হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯—১৫ নভেম্বর ২০২১)

একজন কথাশিল্পী চলে গেলেন আমাদের জন্য ‘আগুনপাখি’ লিখে রেখে,
যখন দস্তয়েভস্কির দ্বিশত জন্মদিন চলে আর জয়েসের ‘ইউলিসিস’
একশ ছোঁবে ছোঁবে, আর—চেখভও মৃত।
তাঁর আত্মা স্তেপের কালো প্রান্তরে আকাশের দিকে চোখ রেখে
দেখছে যে, সতীর্থ চলে গেলেন পাখি সব আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে রেখে।

এগুলি আত্মারই কথা।
সে আত্মা হোক মানুষের, শয়তানেরও হতে পারে;
কথাশিল্পে মানুষ অধিকাংশ শয়তান সেজেই বসে থাকে
এমনকি উৎপল বসুর ঝাউবনের পাশে,
এমনকি জানাজায়ও গিয়ে তারা ভাবে
বিকেলের দিকে স্তেপের কালো মাটি ধুলো দিয়ে ভরে
কী করে আসবে টাকার গাড়ি কোন দিক থেকে?

টাকার গাড়ি ভাবতেই ঝড় ওঠে—জ্বরও।
জড়তা দেখতে পাই বিশেষত শিল্পীসমাজের মাঝে,
যারা সাধু সেজে শয়তানের বিপরীতে
চেখভকে ‘গোধূলির কথাশিল্পী’ বলে ডাকে।
‘আগুনপাখি’ এ সময়ে খোলা দেখি টেবিলের মাঝখানে;
আমি ভাবি মোবাইল ফোন এসে রাজশাহীর ফোন নম্বর
মুছে গেছে এরিয়া কোডসহ;
ভাবি—পাখি, আগুন বর্ষণ করে যে পাখি, সে কেমন পাখি?
তাকে তো ভালো হয়, যদি ড্রাগন বলে ডাকি।

কিন্তু রাজশাহী যেহেতু স্তেপের প্রান্তরে
মোটামুটি ঘোড়া চললেই মানাবে, এমন এক দেশ রাজশাহী,
তাই আসো, লক্ষ্মীসোনা, যারা মধ্যবিত্তের খুনসুটি পড়ে পড়ে
ভুলে গেছ করবীগাছ নামেও এক গাছ আছে, যার ডালে উঠে
চেখভ খাচ্ছেন রক্তপ্রধান এক ফল
আর আমি দেখছি, গাল বেয়ে খুনপ্রবাহিত কিছু নালি,
তখন আমাদের কথাশিল্পী বলে গেল—
কেমন লাগছে বলো আত্মজার জোর করে খোলা খনিপথে
ঢুকে ঢুকে যাওয়া প্রবল লজ্জাহীন আওয়াজের অশ্রুমাখা ধারা?
কেমন লাগছে শুনতে যে, দূরের বৃক্ষপল্লবহীন ছায়া ছায়া
প্রান্তর থেকে উদ্‌গীরিত ঢং ঢং ঢং?
—রাঢ় অঞ্চলে গুপ্তধন পাহারা দেয় যারা
তাদের বালতি কি হাত থেকে পড়ে গেল খনির গর্ভ-গর্ত আর পথে?
ওহ্, সেই আওয়াজ শুয়ে থাকা মৃত শরীরের পেটে
ডাক্তার বাড়ি দিলে যে রকম, সে রকম—ঢপঢপমতো।

হাসান আজিজুল হক, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কীভাবে আমি তা-ও কাজ করে যাচ্ছি দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে!
সম্ভবত সেটা ‘প্রথম আলো’য় ছাপা হবে স্তেপের কয়লাপ্রান্তর পাশে রেখে
রাঢ়বঙ্গে প্রভাতের আলো ফুটলে পরে…
ওফ, কে যে বারবার টেবিলে রেখে যাচ্ছে মৃত তিমি মাছের মাথা,
কথাশিল্পে লেভিয়াথান বলে যাকে,
আর সেলো পয়েন্টেক ০.৫ জেল পেন এবং মোটা রুলটানা এক খাতা!
যখন তিনি বিস্মিত মরবার আগে
রামপালে অমন বীভৎস সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন দেখে,
আর আগুনপাখিটিকে খাঁচায় বন্ধ করে রেখে ভাবছেন,
কী লাভ হলো ব্লা ব্লা মানবতার জন্য তাহলে এত দিন এত কিছু লিখে,
জীবন যেহেতু শয়তানেরই নিয়ন্ত্রণে ও হাতে?—দস্তয়েভস্কি বলেছিল;
আর জয়েস বলেছিল—দস্তয়েভস্কি সাহিত্যে ভায়োলেন্স এনে
সাহিত্যকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে
ভিক্টোরিয়ান মধ্যবিত্ত খুনসুটি থেকে!

হুম, তার চেয়ে ভালো স্তেপের কয়লাপাড়ে রাঢ়বঙ্গের কন্যা যত আছে
তাদেরকে ডাক দিয়ে বলা হঠাৎ চমকে ওঠা এক স্বরে—
শোনো, এ মুহূর্তে আছি আন্তন চেখভের সাথে,
কাল তো ছিলাম, কাল কেন কথা বললে না গো তুমি?

ভালো এই সবই ভাবা যখন রক্ত গড়িয়ে যায়
আগুনপাখির ড্রাগনের মোটা চামড়া থেকে;
ফোঁটাগুলো সংখ্যাহীন, ফোঁটা বলা যায় না দগদগে কোনো স্মৃতিপ্রবাহকে।