রেড

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

মুহম্মদ রিপন মিয়া লিপ্পা হয়ে গেছে।
‘অ্যাই লিপ্পা।’
‘ভাই।’
‘ঢাকা শহরে কয়টা ভূতের গল্লিরে? হিসাব আছে?’
‘আছে ভাই, তিনটা। এলিফ্যান্ট রোডে একটা, নারিন্দায় একটা, সিদ্ধেশ্বরীতে একটা।’
‘নারিন্দার গল্লি। তোর চিনজান কেউ আছে উই গল্লিতে?’
লজ্জিত হলো লিপ্পা। নারিন্দার ভূতের গলিবাসিনী নাজরানার কথা সে বলেছে ভাইকে। ডিভিডিঅলা কানা সুলেমানের দুই নম্বর মেয়ে নাজরানা। চিত্রনায়িকা পূর্ণিমার মতো দেখতে। লিপ্পার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের ছবিটা নাজরানার। তবে এটা সে দেখায়নি ভাইকে। বেয়াদবি মনে করে দেখায়নি। ভাইকে সে মানে। বলল, ‘জি, ভাই। নাজরানার কথা আমি আপনেরে বলছি।’
‘অ, তোর ডাল্লিং। ভালোই হইল। গল্লিতে দেখছিস তো, হলুদ রংগের বিল্ডিং আছে দুইটা। দুইতলা একটা। দেড়তলা একটা। দুই তলাটায় কুত্তা আছে। দেশি কুত্তা। দেড়তলায় কুত্তা নাই। দেড়তলায় থাকে। ছাব্বিশ-সাতাইশের মতো বয়েস। ছাগল দাড়ি রাখছে। বখখিলার মতন দেখা যায়। এরে খাইয়া দিতে পারবি?’
ব্যাপার না। অন্য কেউ হলে মুখের ওপর বলে দিত লিপ্পা। কিন্তু ভাই, তাঁর অসম্মান করা যায় না, না হলে ভাই কি মশকরা করছেন? ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের একটা পোলাপানকে ‘রেড’ মনে করতে বলছেন লিপ্পাকে!
নাজরানারা থাকে নারিন্দা ভূতের গলির মাথায়। দেড়তলা হলুদ বিল্ডিংটা গলির একমাত্র নিমগাছঅলা বাড়ি। রেডটাকে দেখেছে হয়তো লিপ্পা। এখন মনে করতে পারল না। দেখা যাবে।
ভাই বললেন, ‘হইল কী তোর?’
লিপ্পা বিনীত গলায় বলল, ‘জি ভাই, পারব।’
ভাই বললেন, ‘দশ লাখের কন্টাক।’
দশ লাখ! দশ লাখ টাকা! বিস্মিত হলো লিপ্পা। গত এপ্রিল মাসের বহুল আলোচিত সুরিটোলার ব্যবসায়ী মনসুর বেগ হত্যাকাণ্ড, ছয় লাখে কন্ট্রাক্ট করেছিল পার্টি। ‘ইস্পেশাল’ রেট। মনসুর বেগের হত্যাকারীরা গত মাসে পুলিশের তৎপরতায় ধরা পড়েছে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আদালতে। টেলিভিশনে দেখে লিপ্পা হাসেনি।
মনসুর বেগের বয়স হয়েছিল তেষট্টি। ফরিদ জোয়ারদারের বয়স হয়েছিল আটষট্টি। মসী উকিলের সাতচল্লিশ। ইসাহাক বকশের একষট্টি...। পকেটে ফেলা রেডের সংখ্যা কম না। এবং চল্লিশোর্ধ্ব সব রেডই। লিপ্পা স্ট্রাইক করলে কে থাকবে? লিপ্পার বয়স কত হবে এখন? ছাব্বিশ-সাতাশ। এই বয়সের রেড। তার জন্য দশ লাখ টাকা! বিষয়টা কী? সতর্ক হলো লিপ্পা। ঝিনচ্যাক কিছু একটা আছে কোথাও। সেটা কী? ভাই কি কিছু বলবেন?
