ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের একটি কক্ষে বসে ২০০৪ সালের এপ্রিলে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘এটা আমার নতুন জন্ম। নতুন জীবন বলে মনে হচ্ছে। আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছে এই প্রকৃতি, এবং মানুষ, এবং হাসপাতাল।’ খুব গুরুত্বপূর্ণভাবেই তিনটি প্রতীতিতে আস্থা তাঁর—প্রকৃতি, মানুষ, বিজ্ঞান। অলৌকিকত্বের বাইরে গিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক ইহজাগতিক এই জীবনদর্শনই তিনি সারা জীবন লালন করেছেন, প্রকাশ ও প্রচারও করেছেন। হুমায়ুন আজাদ আমাদের সমাজে বড্ড বেমানান ছিলেন, যেমন বেমানান ছিলেন তাঁদের সমাজে নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩–১৫৪৩), জর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮–১৬০০), গ্যালিলিও গ্যালিলেই (১৫৬৪–১৬৪২)। কোপারনিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিওর জ্ঞান সমকালীন সমাজ ধারণ করতে পারেনি। তাই সমাজশক্তি প্রয়োগ করে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পরে সেই সমাজই মেনেছে, কোপারনিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিও ঠিক ছিলেন। ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮–১৯৩৬) মাত্র ৩৮ বছর বাঁচতে পারলেন। তাঁকে কবরস্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হলো, কোনো প্রমাণ রাখা হলো না। কিন্তু সব ধরনের সাম্রাজ্যবাদী বাধা অতিক্রম করে মনুষ্যশক্তির অনিবার্য উত্থানের কথা তিনি যে বলেছিলেন তাঁর নাটক বা কবিতায়, সেই ভাষ্য তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এভাবেই বেঁচে আছেন কোপারনিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, লোরকারা।
হুমায়ুন আজাদের নতুন জীবন তাঁদেরই মতো। তিনিও আস্থা রেখেছিলেন পুরোনো বিশ্বাসে নয়, বাঙালি সংস্কৃতির শাশ্বত শক্তি আর অগ্রগমনে। সমকালে বিতর্কিত হয়েছে তাঁর ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি। প্রতিক্রিয়াশীলেরা তো বটেই, কথিত প্রগতিশীলেরাও নানা যুক্তি দিয়ে উপন্যাসটি ‘বিভ্রমতায় পূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এটি হুমায়ুন আজাদ জানতেন। জেনেই এই বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নিয়ে স্পষ্ট করে তিনি বলেছেন, ‘যে উপন্যাসটির জন্য আমি নিহত হয়েছি বলা যায়—আমি তো বেঁচে উঠেছি নিহত হওয়ার পর—সে উপন্যাসটি “পাক সার জমিন সাদ বাদ”; এটি বাংলাদেশের পটপরিস্থিতিতে সবচেয়ে শৈল্পিক উপস্থাপন।
এই উপন্যাসটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা আমাকে অনেকে বলেছেন এটি বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে; এটিতে মৌলবাদের হিংস্রতার যে রূপ উপস্থাপন করেছে তা অতুলনীয়, এবং কেউ কেউ অবশ্য বলেছে যে এই উপন্যাসটির পরিণতি এ রকম হলো কেন? এত পাষণ্ড, এত হিংস্র নায়ক কী করে প্রেমে পড়ে এই মৌলবাদী খুনিদের আখড়া থেকে বেরিয়ে গেল? আমি তাদের বলেছি যে আমি নানারকম বিকল্প সমাপ্তির কথা ভেবেছি—কিন্তু নিষ্ঠুর সমাপ্তি আমার কাছে পছন্দ হয়নি। এই খুনিটি, এই মৌলবাদীটি সমস্ত ঘাতকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী। সবচেয়ে সে শিক্ষিত। সে একসময় সর্বহারা ছিল। তারপর সাম্যবাদী