পূর্ব বাংলার এক ‘আগন্তুক’ ভাষ্যকার

বশীর আল্‌হেলাল (৬ জানুয়ারি ১৯৩৬—৩১ আগস্ট ২০২১)

বশীর আল্​হেলাল গত হয়েছেন ২০২১ সালের আগস্টের শেষ দিনে। দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালের ৬ জানুয়ারি। জীবনের শেষ সময়টা নীরবেই কাটিয়েছেন তিনি। অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন। বাংলা ভাষার পাঠক আর প্রতিষ্ঠানগুলোও তাঁকে নিয়ে মোটামুটি চুপচাপই ছিল। কিন্তু আমাদের এই সম্মিলিত নীরবতাকে কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ বলা যাবে না। এ দেশের বাংলা সাহিত্য যেসব ধারার সমন্বয়ে আকার পেয়েছে, তার নিবিড় পাঠ জরুরি। সেই জায়গা থেকে বশীর আল্​হেলাল অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করেন।

তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে। একই গ্রামে পল্লিগানের শিল্পী আবদুল আলীম ও ভাষা আন্দোলনের শহীদ আবুল বরকতেরও জন্ম। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এই তথ্য দিয়ে বশীর আল্​হেলাল–সম্পর্কিত আরও কিছু তথ্য এখানে টুকে রাখা যাক। কেননা, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তাঁর সম্পর্কে তেমন অবগত নন। অথচ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে গেলে এই লেখকের দ্বারস্থ হতে হয়। উপরন্তু তাঁর কথাসাহিত্যও পূর্ব বাংলার সমাজ এবং সংগ্রামমুখর সমাজের উত্থান–পতন তুলে ধরে নিপুণভাবে। এই লেখকের জন্ম হয়েছিল এক পণ্ডিত মুসলিম পরিবারে, পদবি ছিল সৈয়দ।

বাবা সৈয়দ মুহাম্মদ আলী আসমার উত্তর ভারতে একাধিক বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ালেখা করেছিলেন। পরে সেই সব জায়গায় শিক্ষকতাও করেন। আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন তিনি। ছিলেন ইউনানি চিকিত্সক। বশীর আল্​হেলালের পিতামহও ছিলেন শিক্ষক, নামজাদা ফারসি কবি। তাঁদের পরিবারে বাঙালি সংস্কৃতি হাজির ছিল। ফলে চন্দনবাটা কপালে দিয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল উত্তর ভারতজুড়ে আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষার বিখ্যাত পণ্ডিতের ছেলে নেয়ামাল বশীরের। এটাই বশীর আল্​হেলালের পরিবারের দেওয়া নাম। তাঁরা তিন ভাই—নেয়ামাল ওয়াকিল, নেয়ামাল বাসির ও নেয়ামাল বশীর। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। তাঁর অগ্রজ নেয়ামাল বাসিরও লিখতেন। ভাইয়ের সঙ্গে পাঠকেরা তাঁকে গুলিয়ে ফেলতেন বলে নিজের নামটি পাল্টে বশীর আল্​হেলাল রেখেছিলেন তিনি।

ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত মুর্শিদাবাদে পড়াশোনা করেন বশীর আল্​হেলাল। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলো। তিনি ভর্তি হলেন রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলে। মাধ্যমিক পাসের পর ১৯৫২ সালের কলকাতায় মামাবাড়িতে থেকে আইএ পাস করলেন। জলপাইগুড়ির এসি কলেজ থেকে অনার্স করলেন বাংলায়। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময় যুক্ত হলেন বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে। অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির লাল কার্ডধারী তালিকাভুক্ত সদস্য হন আরও পরে। এভাবেই সমাজ আর মানুষ পাঠের দীক্ষা তৈরি হলো তাঁর। বলা বাহুল্য, এই দীক্ষা বশীর আল্​হেলালের সারা জীবনের দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দিয়েছিল। গুরুত্ব দিয়ে তাঁর লেখালেখির শুরু মূলত এই দেখা থেকেই। প্রথম জীবনে হজ কমিটিতে চাকরির পাশাপাশি মওলানা আকরম খাঁর পত্রিকায় কাজ করতেন। কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পের বই স্বপ্নের কুশীলব

দেশভাগের পর বশীর আল্​হেলালের দুই ভাই তৎকালীন পাকিস্তানে চলে এলেন। কিন্তু মা–সহ তিনি থাকলেন কলকাতায়ই। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এখানে-সেখানে নতুন করে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ফলে ১৯৬৮ সালে মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হলেন বশীর আল্​হেলাল। ১৯৬৯ সালে সহপরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন বাংলা একাডেমিতে। আর ১৯৯৩ সালে অবসরে যাওয়ার সময় ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।

বশীর আল্​হেলাল ঢাকায় যখন আসেন, তখন বাংলাদেশের সমাজ এক মহাপরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—সব মিলিয়ে সময়টা ছিল আন্দোলনে উত্তাল। রাজনীতির সঙ্গে তিনি তো আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন, ফলে বাঙালির স্বাধিকারের এই আন্দোলনে সক্রিয় পক্ষ নিতে দেরি হয়নি তাঁর।

