বাংলাদেশের শিল্পীরা বেশ সাহসী

এবারের ঢাকা আর্ট সামিটের প্রধান সংগ্রাহক ও সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান শিল্পনির্দেশক ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী

ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট। ছবি: সাইফুল ইসলাম

ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: দক্ষিণ এশীয় শিল্পের প্রতি আপনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন কীভাবে?
ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট: দক্ষিণ এশিয়ায় আমার আসাটা ছিল বলতে গেলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা থেকে। সেটা ২০১০ সালের দিককার ঘটনা। এখানকার একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল; আমাদের বিয়ে করার কথাও ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য সে সম্পর্কটা বেশিদূর এগোয়নি। তবুও আমি এখানে থেকে গিয়েছিলাম, কারণ তত দিনে এখানকার শৈল্পিক নিসর্গ আমাকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। এখানে অর্থবহ কিছু করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি আমি, নিউইয়র্কে যা করা সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে পুরো ভারত ঘুরে ঘুরে স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেয়ে গেলাম এক পৃষ্ঠপোষকের সহায়তায়। উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের হায়দরাবাদে একটা ভাস্কর্য পার্ক বানানো। এখন বাংলাদেশে এসে মনে হচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লাগবে। সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সিলেট সংগ্রহশালা গড়ে তোলার একটি কাজ করছি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পূর্ব এশিয়ার শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিও বেশ আগ্রহ ছিল আমার। তখন চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আমাকে বেশ পড়াশোনা করতে হয়েছে। আমার মা একজন চামোরো (গুয়াম দ্বীপের একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী)। সেই দিক থেকে বলতে গেলে আমার বংশের টান ও নিজের আগ্রহ দুটোই সম্ভবত আমার এখানে আসার পেছনে কাজ করেছে।
ইকবাল: সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত হলেন কীভাবে?
ডায়ানা: সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন একজন শিল্পনির্দেশক খুঁজছিল। এ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটিয়ে দেন খ্যাতিমান ভারতীয় শিল্পী জিতিশ কাল্লাত ও অপরাজিতা জৈন। এভাবেই যুক্ত হওয়া। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা দুটোই খুব দরকার এই কাজের জন্য। সময়ও দিতে হয় প্রচুর। তবু মনে হয়, পৃথিবীর আর কোনো কাজেই আমি এত আনন্দ পেতাম না, যে আনন্দ আমি এই কাজে পাচ্ছি। সামিটের পাশাপাশি আমরা শিক্ষাবিষয়ক সেমিনারেরও আয়োজন করছি। একটি ফাউন্ডেশনকে কীভাবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা যায়, তা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করতে থাকাটা খুবই উপভোগ্য একটা ব্যাপার।
ইকবাল: বাংলাদেশি শিল্পকর্মের কোন দিকটি আপনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়?
ডায়ানা: বাংলাদেশি শিল্পীদের সাহস চোখে পড়ার মতো। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের শিল্পীরা, বিশেষ করে আলোকচিত্রীরা বেশ সাহসী বক্তব্য তুলে ধরছেন। এটি এ অঞ্চল থেকে যা প্রত্যাশা করা হয় তার বিপরীত। তাঁদের সেরা কাজগুলোর কিছু কিছু—এমনকি প্রথম দেখায় বাংলাদেশি মনে নাও হতে পারে। সংগ্রাহক বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের কোনো চেষ্টা এসব কাজের মধ্যে আপনি একদমই পাবেন না।
ইকবাল: ঢাকা আর্ট সামিটের আগের পর্বগুলোও বেশ সফল ছিল। সত্তর হাজারের বেশি দর্শক এখানে এসেছেন। সেদিক থেকে এবারের আর্ট সামিট কীভাবে আলাদা?
ডায়ানা: ঢাকা আর্ট সামিট দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অন্যতম আলোচিত একটা আয়োজনে পরিণত হয়েছে। প্রচুর মানুষ এখন এর অপেক্ষায় থাকে। স্থানীয় দর্শকেরা কীভাবে সাড়া দিচ্ছেন সেটি একটি সামিটের সাফল্য মাপার ভালো উপায়। দর্শকদের ব্যাপক সাড়ার মধ্য দিয়েই এর সফলতা মাপা যায়। দর্শকদের আগ্রহের কারণেই এবার আমরা সামিটের সময় বাড়িয়েছি। সেই সঙ্গে প্রদর্শনীর প্রতিদিনের সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে দুই ঘণ্টা করে।
ইকবাল: একজন কিউরেটর বা প্রধান শিল্পনির্দেশক হিসেবে বাংলাদেশে এত বড় একটি প্রদর্শনীর বড় চ্যালেঞ্জ মনে হয়েছে কোনগুলোকে?
ডায়ানা: এখানকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অবকাঠামো। অবকাঠামোগত কারণে দেশজুড়ে শিল্পকর্ম আনা-নেওয়ার কাজটি সহজ ছিল না। সে কারণে বাংলাদেশে যেসব কাজ আমরা দেখাতে চাই তার বেশির ভাগই আমাদের ফেব্রিকেট করতে হয়েছে। অন্য প্রতিকূলতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শিল্পকর্মের জন্য কোনো বিমাব্যবস্থা নেই। আর সেটা না থাকলে চারদিনের জন্য একটি সত্যিকার জাদুঘর–মানের প্রদর্শনী আয়োজন করা বেশ কঠিন।