ছিল। ব্যর্থতা তাকে মৌলবাদে নিয়ে এসেছিল, এবং সে যে-রাতে তার প্রেমিকাকে নিয়ে মৌলবাদী খুনিদের আখড়া থেকে পালিয়ে দূর দূর দূরে এক সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে তার গাড়ি থামায়, এবং তখন সেই সমুদ্রের ভেতর থেকে সবুজের মাঝখানে একটি লাল সূর্য ওঠে। এটি একটি প্রতীকী ব্যাপার যে বাংলাদেশ মৌলবাদ দ্বারা আক্রান্ত হবে নাÑবাংলাদেশ মৌলবাদী খুনিদের দ্বারা আক্রান্ত হবে না, বাংলাদেশ কখনো আফগানিস্তান হবে না।’ (হুমায়ুন আজাদ, ‘আমার নতুন জন্ম’, ২০০৫)
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেশ ভয়ের কাল শুরু হয়েছিল ২০০১ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর। ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদে আসন পাকা করার পর ভীতির সাম্রাজ্য বিস্তার হতে থাকে। রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকনেতাদের দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছি, তাঁরা সরকারি বৃত্তি নিয়ে ২০০১ সালের প্রথমার্ধেই স্ত্রী বা স্বামীসহ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের নামে দেশ ছাড়েন। এ সময় সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্ণধারগণ পথে নেমে না এলে অন্ধকার আরও দীর্ঘায়িত হতো। কবি শামসুর রাহমান তাঁর বৃদ্ধ বয়সেও ঘরে বসে থাকেননি, দল সমর্থন না-করা হুমায়ুন আজাদও লেখনী বন্ধ করেননি। এঁরাই তো আলোর ফেরিওয়ালা! মৌমাছিরা তো স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। এ সময় জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তুলেছিলেন এক অধ্যাপক (পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সভা আহ্বান করে। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না সভাতে। শিক্ষক সমিতির সভায় সাধারণত হুমায়ুন আজাদ আসেন না। কারণ, দলহীন অথবা নিরপেক্ষ বলে প্রায়শ তাঁকে খোঁচা খেতে হয়। সেই অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে দেখলাম, তিনি বেশ আগে থেকেই সভায় উপস্থিত। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত সাদা দল আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের দ্বিমেরুকেন্দ্রিক আলোচনা সভাতে উত্তেজনা বিরাজমান।
সময়ও বেশ গড়িয়ে গেছে। কিছু বলবেন বলে উঠে দাঁড়ালেন নিরপেক্ষ বলে কথিত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। শুরু করলেন এবং বলতেই থাকলেন। দীর্ঘ বক্তৃতা। সবার ক্লান্তি কোথায় উড়ে গেল, বোঝা গেল না। তাঁর বক্তব্যের তিনি প্রমাণ করেছিলেন, কেন জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ই থাকবে। দলীয় পরিচয়ের বাইরে বলেই নয়, বক্তব্যে তিনি যে যুক্তি দিয়েছিলেন, সাধারণ শিক্ষকসমাজ সেদিন সভায় করতালি দিয়ে তা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন এবং জানিয়ে দিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদের বক্তব্যই তাঁরা সমর্থন করেন। সেদিন আমি সভায় উপস্থিত ছিলাম। ক্লান্ত ও উত্তেজিত সভাটি হুমায়ুন আজাদ কী করে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ দিয়ে সজীব ও প্রশান্ত করেছিলেন, খুব মনে পড়ে।
