আষাঢ়ে কিন্তু অসার নয়
সিরাজ মামা সব সময়ই মজার মজার গল্প করতেন আর আমরা ছোটরা সেসব মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মামার প্রতিটি গল্পের প্রতিটি অবিশ্বাস্য বাঁকে আমার অশীতিপর বিধবা ফুফু মাথা নেড়ে সায় দিতেন, যেন এর মধ্যে চুল পরিমাণও সন্দেহের অবকাশ নেই। আমাদের ছোট্ট মনে যেটুকু সংশয় দেখা দিত, ফুফুর এমন আচরণে তা পুরোপুরি দূর হয়ে যেত।
সিরাজ মামা থাকতেন নদীর ওপারে, কেরানীগঞ্জে। তখন কেরানীগঞ্জ বলতে গেলে পুরোপুরি গ্রাম। আমরা পুরান ঢাকার লোকেরা জায়গাটাকে ‘হেপার’ বলতাম। প্রতিদিন নদী পার হয়ে কর্মক্ষেত্রে আসতেন আমাদের হেপাইরা মামা। দুপুরে আমাদের বাড়িতেই খেতেন তিনি, খেতে খেতে গল্প বলতেন। প্রতিদিন যাওয়া–আসার সময় মামা অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেতেন, তাই তার গল্পের ভান্ডার ফুরাত না; বিশেষ করে আমাদের মহল্লায় ঢাকা শহরের প্রথম সুপেয় পানির যে ট্যাংকটা আছে, সেই কলতাবাজারের পানির ট্যাংকের সামনে দিয়ে রাতবিরাতে আসা-যাওয়ার সময় কখনো–সখনো তার সঙ্গে গলাকাটা সৈয়দ সাহেবেরও দেখা হয়ে যেত। আর মুণ্ডুবিহীন সৈয়দ সাহেবকে দেখামাত্রই আদবের সঙ্গে সালাম দিতে ভুল করতেন না মামা। না দিলে যে বিরাট বড় ক্ষতি হয়ে যাবে! মুণ্ডুবিহীন এক কামেল লোক সব সময় পানির ট্যাংকের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন; যেহেতু মাথা নেই, তাই তিনি টুঁ শব্দটিও করেন না—এমন গল্প আমাদের খুব একটা পছন্দ ছিল না। শুধু সৈয়দ সাহেবের মুণ্ডুবিহীন অবয়বটা কল্পনা করে ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে যেত। মনে মনে একটাই প্রার্থনা করতাম, খোদানাখাস্তা কখনো যদি গলাকাটা সৈয়দের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, আদবের সঙ্গে সালাম দিতে যেন ভুলে না যাই।
সত্যি বলতে, আমাদের পছন্দ ছিল অন্য গল্পগুলো। যেমন বেশি রাত করে জিঞ্জিরার খাল পার হবার সময় বিশালাকৃতির দৈত্য দেখা আর সেই দৈত্যের হাত থেকে খুব সহজেই একটা দোয়া-দরুদ পড়ে মুক্তি পাওয়ার মতো অকল্পনীয় কাহিনিগুলো।
প্রতিদিন যেহেতু নদী পার হতেন, তাই সিরাজ মামার গল্পে প্রায়ই ঘুরেফিরে আসত কালে খাঁ জমজমের ভেসে ওঠার গল্পটি! ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও কালো রঙের অবয়বটি কীভাবে দেখতে পেতেন, সেটা নিয়ে অবশ্য কারও মনে সন্দেহ জাগত না।
