চট্টগ্রাম ভূমিকম্প ১৭৬২: একটি প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ
২ এপ্রিল ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ। বিকেল ৫টায় ভয়ানক শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৪ মিনিট স্থায়ী ভূমিকম্পের সময় কামান গর্জনের মতো ১৫টি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটির প্রভাবে সীতাকুণ্ডে দুটি আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল। কক্সবাজারের কাছে কয়েক শ মানুষকে নিয়ে একটি দ্বীপ সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল। এক অনালোচিত অধ্যায়ের উন্মোচন।
১৬৮২ সালে হুগলিতে এক শুল্ক–বিবাদের সূত্র ধরে মোগলদের কাছ থেকে একটি নগরী দখলের পরিকল্পনা করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বলা হয়েছিল, মোগলদের কাছ থেকে একটি শহর অধিকার করে নিজেদের মতো করে এমনভাবে তৈরি করা হবে, যা সমগ্র প্রাচ্যের মধ্যে সেরা নগরী হবে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর উইলিয়াম হেজেস লিখেছিলেন, ‘…অ্যান আলটিমেটাম ওয়াজ টু বি সেন্ট টু দ্য নবাব এট ঢাকা, অ্যান্ড ইফ, এজ ওয়াজ প্রোবেবল, নো স্যাটিসফ্যাক্টোরি আনসার ওয়াজ রিসিভড, দ্য বাল্ক অব দ্য ফোর্স ওয়াজ টু প্রসিড টু চিটাগং।’ কিন্তু ১৬৮৬-১৬৮৮ সময়কালে চট্টগ্রাম দখলের দুটো অভিযানই ব্যর্থ হয়েছিল এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে পড়েছিল।
১৭৬১ সালে পলাশী যুদ্ধের বকেয়া বাবদ মীর কাশিমের কাছ থেকে চট্টগ্রামের দেওয়ানি আদায় করার পর আবারও সম্ভাবনা জেগেছিল চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে। তাই ফোর্ট উইলিয়ামের দ্বিতীয় প্রধান কর্তা হ্যারি ভেরেলস্টকে পাঠানো হয়েছিল গভর্নর হিসেবে। কিন্তু চট্টগ্রামে কোম্পানি শাসন চালু হওয়ার ১৫ মাস পরই স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পটি আঘাত করে।
২ এপ্রিল ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ। বিকেল ৫টায় ভয়ানক শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে। ৪ মিনিট স্থায়ী ভূমিকম্পের সময় কামান গর্জনের মতো ১৫টি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটির প্রভাবে সীতাকুণ্ডে দুটি আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল। কক্সবাজারের কাছে কয়েক শ মানুষকে নিয়ে একটি দ্বীপ সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক পাহাড় ফেটে চৌচির হয় এবং পুকুর-দিঘি সমতলভূমিতে পরিণত হয়। কর্ণফুলী নদীর পানিতে চট্টগ্রাম শহর ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছিল। শহরের অনেক জায়গায় বিশাল গভীর ফাটল ও খাদের সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আরও ১১ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। চট্টগ্রাম শহরে মাটির এবং ইটের তৈরি সব ঘরবাড়ি ভূপাতিত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কুঠি এবং দুর্গ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কাঠের বাড়িতে বসবাস করার ফলে ইংরেজ কর্তাদের প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল। দেশীয় লোকদের হতাহতের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও নিহত মানুষের সংখ্যা কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার হতে পারে। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল চট্টগ্রামে হলেও এর প্রভাবে সমগ্র বাংলা কেঁপে উঠেছিল। ব্রহ্মপুত্র নদসহ বেশ কয়েকটি নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভয়ংকর অভিজ্ঞতাটি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল হেনরি ভ্যানসিটার্টকে লিখে জানিয়েছিলেন চট্টগ্রামের গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট, ‘আবহাওয়াটা বেশ কিছুদিন ধরে গুমট আর উষ্ণ ছিল। এপ্রিলের ২ তারিখ বিকেল পাঁচটার দিকে হঠাৎ করে একটা কম্পন, প্রথমে মৃদু তারপর বাড়তে বাড়তে এমন ভয়ানক ঝাঁকুনি শুরু করল, পরবর্তী দু মিনিট ধরে চারপাশের সব গাছপালা, পাহাড়, বাড়িঘর থরথর করে কাঁপছিল। এত জোরে কাঁপছিল যে পায়ের তাল রাখা যাচ্ছে না। কয়েকজন কৃষ্ণকায় স্থানীয় লোক ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল এবং প্রচণ্ড ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে তাদের কয়েকজন ওখানেই মারা গেল, বাকিরা এমনভাবে আক্রান্ত হয়েছে যে এখনো তারা স্বাভাবিক হতে পারেনি। নদী, সমুদ্র এবং উপকূলবর্তী সমতলে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে এই ভূমিকম্প।
বাঁশবাড়িয়ার কাছে সমুদ্র উপকূলের সাত জায়গায় মাটি ফেটে কুয়ার মতো গর্ত হয়ে গেছে। ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত হয়েছে। ওখানে বড় একটা ইটের তৈরি কাছারি ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। হালদার কাছে সঞ্চারম কানুনগোর বাড়ির কাছে ১২ দ্রোণ জমি ডুবে গেছে পানিতে। দোহাজারীতে হরি সিং হাজারির পাকা বাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। শেখ জামাল খানের ইটের বাড়িও ধসে পড়েছে, তিনি নিজেও তাতে গুরুতর আহত হয়েছেন। বাড়ির কাছে ২০০ হাত চওড়া গভীর এক ফাটল তৈরি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা এতটা জলস্রোতে পরিপূর্ণ হয়েছে যে গভীরতা মাপাও অসম্ভব এখন। হাওলা পরগনার শ্যাম রায়ের বাড়ি ভেঙে তাঁর উঠান দুদিন দুই হাত পানির নিচে ডুবে ছিল।
‘আমাদের কপাল ভালো যে আমরা কাঠের বাংলোতে ছিলাম। যদি ইটের বাড়িতে থাকতাম, তাহলে এতক্ষণে সেটা মাটিতে মিশে যেত। দুর্গের মধ্যে আমাদের নতুন যে ঘরটি সর্বোত্তম ইট-সুরকি দিয়ে খুব মজবুত করে বানানো হয়েছে, সেটি ভেঙে পড়েছে। পুরোনোটি তো ভেঙে চুরচুর হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে মাটিতে বিশাল ফাটল সৃষ্টি হয়ে ভূগর্ভ থেকে সালফারের গন্ধযুক্ত পানি উদ্গিরণ করেছে। অনেক জলপূর্ণ পরিখা ও পুকুর শুকনো সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
‘আমরা এত বেশি ভয়বিহ্বলতায় আক্রান্ত হয়েছিলাম যে ভূমিকম্পের আক্রমণের দিকনিশানা পর্যন্ত ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। কখনো মনে হয়েছে পূর্ব থেকে পশ্চিম, কখনো পশ্চিম থেকে পূর্বে ধাক্কা দিচ্ছে। কিছু জায়গায় পুকুরের পানি উত্তর থেকে দক্ষিণে ঢলে বেরিয়ে গেছে। দেয়াঙ্গ পরগনার অনেক জায়গায় ১০-১২ হাত প্রশস্ত ফাটল দেখা দিয়েছে ভূমিতে। কিছু কিছু ফাটল এত গভীর যে তা মাপার সাধ্য ছিল না।
ভূমিকম্পের পরপরই শহরজুড়ে জলোচ্ছ্বাসের মতো পানি এসে ঢুকল। প্রায় সাত হাত পানির নিচে ডুবে গেল শহর। নদীর উল্টোদিকে একটা গ্রামও সাত হাত পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
‘পাথরঘাটা থেকে হাওলার আট মাইল দূরত্বের মধ্যে ভূমিতে বিশাল সব ফাটল তৈরি হয়ে জলে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।