ইকবাল: এবার ঢাকা আর্ট সামিটে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে রিওয়াইন্ড বিভাগটি। এ বিভাগটি যোগ করার পেছনে কী ভাবনা কাজ করেছে?
ডায়ানা: রিওয়াইন্ড শাখায় মূলত ১৯৩০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত করা অসাধারণ কাজগুলো দেখানো হচ্ছে। এই কাজগুলো সাম্প্রতিক সময়ের কাজগুলোর পেছনের বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করবে। আপনি অতীত না বুঝলে বর্তমানকে কিছুতেই বিচার করতে পারবেন না। আপনি পেছনের ইতিহাস না জানলে নতুন কিছু কীভাবে তৈরি করবেন? এখানে সেসব শিল্পীর কাজ জায়গা পেয়েছে যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিক চিত্রকলাচর্চার শুরু করেছিলেন। যদিও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে তাঁদের অনেকের কাজই আমরা বাংলাদেশে আনতে পারিনি।
ইকবাল: সামিটে একক প্রকল্প আছে ১৭টি। এখানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশের শিল্পীদের কাজ আছে...
ডায়ানা: দক্ষিণ এশিয়া কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের একজন তাঁর অবস্থানকে কীভাবে দেখেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে পরিচয় আমরা বেছে নিয়েছি অথবা আমাদের ওপর আরোপিত হয়েছে তা সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নাও হতে পারে। একক প্রকল্পগুলো বলা যেতে পারে সদ্য তৈরি করা বা সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হয়েছে এমন কাজ। এটা হতে পারে ট্রমা (সুমন আহমেদ), সামাজিক কাঠামো (পো পো), পরিবেশ এবং তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবর্তিত সম্পর্ক (তুন ই অং, ওয়াহ নু কিংবা মুনেম ওয়াসিফের কাজ) অথবা টিনু সেহগালের কাজ।
ইকবাল: আমাদের তরুণ শিল্পীদের কাজ সম্পর্কে আপনার ধারণা কেমন?
ডায়ানা: এখানকার তরুণেরা সত্যিই অসাধারণ! সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ডের তালিকায় অনেকগুলো নতুন নাম আসাটা খুবই আশাব্যঞ্জক। সব কিউরেটরই নতুনদের কাজ নিয়ে খুব সন্তুষ্ট। সামদানী আর্ট অ্যাওয়ার্ডের জন্য নির্বাচিত তরুণদের তালিকা কোনোভাবেই দশজনের মধ্যে আনতে পারেননি তাঁরা। সংখ্যাটা এখন তার চেয়ে বেশি। আমি জানি বিচারকদেরও একজনকে সেরার পুরস্কার দিতে গিয়ে খুব ঝামেলায় পড়তে হবে।
ইকবাল: বৈশ্বিক বা পশ্চিমা প্রেক্ষাপট থেকে বাংলাদেশ এবং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পের ভবিষ্যৎ আপনি কেমন মনে করেন?
ডায়ানা: আমি মনে করি, ২০১৭ সাল ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার আর্টের জন্য হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট প্রথমবারের মতো শুধু দক্ষিণ এশীয় শিল্পের জন্য একজন কিউরেটর নিয়োগ দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্যও এই বছরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গবেষণার জন্য ঢাকা আর্ট সামিটে এসেছে। এর বাইরেও বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান ঢাকা আর্ট সামিটকে তাদের গবেষণার মূল্যবান ক্ষেত্র হিসেবে দেখছে। এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশি শিল্পের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
ভেনিস বিয়েনালে বাংলাদেশি শিল্পীরা এখন জায়গা করে নিচ্ছেন। এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সিলেটে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের আর্ট সেন্টারটির উদ্বোধন দেখার জন্যও আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। এক শ একর জায়গাজুড়ে এই আর্ট সেন্টারটি হবে ঢাকা আর্ট সামিটের একটি ‘স্থায়ী’ রূপ।

ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট
ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট একজন মার্কিন কিউরেটর। তিনি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে। ২০১৪ সালে ঢাকা আর্ট সামিটের প্রধান কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডায়ানা। সামদানী ফাউন্ডেশনের নিয়মিত প্রদর্শনী ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামগুলোর পাশাপাশি তিনি সিলেটে সামদানীর একটি স্থায়ী সংগ্রহশালা গড়ে তোলার জন্য কাজ করে চলেছেন। বিশ্বজুড়ে ভাস্কর্য পার্ক নির্মাণেও সম্পৃক্ত রেখেছেন নিজেকে। তিনি নবম সাংহাই বিয়েনালের মুম্বাই সিটি প্যাভিলিয়নের ‘এনার্জি প্লাস’ প্রকল্পের কিউরেটরদের একজন হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক নিউ মিউজিয়াম ট্রাইনিয়ালের কিউরেটরিয়াল পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫-১৬ বছরের জন্য হেনরি মোর ইনস্টিটিউশন ও ফুকুওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামের ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন ডায়ানা।