দৈত্যাকৃতির কালে খাঁ আর তার বেগম একসময় বুড়িগঙ্গার তীরেই বসবাস করত। নদীর পাড় ভাঙনের ফলে বিশালাকৃতির কালে খাঁ জমজম নদীর গর্ভে হারিয়ে যায়। এরপর থেকে সোয়ারীঘাটে অপেক্ষা করত বিধবা বিবি মরিয়ম। আর কালেভদ্রে কালে খাঁ–ও নদী থেকে ভেসে উঠে প্রিয়তমার সঙ্গে একটু দেখা করে আবার ডুব দিত। কিন্তু বিবি মরিয়মের কপালে দুঃখ নেমে আসে অচিরেই। পাষণ্ড কেউ তাকে বাস্তচ্যুত করে চকের ঘিঞ্জি রাস্তায় নিয়ে যায়। অনেক বছর বাদে যখন সদরঘাটের নৌবন্দরের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আবার কালে খাঁ মাঝেমধ্যে ভেসে উঠতে শুরু করে পানির নিচ থেকে। এই সুখও বেশি দিন কপালে সইল না বিবি মরিয়মের। কার বুদ্ধিতে জানি সেখান থেকেও তাকে সরিয়ে দিয়ে গুলিস্তানের কোলাহলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় ঢাকায় আসা লোকজন তাকে আগ্রহভরে দেখত, আর অভাগা কালে খাঁ জমজম মাঝেমধ্যে পানির নিচ থেকে উঠে খুঁজে বেড়াত প্রিয়তমা স্ত্রীকে। না পেয়ে হতাশ হয়ে আবার ডুব দিত বুড়িগঙ্গায়। তার এই ভেসে ওঠা আর ডুব দেওয়াটা দুই পাড়ের অনেকেই দেখেছে নিজের চোখে, আমাদের সিরাজ মামা তাদেরই একজন। আমরা ছোটরা এই গল্প শুনে আগ্রহী হয়ে উঠলাম, কালে খাঁ জমজমকে দেখব।
মামা হেসে বললেন, চাইলেই কি সেটা সম্ভব? কবে, কখন কালে খাঁ ভেসে উঠবে, কেউ তা জানে না। আমাদের বিধবা-বয়স্ক ফুফু তখন মুখে পান চিবোতে চিবোতে সায় দিতেন। বাস্তবতাটা আমরাও বুঝতে পারতাম বলে নতুন আবদার করলাম, কালে খাঁকে না দেখতে পারি, তার বিধবা স্ত্রীকে দেখতে তো সমস্যা নেই। বাড়ির কাছেই যে গুলিস্তান।
অগত্যা শীতের এক সকালে সিরাজ মামা তিন-চারজন ভাগনে-ভাগনির দলটাকে নিয়ে গেলেন গুলিস্তান। আমরা বিস্ময় নিয়ে নিজের চোখে দেখলাম বিবি মরিয়মকে। চার রাস্তার এক মোড়ে কিছুটা মাথা উঁচিয়ে আছে! স্বামী কালে খাঁর চেয়ে আকারে অনেক ছোট হলেও বিবি মরিয়মকে আমাদের মতো বাচ্চাদের কাছে বিশালাকৃতির বলে মনে হলো। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম তাকে।
‘ভুলেও বিবি মরিয়মের মুখে হাত ঢুকাইবা না!’ সিরাজ মামা সাবধান করে দিলেন আমাদেরকে।
হাত ঢোকালে কী হবে? আমাদের হয়ে সংগত প্রশ্নটাই করল একজন।
মামা গম্ভীর হয়ে বললেন, বিবি মরিয়মের মুখে কেউ হাত ঢোকালে আস্ত হাত নিয়ে আর বাসায় যাওয়া লাগবে না। এমন কথা শুনে ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল সবার মধ্যে। আমরা ভীতির সঙ্গেই বিবি মরিয়মের হাঁ করা কালো গহ্বরের দিকে তাকালাম। কিন্তু সবাই তো আর এক রকম ছিলাম না, আমাদের মধ্যে অন্তত একজন পাগল ছিলই, আর সেই পাগল কেন নৌকা ডোবানোর নিষেধ শুনবে! তত দিনে একটু সেয়ানা হয়ে গেছি, বড়দের সব কথা বিনা প্রশ্নে মেনে নেবার স্বভাব থেকেও বের হবার চেষ্টা করছি। তো এক ফাঁকে সবার অলক্ষ্যে বিবি মরিয়মের হাঁ করা মুখের ভেতর বাঁ হাতটা ঢুকিয়ে দিলাম। যদি কিছু হয় তো কম দরকারি বাঁ হাতটাই যাবে।
