প্রজাপতি ও অন্যান্য

প্রজাপতি

লোকটা বেদির ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ আতঙ্ক নিয়ে উঠে বসে।

‘কী হয়েছে?’ স্ত্রীলোকটি দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে।

‘এ আমি কী দেখলাম!’ ভীত-সন্ত্রস্ত লোকটা বলে।

‘কী দেখেছ? স্বপ্ন? ভয় পেয়ো না। আমরাও স্বপ্ন—এই আমি, এই তুমি।’

‘কে দেখছে সেই স্বপ্ন?’ লোকটা ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘প্রজাপতি দেখছেন।’ স্ত্রীলোকটি শান্ত কণ্ঠে বলে।

‘আমরা নিজেরাই যদি স্বপ্ন হই, কী করে জানব যে তিনি স্বপ্ন দেখছেন?’ লোকটা অপ্রকৃতিস্থের মতো উঠে দাঁড়ায়।

‘কারণ আমরাও স্বপ্ন দেখছি।’

লোকটা এবার ভীষণ উত্তেজিত। ক্রোধে ফেটে পড়তে পড়তে স্ত্রীলোকটির গলা টিপে ধরে সে।

‘এখন? এটা কে স্বপ্ন দেখছে?’

স্ত্রীলোকটি বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘আমি জানি না।’

ডাহুক

পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ফেলা হবে। বহুতল ভবন উঠবে এখানে।

বাড়িওয়ালার নোটিশ এসেছে, এ মাসেই যেন বাসা খুঁজে নিই।

এক ভোরবেলা কুঠারের শব্দ শুনি।

তখনো সূর্য ওঠেনি। বাড়িটার পেছনে বুনো ঝোপঝাড় আর ডালপালার ভেতর দু–একটা পাখি ডাকছে। এখানে অনেকটা জায়গাজুড়ে এলোমেলোভাবে বেড়ে উঠেছে অসংখ্য গাছ—নানা জাতের। কোথাও কোথাও ডালপালাগুলোকে ঢেকে ফেলেছে লতানো গাছ। জানালা থেকে দেখি, কাঁকরোল আর তেলাকুচাপাতার ঘন আস্তরের ওপর ডাহুকগুলো রোদ পোহায়। ওরা নতুন এসেছে। মেঘলা দিনে ডাহুক আর বসন্তবাউরি যখন একসঙ্গে ডাকে, তখন অদ্ভুত একটা অর্কেস্ট্রা সৃষ্টি হয়। কাছের কোনো গাছের মগডাল থেকে আসা কোনো পাখির ডাক তখন দারুণ সাংগীতিক হয়ে ওঠে। আর ডাহুকগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে লেজ ও ঘাড় নাচাতে থাকলে পাশ দিয়ে দ্রুত ছুটে যায় একটা কাঠবিড়ালি, যাকে সারাক্ষণ নজরে রাখে প্রজাপতিগুলো। কারণ কাঠবিড়ালিটা কোনো ফলে দাঁত না বসানো পর্যন্ত প্রজাপতিদের কিছুই করার থাকে না।

ডাহুকগুলো যে কোথা থেকে আসে! গত বছর থেকে দেখছি ওদের। আগে যেখানে ছিল, সেখান থেকে কি উৎখাত হয়েছে?

মুহুর্মুহু কুঠারের শব্দ। ওরা বাড়ির কাজ শুরু করেছে। কিন্তু ডাহুকগুলো?

গলা বাড়িয়ে কাঠুরেদের জিজ্ঞেস করি, ‘সব গাছ কেটে ফেলবেন?’

‘হ্যাঁ,’ বলে এক কাঠুরে।

‘কোথা থেকে এসেছেন?’ বুঝতে পারি এ প্রশ্নের কোনো মানে নেই, খামোখা একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া।

কিছুটা সময় নিয়ে এক কাঠুরে জবাব দেয়, ‘হামারঘরক ঘর-বাড়ি নাই।’

‘নাই মানে?’

