লাল মাটির রাস্তা। জায়গায় জায়গায় গর্ত। তাতে পানি জমে সৃষ্টি করেছে চটচটে আঠালো কাদার। সেই কাদা থেকে বেঁচে পরিষ্কার কাপড় নিয়ে সামনে এগোনো অসম্ভব। তাই কাপড়-চোপড়ে কাদা লেপ্টেই এগোতে হলো। কিন্তু সামনে যে আরও বিড়ম্বনা অপেক্ষা করছে তা কি আর জানতাম! যখন জানলাম, তখন দুর্বিপাকের হাতে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না। পূর্ণ গোপীনাথপুর নামের এই গ্রামটি পাকা সড়কের পাশে হলেও গাঁয়ের পথঘাটের অবস্থা মোটেই সুবিধার নয়। কী আর করা, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার এই গ্রামের গহিন কন্দরে ঢুঁ মারব বলে যখন মেট্রোপলিটন শহরকে পেছনে রেখে এসেছি, তখন আর পিছুটান কিসের। তাই এগোলাম সামনে। প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ঠাকুরবাড়ি, কোথায় আছে প্রাচীন ঢিবি? মধ্যবয়স্ক এক নারী পথ দেখিয়ে বললেন, ‘জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ওখানে যাওয়া যাবে না। বেজায় কাদা। তার ওপর সাপ আছে; আছে জোঁকও।’ আসলে কোনো পথই নেই এখানে। কিছুটা পথ কাদাময় জমির ওপর দিয়ে এবং বাকি পথ সংকীর্ণ জমির আল বেয়ে যেতে হবে। অনেক ঘোরাপথে যখন জায়গাটার কাছাকাছি পৌঁছেছি, তখনই সামনেই একটা গর্ত। দিলাম লাফ। পারও হয়ে গেলাম গর্তটা। কিন্তু ওপারে পৌঁছে টাল সামলাতে পারিনি। খানিকটা ঝুঁকে গেছি সামনে। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে অবশেষে পৌঁছালাম ঠাকুরবাড়িতে। ঠাকুরবাড়ি আসলে বিরাট এক ঢিবি। গোটা ঢিবিতে খোলামকুচি আর ইটের রাজত্ব। সেখানে এখন ফসলের আবাদ চলছে। পূর্ণ গোপীনাথপুরের মোজাম্মেল হক কাজীর ২৩ বছর বয়সী ছেলে সুজন জানালেন, ইটের জন্য চাষ করাই দায়। পুরো ঢিবিতে গিজগিজ করছে ইট। মাটির পাত্রের ভাঙা অংশেও ঠাসা এই ঢিবি। ঢিবির উত্তর-পশ্চিমাংশে অপেক্ষাকৃত উঁচু একটি জায়গা আছে। সেখানেই নাকি ছিল প্রাচীন মন্দির। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নাকি এখানে এসে ধ্বংসপ্রায় একটি মন্দির দেখেছিলেন। এই কিংবদন্তি এখনো লোকমুখে প্রচলিত আছে। তবে এখানে যে অনেক পুরোনো জনবসতি ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢিবির লাগোয়া উত্তরে গোসাইমারী নামে ৩০ শতাংশ আয়তনের একটি প্রায় গোলাকার জলাশয় আছে। এই জলাশয়ের সামান্য উত্তর-পূর্বে আছে আরও একটি ছোট ঢিবি। সেই ঢিবি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেটি ঘাসে ছাওয়া এবং ঠাকুরবাড়ি নামের বড় ঢিবির মতো এতে চাষাবাদ হচ্ছে না। এখানে শুধু ইট পাওয়া যায় বলে এর নাম হয়েছে ইটাঢিবি। ঠাকুরবাড়ির পূর্ব দিকে সিংদুয়ার নামে প্রায় ৫০ শতাংশের একটি ছোট জলাশয় আছে। সেটির পূর্ব দিকে আছে প্রায় এক একর আয়তনের ফুলপুকুরা। এটির উত্তরে আছে প্রায় একই রকম আয়তনের গোলাকার মিঠাপুকুর। তার উত্তরে আছে প্রায় চার একর আয়তনের খোলাপুকুর। ঠাকুরবাড়ি ঢিবির আয়তন প্রায় চার একর এবং এই ঢিবি থেকে পশ্চিম দিকে এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে প্রবাহিত হচ্ছে তুলসীগঙ্গা নদী। ঢিবির উত্তর ও দক্ষিণে প্রশস্ত মাটির প্রাচীর