দৃশ্যটা দেখে সিরাজ মামার চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো যেন। তারপরই একটা চিৎকার, আর সেটার উৎস তিনি নন, আমি! বিবি মরিয়মের মুখ থেকে হাতটা টেনে বের করতেই তিনিসহ সবাই দেখল, আমার বাঁ হাতের কবজি উধাও! এরপরই সিরাজ মামার আর্তনাদ। সঙ্গে সঙ্গে সোয়েটারের ফুলস্লিভের হাতার ভেতর থেকে কবজিটা বের করে ফিচকে হাসি দিলাম, যেন মামাকে জব্দ করে দুনিয়া জয় করে ফেলেছি।
সবাই হেসে কুটি কুটি হলেও সিরাজ মামার মুখ থমথমে। এতটুকুন একটা পিচ্চির কাছে নাজেহাল হওয়াটা মেনে নিতে পারেননি সহজে। এই ঘটনার পর থেকে আমার সামনে কোনো গল্প করতেন না তিনি। আমারও তাতে কোনো আক্ষেপ ছিল না। অচিরেই বড় হয়ে গিয়েছিলাম, এসব গালগল্পে বিশ্বাসও করতাম না। আষাঢ়ে গল্প বলে উড়িয়ে দিতাম। তবে পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের বইতে কালে খাঁ জমজম এবং বিবি মরিয়মের সত্যিকারের গল্পটি পড়ে আমার চিন্তাভাবনার বদল ঘটেছিল: মোগল আমলে মগ, পর্তুগিজ আর আরাকান জলদস্যুদের হাত থেকে ঢাকা শহরকে রক্ষার জন্য অনেক কামান তৈরি করেছিলেন বাংলার সুবাদার মীর জুমলা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল কালে খাঁ জমজম আর বিবি মরিয়ম নামের দুটো কামান। ভারতজোড়া খ্যাতি ছিল বলে কামানগুলো ছিল ঢাকাবাসীর গর্ব। কালে খাঁ জমজম যেখানে ৩৬ ফুট দৈর্ঘ্যের ছিল, বিবি মরিয়ম সেখানে মাত্র ১১ ফুট। কামান দুটোর নামকরণ নিয়ে সঠিক কিছু জানা যায়নি। অনুমান করা হয়, ১৬৬১ সালে মীর জুমলার আসাম জয়ের পেছনে ‘কালে খাঁ’ নামের কোনো এক বীরসেনানীর অবদান ছিল, ফলে তার নামেই বড় কামানটার নামকরণ করা হয়, আর বিবি মরিয়ম তারই স্ত্রীর নাম।
যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে বিবি মরিয়মকে রাখা হয় বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারীঘাটে, আর কালে খাঁ জমজমকে রাখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গার তীরের কোথাও, কিন্তু একসময় নদীভাঙনের ফলে সেটা তলিয়ে যায়। ১৮৪০ সালের দিকে সোয়ারীঘাট থেকে চকবাজারে এনে রাখা হয় বিবি মরিয়মকে। এরপর ১৯২৫ সালে কামানটি সদরঘাটে আনা হয়, পরে স্থাপন করা হয় গুলিস্তানে। ওই সময় মানুষ ওটাকে গুলিস্তানের কামান বলত। পরে ১৯৮৩ সালে সরকার কামানটি ওসমানী উদ্যানে সরিয়ে ফেলে। এখনো বিবি মরিয়ম সেখানেই আছে।
সম্ভবত সব আষাঢ়ে গল্প আজগুবি, বানোয়াট বা অসার নয়। হয়তো রূপকার্থে ভিন্ন কোনো আখ্যান কিংবা ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রেখেছে এগুলো। তাই আমি এখনো আষাঢ়ে গল্প শুনি মন দিয়ে, আগের মতো আর অবজ্ঞা করি না। ভাবি, কোন আখ্যান আর ইতিহাস রূপকার্থে লুকিয়ে আছে গল্পটার পেছনে?