বাংলাদেশের ইতিহাসের সমান বয়সী

৩০ নভেম্বর মারা গেছেন জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি রফিকুল ইসলাম। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

রফিকুল ইসলাম (১ জানুয়ারি ১৯৩৪—৩০ নভেম্বর ২০২১)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করে সহকর্মী হিসেবে আমি পেয়েছিলাম ইতিহাসখ্যাত কয়েকজন পণ্ডিতকে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রফিকুল ইসলাম। পরে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত হয়েছিলেন। তবে তিনি ‘নজরুল–গবেষক’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আমার সদ্ভাবের মাত্রা যেন একটু বেশিই ছিল। কারণ, আমিও নজরুল নিয়ে কাজ করি; নজরুল অধ্যয়ন ও গবেষণায় উদাসীনতা দেখে কাতর হই। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণ বাংলা পড়ানোর জন্য একটি বই লেখার দায়িত্ব দেয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও আমাকে। তাঁকে বিন্দুমাত্র কায়িক পরিশ্রম না করিয়ে তাঁর পরামর্শমতো বইটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ করা গেছে। তিনি বইটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। এই বইয়ে আমরা প্রথমবারের মতো ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘ফেসবুক ব্যবহারের নিয়ম ও সচেতনতা’ নিয়ে আলোচনা করি। রফিকুল ইসলামের পরামর্শেই সেটি করা হয়েছে।

নজরুল–গবেষক হিসেবে আজ তাঁর পরিচিতি একটু বেশি হলেও এটি রফিকুল ইসলামের বহু পরিচয়ের একটিমাত্র। বরং বলা চলে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সমান বয়সী। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। জন্মেছেন ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের মতলবে। তাঁর শৈশব কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে। গত শতকের পাঁচের দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে একই বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে। পরোক্ষভাবে ধরলে সেটির বয়স প্রায় সত্তর বছর। তিনি যখন ছাত্র, তখন সংঘটিত হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। নিজে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তো ছিলেনই, সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অসংখ্য মুহূর্ত। তাঁর নিজের তখন ছিল ‘ভয়েগ ল্যান্ডার’ জার্মান ক্যামেরা। অবশ্য সেকেলে ক্যামেরায় দেশবিভাগের আগেই ফটো তোলায় তাঁর হাত পেকেছে।

১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডফেরত এক ভাইয়ের কাছ থেকে জার্মান ক্যামেরা হাতে আসায় তিনি যেন ‘হাতে চাঁদ’ পেয়ে যান। আর এ সময় থেকেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি হতে থাকে। তিনি ছবি তোলেন। ছবিতে ব্যক্তিমুখের চেয়ে ঘটনাকেই ‘সাবজেক্ট’ করতেন। আমাকে বলেছিলেন, ব্যক্তির চেয়ে ঘটনা আর প্রকৃতি তাঁকে বেশি আকর্ষণ করত। তাই রমনার বহু বৃক্ষ ও বাগানের ছবি তিনি তুলেছিলেন, বহু পুরোনো ভবনের ছবি তাঁর তোলা ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সেই যে নারীদের মিছিল বা শহীদ মিনার নির্মাণের দৃশ্য ছবিতে ধারণ করেছিলেন, সেখানে তো ব্যক্তিমুখ গৌণ, ঘটনাই মুখ্য। কোনো কোনো ছবি তোলার জন্য তিনি দৌড়ে ভবনের ছাদে উঠেছেন, কোনোটি আবার গাছে উঠেও তুলেছেন। তখন কি আর জানতেন, এগুলো ইতিহাস হবে?