ব্যাংকক থেকে আপাতত সুস্থ হয়ে হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের ঘরে এলে একদিন বাসায় যাই। গিয়ে দেখি, সত্যি তিনি সেই পুরোনো পত্রিকাগুলো দেখেছেন। এ যেন তাঁর নতুন জন্ম। তিনি বলেছিলেন: ‘আমি যে কয়েক দিন নিহত, মৃত ছিলাম সে-সময়ের কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। শুধু মনে পড়ে যেনো আমি একটি খাটের উপর শুয়ে আছি।’ অবিনাশী যাত্রাকালে পুরাণের অগ্নিপাখি ফিনিক্স যেভাবে আবার জীবন্ত হয়, হুমায়ুন আজাদ যেন তেমনি বারবার আবির্ভূত হন আমাদের সামনে।
এই মানুষটি মাত্র ৮০ বছর আয়ু চেয়েছিলেন। এটি এ সময়ের জন্য খুব বেশি চাওয়া নয়। কিন্তু ৫৭ বছরে পা দিতেই জীবন প্রদীপ নিভে গেল তাঁর। এভাবে তাঁকে আহত ও নিহত করা না হলে তিনি নিশ্চয়ই ৮০ বছর অতিক্রম করতেন। আমার বিবেচনায়, খুব হিসেবি ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। নিজের লেখার ঠিকঠাক তালিকা এতটা সুন্দর করে বোধকরি এর আগে রবীন্দ্রনাথই শুধু রেখেছিলেন। লিখতেন মেপে এবং নিয়মিত।
আমরা যে ঘরে রান্নার তৈজসপত্র রাখি, সেখানে তিনি কম্পিউটার নিয়ে লেখার ঘর বানিয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, দিনে নিয়মিত দুই থেকে তিন পৃষ্ঠা লিখলেই হবে। কথাটি আমার কাছে ‘অমৃত সমান’ হয়ে আছে। হুমায়ুন আজাদের আহত হওয়ার পরের দিন থেকে দেশের সব কটি পত্রিকা কিনে জমা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর। তখনো হুমায়ুন আজাদ অসুস্থ, হাসপাতালে, চিকিৎসাধীন। এর একটা চাপ তো আছেই। তারই মধ্যে দেশের সব পত্রিকা এক কপি করে প্রতিদিন সংগ্রহ কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘ভাবি’কে।
তাঁর স্ত্রী আমাকে বলেছিলেন: আমি জানি, হুমায়ুন আজাদ একদিন সুস্থ হবেন এবং সুস্থ হয়ে সে সময়ের পত্রিকাগুলো পড়তে চাইবেন। তখন কোথায় পাব। আমি চক্ষুস্থির হয়ে ভেবেছি: এই তো সহমর্মিণী। ব্যাংকক থেকে আপাতত সুস্থ হয়ে হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের ঘরে এলে একদিন বাসায় যাই। গিয়ে দেখি, সত্যি তিনি সেই পুরোনো পত্রিকাগুলো দেখেছেন। এ যেন তাঁর নতুন জন্ম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যে কয়েক দিন নিহত, মৃত ছিলাম সে-সময়ের কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই।
শুধু মনে পড়ে যেনো আমি একটি খাটের উপর শুয়ে আছি।’ অবিনাশী যাত্রাকালে পুরাণের অগ্নিপাখি ফিনিক্স যেভাবে আবার জীবন্ত হয়, হুমায়ুন আজাদ যেন তেমনি বারবার আবির্ভূত হন আমাদের সামনে। নিশ্চয়ই কখনো দেহসমেত, কখনো দেহহীন এই আবির্ভাব। জন্মভূমি তাঁর কাছে স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী ছিল। তাই শ্বাপদসংকুল পরিবেশ জেনেও তিনি বিদেশ থেকে স্বদেশেই ফিরতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘আমি শীঘ্রই দেশে ফিরে যাবো। আমি জানি না দেশে ফিরে যাওয়ার পর দেশের কী পরিস্থিতির মধ্যে পড়বো—হয়তো দিনের পর দিন হরতাল চলতে থাকবে, হয়তো খুনের পর খুন চলতে থাকবে; কিন্তু সেই রক্তাক্ত বিপর্যস্ত পচনশীল বাংলাদেশে আমি বাস করতে চাই—সেখানে আমি ফিরে যেতে চাই।’
থাইল্যান্ডের হাসপাতাল থেকে তিনি ফিরে এসেছিলেন এবং পচনশীল বাংলাদেশ রক্ষার জন্য আবারও লেখনী ধারণ করে বলেছিলেন, ‘আমি একটি সুস্থ, কল্যাণে পরিপূর্ণ বাংলাদেশ চাই।’ আজও এ কথাই উচ্চারিত হোক সর্বত্র, এর জন্যই আমাদের সব কর্ম হোক উৎসর্গিত।