কাওয়ালি–রাজনীতি ও সাম্প্রতিক বাস্তবতা

নুসরাত ফতেহ আলীর কাওয়ালি পরিবেশনা

কাওয়ালির কথা বললেই নুসরাত ফতেহ আলী কিংবা আবিদা পারভীনের সুদৃঢ় মুখশ্রী ভেসে ওঠে। আমার এক ফরাসি বন্ধু আলেইন-বাউড পিঁয়েরে নুসরাতের সঙ্গে প্রায় এক দশকজুড়ে ঘুরেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে ‘শাহেনশাহ-ই-কাওয়ালি’ নুসরাত ফতেহ আলী খানের কণ্ঠ সারা বিশ্বের মানুষের কল্পনাকে আঁকড়ে ধরে। তিনি একটি উজ্জ্বল আধুনিকতার সঙ্গে রহস্যবাদ এবং ভক্তিতে নিমজ্জিত প্রাচীন সুফি সংস্কৃতির পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন।’ এ কথা ঠিক যে তিনি তাঁর কণ্ঠে আশ্চর্য দক্ষতা প্রদর্শন করে একটি আঞ্চলিক ধারাকে বিশ্বসংগীতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেমনটি করেছিলেন জ্যামাইকান রেগের বব মার্লি, আমেরিকান কান্ট্রি মিউজিকের পিট সিগার, আফ্রিকান জ্যাজের লুইস আর্মস্ট্রং।

সংগীতের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় মধ্যযুগে কাওয়ালির মাধ্যমে উত্তর-ভারতীয় সংগীতের এক মহাজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যে খেয়ালের যে সাংগীতিক বিস্তার, এর সঙ্গে কাওয়ালির সম্বন্ধ নিবিড়। এর সূচনা হয়েছিল তুর্কি চারণকবিদের মাধ্যমে। আবার এ–ও প্রচলিত আছে যে দিল্লির অদূরে এক যাযাবর জাতি উচ্চনিনাদি ভক্তিগীতি করত। ওস্তাদ আমির খসরু সেই কাঠামোর সঙ্গে তাঁর পারস্য সংগীতের দক্ষতাকে যুক্ত করে দরবারের উপযোগী সংগীতে রূপান্তর করেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, সেলিম চিশতি, বদরুদ্দীন রিয়াজ, শাহনেওয়াজসহ অনেকেই কাওয়ালিসংগীতের বিকাশে অবদান রেখেছেন। গত শতকে হাজি গোলাম ফরিদ সাবরি ও সহোদর মকবুল আহমেদ সাবরি, নুসরাত ফতেহ আলী খান বিশ্বপরিসরে এই ধারাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

পুরান ঢাকার একটি গৌরবময় ঐতিহ্য কাওয়ালিসংগীত। মোগল, নবাবি ও কোম্পানি আমলে উর্দু কাওয়ালির আমদানি এবং বিকাশ ঘটলেও ভাষা আন্দোলনের পর তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। আর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় কিছু উর্দুভাষীর স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানের কারণে মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে কাওয়ালিচর্চা আরও সংকীর্ণ পরিসরে নেমে আসে। অর্থাৎ বহির্বিশ্বে ধীরে ধীরে কাওয়ালির বিকাশ ঘটলেও বাংলাদেশে এর গুরুত্ব হারানোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমীকরণ আছে, সেটি হলো ধর্মীয় ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পার্থক্য।

কাওয়ালি পুরান ঢাকায় এসেছে আঠারো শতকে ও নবাবি আমলে। তাদের বিয়ে, ওরস, খতনা, গায়েহলুদ, খানকা, মাহফিল, কাসিদা, খাজাবাবার জন্মদিন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কাওয়ালি পরিবেশনের রীতি ছিল। সে সূত্রে প্রবাসী কাওয়ালদের কাছ থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত অনেকেই প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন। পরে তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে এখানে কায়েম রাজা, সালেম রাজা, আমির রাজা, ইভু, কালু, ফতেহ মোহাম্মদ প্রমুখের নাম নেওয়া যায়। তখন উর্দু-ফারসি ভাষার পাশাপাশি কিছু বাংলা কাওয়ালিও গাওয়া হতো।

এখনো কাওয়ালরা সীমিত পরিসরে তাঁদের সাংগীতিক ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তবে কয়েক দিন আগে এই কাওয়ালি পরিবেশনকে কেন্দ্র করে তুলকালাম ঘটনা ঘটে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। উদার সংস্কৃতিবাদী লোকেরা এ ঘটনাকে সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাঁদের অনেকের বিবেচনা এমন, কাওয়ালি পরিবেশন করতে বাধা দেওয়া আসলে একধরনের উগ্র অপসংস্কৃতিরই প্রভাব। কিন্তু অন্য পক্ষের ভাষ্য, কাওয়ালি যেহেতু পাকিস্তানের জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গীভূত এবং এটি যেহেতু ওই দেশে বেশি গীত হয়, ফলে এটাকে তারা পাকিস্তানি সংগীত হিসেবে দেখার পক্ষপাতী। শুধু তা–ই নয়, আমাদের দেশে কাওয়ালি পরিবেশনের মধ্যে কেউ কেউ ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘রাজনীতি’র গন্ধও খুঁজে পাচ্ছেন।