‘ছিল বাহে অ্যাকনা, মঙ্গার দেশত। এখন নাই।’

আর কোনো কথা হয় না।

কুঠারের শব্দ হয়।

ভুল স্টেশন

রাতের ট্রেন এসে থামল স্টেশনে।

লোকটা ট্রেন থেকে নেমেই বুঝল, এটা একটা ভুল স্টেশন। একটা ভুল ট্রেন তাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে।

সে পা বাড়াল ভুল শহরের দিকে।

রাতের আকাশে অগুনতি নক্ষত্র। সেই আলোর ভেতর অচেনা অ্যাভিনিউয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা অনুভব করল, রাতের মানুষ, চাঁদ, পুলিশ, ফুটপাতে ঘুমন্ত ভিখারি, মাতাল, পথকুকুর—সবকিছুকেই ঠিক লাগছে। মনে হলো, রাত একটা বিশাল নক্ষত্রখচিত ডানা। তার নিচে সে সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে থাকল এবং হাঁটতে হাঁটতে এক নদীর কিনারে গিয়ে পৌঁছাল।

নদীতীরে জবুথবু এক লোককে দেখে সে জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক পথটা কোন দিকে?’

জবুথবু লোকটা লজ্জিত হয়ে বলল, ‘আমি বলব? কী যে বলো! কী যে বলো না!’

সে উন্মাদের মতো হাসতে শুরু করল।

লোকটা বুঝল, এটা একটা ভুল লোক।

নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকা এক ভাবুককে পেয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি বলতে পারবেন ঠিক পথ কোনটা?’

ভাবুক হেসে উঠলেন এবং হাসতেই থাকলেন। তাঁর হাসিতে নদীর ঢেউ ভাঙার শব্দ। আর লোকটা ভীষণ লজ্জার মধ্যে পড়ে গেল, কারণ এই হাসি এবার তাকেই উপহাস করছে। ভাবুক লোকটার হাসির প্লাবনে সে যেন ভেসে যেতে থাকল।

নিবিলি মে

রাত শেষ হয়ে আসছে।

বেলাভূমিতে একটা ছায়ামূর্তি হাঁটে। অন্ধকারের গায়ে অন্ধকার হয়ে মিশে আছে সে আর সমুদ্রের শব্দের ভেতর ডুবে আছে নিঃশব্দের মতো।

দূর থেকে এক যুবক আসে। সে–ও অন্ধকার বেলাভূমিতে মিশে আছে আঁধারের গায়ে। যুবতীকে দেখে সে দাঁড়ায়।

‘তুমি কি নিবিলি মে?’ জিজ্ঞেস করে যুবক।

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি না হিমঘরে পড়ে ছিলে?’

‘তাই নাকি? আমার কিছু মনে নেই। তুমি কীভাবে এলে?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

‘আমাকে ওরা গুলি করেছিল।’

‘ওহ!’

কিছুক্ষণ কেউই কথা বলে না। সমুদ্রের স্বর ঢেকে রাখে তাদের নীরবতা।

‘তুমি কি সত্যিই ধর্মান্তরিত হয়েছিলে? ইচ্ছে করেই গিয়েছিলে ওদের সঙ্গে?’ যুবক নীরবতা ভাঙে।

‘আমার মনে নেই।’

‘তুমি কি জানো তোমার মৃতদেহ কে পাবে, তা–ই নিয়ে মামলা চলছে? তোমার বাবা আর স্বামী দুজনই তোমার শেষকৃত্য করতে চান।’

‘এসবের কিছুই আমি জানি না।’

‘তুমি কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছ? নাকি তোমার বাবার কথাই ঠিক—ওরা তোমাকে মেরে ফেলেছে?’

‘আমার মনে নেই।’

‘কী মনে আছে তোমার?’ যুবক কিছুটা অসহিষ্ণু।

যুবতী বলে, ‘আমার শুধু মনে আছে, আমি বেঁচে ছিলাম। ইশকুলে পড়তাম। আমার মা গান গাইতে পারত আর এই সমুদ্রে মাছ ধরতে আসত আমার বাবা।