জীবদ্দশায় তিনি উপন্যাস লিখেছেন ছয়টি—কালো ইলিশ, ঘৃতকুমারী, শেষ পানপাত্র, নূরজাহানদের মধুমাস, শিশিরের দেশে অভিযান যে পথে বুলবুলিরা যায়। আর ছোটগল্প লিখেছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। সাহিত্য ও জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বীক্ষা ছিল। আর সেই বীক্ষার জমিনে তীব্রভাবে প্রোথিত ছিল নিজের রাজনৈতিক দীক্ষা।

এই লেখকের গল্প ও উপন্যাসে নগরজীবন এসেছে। বাদ যায়নি শৈশবের যাপিত গ্রামীণ জীবনও। আদতে নিজের প্রত্যক্ষ চেনাজানার বাইরে তিনি পা বাড়াননি। লেখার ক্ষেত্রে সমাজের মধ্যবর্তী স্তরের মানুষদের বেছে নিয়েছেন প্লট হিসেবে। তাঁর কাছে সাহিত্য ছিল সমাজের রূপান্তরের সহায়ক। এমনকি তাঁর কিশোর গল্পেও নিরেট আনন্দের বদলে পাওয়া যায় ক্লেশ ও যাতনার বাস্তবতা।

আগেই বলা হয়েছে, পূর্ব বাংলার প্রান্তে অভিজাত মুসলিম বিদ্বান পরিবার ও সংস্কৃতিতে জন্ম এবং বড় হওয়া বশীর আল্​হেলালের। তাই কি তাঁর উপন্যাসে দেখা যায় পূর্ব বাংলার জীবন, জীবনের বিচিত্র তলকে আবিষ্কারের সক্রিয় চেষ্টা? এখানে বলা দরকার, তাঁর এই চেষ্টা বাইরের একটা চোখ দিয়ে পূর্ব বাংলাকে দেখার সুযোগ ঘটিয়েছিল বটে। তাই কলকাতায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা বশীর আল্​হেলালকে পূর্ব বাংলার ‘আগন্তুক’ অথচ নিবিষ্ট ভাষ্যকারের অভিধাটি দেওয়াই যায়। কারণ, যে চোখ দিয়ে তিনি পূর্ব বাংলা অবলোকন করেছেন, ওই চোখে এখানকার মাটি ও মানুষের প্রতি ছিল প্রবল সহানুভূতি ও দরদ। ছিল এত দিন প্রান্তিক করে রাখা একটা সমাজ কেমন করে রাষ্ট্রের মালিক হয়ে উঠছে, সেই মিথস্ক্রিয়া অনুধাবনের জরুরি প্রয়াস।

পূর্ব বাংলার এই রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পরিক্রমা বশীর আল্​হেলালকে মোহিত করে রেখেছিল। কথাসাহিত্যে তিনি যা তুলে ধরতে চেয়েছেন, ভাষা ও সাহিত্য গবেষণায় তা–ই তিনি সাজাতে চেয়েছেন নথি আকারে। বাংলা একাডেমির ইতিহাস লেখার কাজ শুরু করে তাঁর মনে হয়েছিল, সমগ্র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জমিনের দাঁড়িপাল্লায় না মেপে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস লেখা যাবে না। ফলে লিখে ফেলেন ৮০০ পৃষ্ঠার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আর এই ইতিহাস লিখতে গিয়ে তিনি বেশি জোর দিয়েছেন সংস্কৃতির ইতিহাসের প্রতি। কারণ, পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস খুব একটা লেখা হয়নি। জাতি ও রাষ্ট্র গড়ে ওঠার এই অবহেলিত দিকটি বশীর আল্​হেলাল বুঝতে চেয়েছেন সক্রিয়ভাবে। ফলে কবিতা নিয়েও লিখেছেন আমাদের কবিতা নামে একটি বই। এখানে ‘আমাদের’ শব্দটি তাঁর দেখার চোখকেই চিনিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ গড়ে ওঠার মধ্যে বহু বিচিত্র কর্মকাণ্ডের স্রোত এসে মিশেছিল। এর ভেতর ছিল নিজেকে চিনে নেওয়ারও প্রয়াস। মানুষ যার মধ্যে জন্মায়, তাকে সবচেয়ে কম চেনে—এমন কথা অনেকেই বলেন এবং এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, একে জানার প্রয়োজন সেভাবে তিনি বোধ করেন না। কিন্তু স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে হলে কেবল অন্যের ভিন্নতা নয়, নিজের পরিচয়ও খুঁজে নিতে হয়। সন্ধান করতে হয় নিজের হয়ে ওঠার ইতিহাস। বশীর আল্​হেলাল বুঝতেন, কাজটি কী ভীষণ দরকারি। নিজের গোটা জীবন তিনি সেই সন্ধানেই ব্যয় করেছেন। তাঁর এই অনুসন্ধানের কাজটি ভুলে গেলে, চালু না রাখলে খুব লোকসান হয়ে যাবে।