ বললেন, ‘আমার নিউকলোনির ভাইবোনদের জন্য অদেয় কিছু নেই।’
আমি শুধু ভাবছি, মিতা আপার রাজনের কথা, যে ভাইটিকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মিতা আপা ভালোবাসা, যত্ন আর আবেগে আগলে রেখেছিলেন, সেই রাজন কি বুঝতে পারছে যে সে আশ্রয় হারিয়েছে?