রয়েছে। যদিও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, তবু এর অনেকাংশ এখনো টিকে আছে। উচ্চতা দুই থেকে তিন ফুটের কম নয়। জাঙ্গাল নামে পরিচিত এই প্রাচীরসংলগ্ন এলাকায় কাচ ও পাথরের নানা আকারের পুঁতি পাওয়া যায় বলে গ্রামবাসীর কাছে জানা গেল। চৌকা, গোল, পাঁচকোনা ও বিভিন্ন আকারের পুঁতিগুলোর রংও ভিন্ন। কোনোটা সবুজ, কোনোটা লালচে, কোনোটা সাদা, কোনোটার মধ্যে নকশাকাটা। এ তথ্য আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করল। সত্যিই যদি ওই পুঁতিগুলো মূল্যবান পাথরের গুটিকা হয়ে থাকে, তাহলে এই প্রত্নস্থানের বয়সকালকে মৌর্যযুগ অর্থাত্ খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় তৃতীয় শতক পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরই এ সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। ঢিবির উত্তর ও দক্ষিণের জাঙ্গালকে গ্রামবাসীর কেউ কেউ ভীমের জাঙ্গালের অংশ বলে অনুমান করলেও তা সঠিক না হওয়ারই সম্ভাবনা। ভীমের জাঙ্গালের অবস্থানস্থল-সম্পর্কিত যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, সিরাজগঞ্জ জেলাধীন এলাকা অথবা বগুড়া শহরের নিকটবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে গোবিন্দগঞ্জ, ঘোড়াঘাট পর্যন্ত তা প্রসারিত ছিল। কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী তা সেখান থেকে হয় কামরূপ অথবা নীলফামারী পর্যন্ত গিয়েছিল। এই পথের বাইরে পূর্ণ গোপীনাথপুর গ্রাম। এখানে ভীমের জাঙ্গালটি না থাকার পক্ষে এটা একটা যুক্তি। প্রভাসচন্দ্র সেন বগুড়ার ইতিহাস গ্রন্থের (প্রথম প্রকাশ: ১৯১৩; আলোচ্য সংস্করণ: ২০০০) ৫৭ পৃষ্ঠায় ভীমের জাঙ্গালের অবস্থান সম্পর্কে লিখেছেন—‘বগুড়া শহরের উত্তর-পূর্বাংশে যে স্থানে করতোয়ার সহিত সুবিল সংযুক্ত হইয়াছে, তথা হইতে সুবিলের উত্তর পার্শ্ব দিয়া একটি প্রাচীর-সদৃশ লোহিতবর্ণ মৃত্তিকাস্তূপ বরাবর পশ্চিমমুখে যাইয়া বৃন্দাবনপাড়ার পশ্চিমা পার্শ্বে উত্তরাভিমুখী হইয়া স্থানে স্থানে বেষ্টনী গঠন করতঃ ফুলবাড়ী, বাঘোপাড়া ও মহাস্থানগড়ের কিয়দ্দূর পশ্চিম দিয়া চাঁদমুয়া, হরিপুর, সচিয়ানী, শ্যামপুর, শব্দলদিঘী, ভাসোবিহার, বগিলাগ্রামের পশ্চিম দিয়া উত্তরমুখে গমন করতঃ বানিয়ালের নিকটে চন্দনীরঘাটে নাগর নদী অতিক্রম পূর্ব্বক অপরপাড়ে আলেরহাট ফেনীগ্রাম, কীচক, শালদহ অতিক্রম করতঃ দামুকদহে বিল পর্যন্ত, কাহারও কাহারও মতে, করতোয়া তীরস্থ ঘোড়াঘাট পর্যন্ত গিয়া পরিসমাপ্ত হইয়াছে। এই মৃত্প্রাচীরকে ভীমের জাঙ্গাল বলে।’ বিভিন্ন বর্ণনায় ভীমের জাঙ্গালের যে পরিক্রমণ পথ পাওয়া যায়, তার প্রায় পুরোটাই আমার নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। পূর্ণ গোপীনাথপুর সেই পরিক্রমণ পথের অনেক দূরে। তাই এখানকার মাটির প্রাচীরকে প্রাচীন কোনো দুর্গপ্রাচীর হিসেবে ধরে নেওয়াই সংগত বলে মনে হয়। সামগ্রিক বিবেচনায় এটি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ এটি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন বলেও মনে হয় না। এই দুঃখ নিয়ে পা রাখলাম ফিরতি পথে।