সময়টা কিন্তু বিবেচনার দাবি রাখে। ক্যামেরা, ফিল্ম, ফিল্ম-ডেভেলপ, ছবি তৈরি—সবটাই খুব সহজসাধ্য ছিল না। আর এর সঙ্গে অর্থের সংশ্লিষ্টতাও বিবেচনায় রাখা দরকার। কোনো সংবাদপত্রের হয়ে তিনি ছবি তুলতে যাননি, গিয়েছিলেন ব্যক্তি-আগ্রহে। তাঁর তোলা অনেক ফিল্মই পরে হারিয়ে গেছে, অনেকেই প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি। আবার অনেক ছবির স্বত্ব তাঁর থাকেনি। এ নিয়ে তাঁর পরিতাপ ছিল। তবু তিনি দুঃখ পাননি এই ভেবে যে অবশেষে মানুষের চোখে ধরা দিয়েছে ইতিহাস এসব ছবির আধারেই।

ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষাবিরোধী নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার। সে সময় রফিকুল ইসলাম তাঁর শিক্ষক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির নানান কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি যখন বাংলা বিভাগের প্রভাষক, তখন আনিসুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে ‘ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ ১৩৭০’ অনুষ্ঠান করেছিলেন। সে সময় রবীন্দ্র–বর্জনের যে ধোঁয়া তোলা হয়েছিল এবং একই সঙ্গে নজরুলকে সংস্কারকৃত রূপে আবির্ভূত করার চেষ্টা ছিল, রফিকুল ইসলাম ছিলেন এর বিরুদ্ধে।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনের বিবৃতি ছিল: পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধবিরোধী রবীন্দ্রসংগীত বেতারে প্রচারিত হবে না। এই বিবৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের জন্য রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান একত্রিত হয়ে প্রথমে মুনীর চৌধুরীর কাছে যান। মুনীর চৌধুরী একটি পাল্টা বিবৃতি প্রথমে ইংরেজিতে লেখেন, পরে সেটি অনুবাদ করা হয়। সে সময় তরুণ রফিকুল ইসলামও বিভিন্নজনের কাছে গিয়ে এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর নিয়েছিলেন এবং সেটি পত্রিকার কার্যালয়ে পৌঁছানো হয়। এই বিবৃতির পরই সারা দেশের রবীন্দ্রপ্রেমীরা মনে সাহস পান এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন আরও বেশি বেগবান হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় টিক্কা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপককে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগে আটক করেন। রফিকুল ইসলামও ছিলেন সেই তালিকায়। আটক করে তাঁকে নির্যাতনও করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম প্রমুখকে ডেকে দেশ গঠনে তাঁদের ওপর কতিপয় দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং শিক্ষাকে গণমুখী করার কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) ছিলেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে শেখ হাসিনা যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, সে কথা তিনি সব সময় স্মরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের পর রফিকুল ইসলাম স্বাধীন দেশে বিশেষত উচ্চশিক্ষার দিক থেকে মানবতাবাদী সমাজ সৃষ্টিতে কাজ করেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য নিয়ে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করায় নজরুলের প্রতি তাঁর অধিকার স্বভাবতই বেড়ে যায়। নজরুলের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই প্রথম পিএইচডি। তাই বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭২ সালে নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন, তখন তিনি খুব আনন্দিত হয়েছিলেন এবং সে সময় থেকেই তিনি নজরুলের খোঁজখবর রাখতেন। কবির মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, সে সময় রফিকুল ইসলাম খুবই নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে তিনি নিজে পরে উল্লেখ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মসজিদের পাশে’ কবিকে সমাধিস্থ করার গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে নজরুল পাঠ ও গবেষণা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা অনন্য। তিনি নিজে শুধু নজরুল-জীবনীই লেখেননি, নজরুল নিয়ে যেসব বিভ্রান্তি ও বিতর্ক ছিল, সেগুলো সমাধানের চেষ্টাও করেন। বিশেষত নজরুলগীতির যে পাঠান্তর ও সুর-বিকৃতি চলে এসেছিল, রফিকুল ইসলামের আগ্রহেই তার একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি এখন দেখা যায়। তবে তিনি শুধু নজরুল নিয়েই ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর আদর্শিক প্রত্যয়।