তবে চমকপ্রদ তথ্য হলো, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেও উগ্রপন্থীদের দ্বারা কাওয়ালরা নির্মম আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। যদিও কাওয়ালিসংগীত সম্প্রীতির কথাই বলে, যেখানে জাতের বিচার চলে না, যেখানে শুধু সুর–আরোহণের ভেতর দিয়ে মুক্তির পথে ধাবিত হতে পারে যেকোনো জাতির মানুষ।

কাওয়ালি নিয়ে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৪৬ সালে দিল্লি ভ্রমণের এক অভিজ্ঞতায় অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৫৬ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘খাজাবাবার দরগার পাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভালো করে, তবুও মনে হতো আরো শুনি। আমরা দরগাহ জিয়ারত করলাম, বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অনেকক্ষণ গান শুনলাম, আমরা যাকে “কাওয়ালি” বলি। কিছু কিছু টাকা আমরা সকলেই কাওয়ালকে দিলাম। ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে।’

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমেই যে বিতর্ক সম্প্রতি উঠে আসে, তা হলো সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে সমর্থন করা যাবে কি যাবে না। সে ক্ষেত্রে শুধুই একটি অঞ্চল বা ধর্ম বা জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে—এমন কোনো ধারা আমদানি করা বা তা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাটা নিশ্চয় সমর্থনযোগ্য নয়। আবার সেই ধারাই যদি দার্শনিক বিবেচনায় অন্য সংস্কৃতিকে আত্তীকরণ করে, তা বরং সেই সংস্কৃতির সমৃদ্ধিই বয়ে আনে। বাংলার জারিগান যেমন পারস্যের মর্সিয়াসংগীতকে আত্তীকৃত করেছে। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু নৃত্যনাট্যের গানে কাওয়ালি সুর ও তাল ব্যবহার করা হয়েছে, এমনকি নজরুলের গানেও। বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় কাওয়ালি প্রভাবিত বাংলা গান ‘ছেড়ে দে নৌকা মাঝি যাব মদিনা’, ‘খাজাবাবা খাজাবাবা মারহাবা মারহাবা’ ইত্যাদি গান বিশেষভাবে জনপ্রিয়। তার মানে এগুলো বাংলা গানের চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে তা কাওয়ালি কি না, আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন পড়ে না। সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্ন তখনই আসে, যখন কোনো উপাদানকে প্রকৃত রূপে নিরীক্ষণের পরিবেশ তৈরি না থাকে। বলা বাহুল্য, এ দেশে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ এখনো ততটা স্বতঃস্ফূর্ত হয়নি। ফলে বিশ্বসংস্কৃতির সবকিছুর ভার বহনের ক্ষমতাও হয়তো তৈরি হয়নি আমাদের। অথচ একটি উন্নত রাষ্ট্রের চাহিদা হিসেবে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির পরিবেশ সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ শর্তের মধ্যে পড়ে। প্রায়োগিক নৃ-সংগীতবিদ্যার মানুষ নির্বিঘ্নে সেই কাজ করেন। আর এ তো জানা কথা যে পৃথিবীর পাঠশালায় কোনো কিছুই আগ্রাসন নয়, বরং তা সম্পূরক, এবং সেই শর্ত তখনই কল্যাণে আসবে, যখন প্রত্যেকে সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি মনোযোগী হবে।

আদতে প্রতিটি ধারার ভেতর জ্ঞান আছে। শাস্ত্রীয় জ্ঞান, নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান, অর্থনৈতিক জ্ঞান, ধর্মীয় জ্ঞান ইত্যাদি। এসব বিষয়ে পরিপক্ব ভোক্তা না হলেই ভিন্ন সংস্কৃতি লালন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। যেমন আমির খসরু কর্তৃক কাওয়ালির হাত ধরে যে তবলার সূচনা হয়েছে, এখন আমরা কি সেই সর্বজনবিদিত তবলাকেও বাদ দেব?

কাওয়ালিসংগীত সুফিদের প্রতিনিধিত্বে বিকশিত হয়েছে। এটি মূলত অসাম্প্রদায়িক সংগীত। এখানে সব ধর্মের মানুষই যুক্ত হতে পারে। কারণ, এ সংগীতের উদ্দেশ্যই হলো সুরের মাধ্যমে গভীর ভাবদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। মধ্যযুগে ভারতে মুসলিম শাসনামলে কাওয়ালি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও অসাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই ধারা গ্রহণ করেছিল। এখনো যেমন ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিদ্বেষের কালেও ভারতীয় সিনেমায় কাওয়ালিসংগীতের আধিপত্য দৃশ্যমান। পাকিস্তানেই বরং কিছুদিন আগে একজন প্রসিদ্ধ কাওয়ালকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা করেছিল? নিশ্চয়ই ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা।

বাংলাদেশে কাওয়ালিসংগীতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখো অনুরাগী রয়েছেন। খুবই দুঃখজনক যে কাওয়ালি আসরের ওপর আঘাত এসেছে, যা প্রকারান্তরে এ দেশের সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকর্মীদের ওপরই আঘাত। তাই একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানুষ তার উদার ও সাম্যবাদী সাংস্কৃতিক বিকাশের লক্ষ্যে কোন অবস্থানে যাবে, বিশেষভাবেই তা ভাবতে হবে।