‘বাঁশবাড়িয়ার কাছে সমুদ্র উপকূলের ৭ জায়গায় মাটি ফেটে কুয়ার মতো গর্ত হয়ে গেছে। ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত হয়েছে। ওখানে বড় একটা ইটের তৈরি কাছারি ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। হালদার কাছে সঞ্চারম কানুনগোর বাড়ির কাছে ১২ দ্রোণ জমি ডুবে গেছে পানিতে। দোহাজারীতে হরি সিং হাজারির পাকা বাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। শেখ জামাল খানের ইটের বাড়িও ধসে পড়েছে, তিনি নিজেও তাতে গুরুতর আহত হয়েছেন। বাড়ির কাছে ২০০ হাত চওড়া গভীর এক ফাটল তৈরি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা এতটা জলস্রোতে পরিপূর্ণ হয়েছে যে গভীরতা মাপাও অসম্ভব এখন। হাওলা পরগনার শ্যাম রায়ের বাড়ি ভেঙে তাঁর উঠান দুদিন দুই হাত পানির নিচে ডুবে ছিল।
‘বুরুমছড়ার জমিজমা দুই হাত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। শান্তরাম কানুনগোর ইটের দেউড়ি ভেঙে পড়লে তাঁর এক আত্মীয় মারা যান। কালুরঘাটের কাছে করলডেঙ্গা পাহাড়ও দুভাগ হয়ে তার বিশাল একটা অংশ নদীতে পড়ে গেছে। বাজালিয়া খাল ও দোহাজারী খালের স্রোত থমকে গেছে। সেখানে তিন দ্রোণের মতো জমি পানিতে ডুবে গেছে। আলী চৌধুরীর উঠানেও বিশাল ফাটল তৈরি হয়ে জলে পূর্ণ হয়ে গেছে চারপাশ। সোয়াবিল থেকে মুরাদাবাদ পর্যন্ত তিনজন তালুকদারের সব জমি ডুবে গেছে, সেখানে চারজন মারা গেছে।
‘সবচেয়ে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে বাহারছড়ায়। কক্সবাজারের কাছে বাহারছড়ায় সমুদ্রের কাছে পাঁচ-ছয় ক্রোশের মতো জায়গার একটা গ্রাম কয়েক শ মানুষ ও গবাদিপশু নিয়ে মাটির নিচে চলে গেছে। জায়গাটি সমুদ্রের অংশ হয়ে গেছে। তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
‘শিলকোপায় ভূমিতে ফাটল তৈরি হয়ে বিপুল পরিমাণ লবণাক্ত পানি ছিটকে বেরিয়েছে। দুই পাহাড়ের মাঝের উপত্যকায় কিছু ছড়া ও খালের স্রোত বন্ধ হয়ে বালিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো খালের গভীরতা বেড়ে ২০ হাতও হয়ে গেছে।
‘শিকলবাহা আর ইছামতী নদীর স্রোত থেমে গেছে। সেখানে কিছু পণ্যবাহী নৌকা আটকে পড়েছে। ওখানেও কিছু ভূমিতে অসংখ্য ফাটল, কিছু ভূমি পানিতে নিমজ্জিত, কিছু পুকুর বালিতে পূর্ণ হয়ে গেছে।
‘বরকল পাহাড়ে ৪০ ফুট প্রশস্ত ফাটল দেখা গেছে। কাসালং পাহাড়ের একাংশ সম্পূর্ণ ডুবে গেছে নদীতে।
‘চাঙ্গি পাহাড়ে ২০-৩০ হাত প্রশস্ত ফাটল দেখা গেছে। পদুয়া খাল পানিশূন্য হয়ে দুটো বালির পর্বত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার বাড়িঘরগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। জুমপেদিয়া পাহাড়টি ভূমিতে এত দেবে গেছে যে তার চূড়াটি এখন সমতলভূমির সঙ্গে মিশে যাওয়ার উপক্রম। রিগেরি পাহাড়ে ৩০ ফুট প্রশস্ত ফাটল। জুমপালং পাহাড়ে ২৫ ফুটের ফাটল।
‘এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে ১২০ দ্রোণের মতো জমি ভূগর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সম্পূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞের খবর আসছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন খবর আসছে। আমার মনে হয় এ পর্যন্ত যা খবর এসেছে তা সত্যিকারের ধ্বংসযজ্ঞের এক-অষ্টমাংশ মাত্র।’
বস্তুত এই ভূমিকম্পের পরই কোম্পানির চট্টগ্রাম পরিকল্পনা থমকে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে জেতার পর সব হিসাব-নিকাশ নতুন করে শুরু করা হয়। অতঃপর ১৭৭২ সালে কলকাতাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সূত্র: ‘দ্য ডায়েরি অব উইলিয়াম হেজেস’ (১৬৮১-১৬৮৭), সম্পাদনা: হেনরি ইউল, হাকলুইট সোসাইটি, লন্ডন, ১৮৮৭; ‘ফিলোসফিক্যাল ট্রানজাকশানস অব রয়েল সোসাইটি’ (১৭৬৩), এল. ডেভিস অ্যান্ড সি. রেইমারস বাই রয়েল সোসাইটি ও ‘হিস্টরি অব দ্য রাইজ অ্যান্ড প্রগ্রেস অব দ্য বেঙ্গল আর্মি’, ক্যাপ্টেন আর্থার ব্রুম, স্মিথ এলডার অ্যান্ড কোং. লন্ডন ১৮৫০