বললেন।
‘শোন লিপ্পা। গেইম কি সহজ মনে হইতেছে তোর? আমার মনে হইতেছে না। নাদান একটা পোলা। এর মাথার দাম দশ লাখ ট্যাকা। ক্যান? এই কন্টাক নিছিল বিলাই মনাও। ন্যাটা শামসু, টেরর বিপুলও। কেউ রেড ফেলতে পারে নাই।’
বেসম্ভব কথা! লিপ্পা ভাবল। স্ট্রাইকার জগতের সালমান খান, শাহরুখ খান, আমির খান এঁরা স্টার-সুপারস্টার। বিলাই মনা, ন্যাটা শামসু, টেরর বিপুল—তারা কন্ট্রাক্ট নিয়ে একটা নিরীহ রেডকে খেয়ে দিতে পারেনি! সম্ভব? ঝিনচ্যাক কেইস। কঠিন ঝিনচ্যাক। দশ লাখ টাকা। পেলে এক লাখ আটাশ হাজার টাকা দিয়ে নাজরানাকে একটা লেহেঙ্গা কিনে দিতে পারে লিপ্পা। ঈদ উপলক্ষে গুলশানের এক দোকানে উঠেছে। পত্রিকায় ছবি দিয়েছে।
ভাই বললেন, ‘ঝামেলা আছে কিছু। ধরতে পারি নাই। পারলেই এই রেড পকেটে ঢুকত।’
ঝামেলা কি ধরতে পারলেই?
না ধরতে পারলে?
রেড পকেটে ফেলা যাবে না?
যাবে। চ্যালেঞ্জটা নিল ডেঞ্জারাস খিলাড়ি লিপ্পা। ভাইয়ের কাছ থেকে টাইম নিল আট দিন। পড়ে যাবে রেড।
‘সেগেন একটা থট দিয়া দেখ,’ ভাই বললেন।
তার মানে কেস ডাবল ঝিনচ্যাক। ‘সেগেন একটা থট’ কথাটা ভাই ডাবল ঝিনচ্যাক কেস হলে বলেন।
আবার ভাই বললেন, ‘বিরাট রিকস (রিস্ক না)।’
নাজরানা! নাজরানা! এক লাখ আটাশ হাজার টাকা দামের লেহেঙ্গা পরে নাজরানা লিপ্পার মাথায় নাচল, জারা জারা টাচ মি! টাচ মি! টাচ মি! সুপারহিট তামিল সিনেমা ডেঞ্জারাস খিলাড়ি একটা ইন্ডিয়ান চ্যানেলে দেখেছে লিপ্পা। দেখে মুগ্ধ হয়েছে এবং নিজেকে নিজে এই তকমা দিয়েছে। ডেঞ্জারাস খিলাড়ি। সে যেকোনো রেড ফেলে দিতে পারে। কিন্তু ভাইকে কি এসব বলা যায়? লিপ্পা বলল, ‘জি ভাই।’
‘তুই রিকস নিবি?’
‘জি ভাই।’
তাও আরও কিছুদিন টাইম দিলেন ভাই। ‘সেগেন’ একটা থট দেওয়ার জন্য। ভালো করে চিন্তা করে দেখুক লিপ্পা।
চিন্তা করে দেখেছে লিপ্পা। অতিশয় বিনীতভাবে ভাইকে আবার মনে করিয়ে দিল সে, ‘আট দিন, ভাই।’
ভাই তামিল ছবির হিরো নম্বর ওয়ান নাগার্জুনের মতো ভাব ধরলেন। ভাইয়ের হাতে উল্কি। সাপে প্যাঁচানো একটা মেয়ে। কাপড়চোপড় পরেনি মেয়েটা।
কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেল। ভাইয়ের কাছ থেকে পরে এই গেমের টাকাটা একসঙ্গে নেবে লিপ্পা। রেড ডেড হয়ে যাওয়ার পর। ন্যাটা, বিলাই, টেরর পারেনি। তারা কেউ লিপ্পা না বলে পারেনি।
নাজরানাকে কিছু বলল না লিপ্পা। রেডকে পরের কয়েক দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখল। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে কিছু দরকারি তথ্যও জোগাড় করল। পাটকাঠি একটা কালো মেয়ে আছে, শার্ট-প্যান্ট পরে, কপালে টিপ দেয়, মাঝেমধ্যে আসে ভূতের গলিতে। রেডের কাছে আসে।
লিপ্পার কাছে এখন রেডের ফোন নম্বর আছে। কিন্তু কোনোভাবেই সে বুঝতে পারেনি, এখনো পারছে না, এর মাথার দাম দশ লাখ কেন? এ কী? সাদামাটা। খুবই সাদামাটা। ছাগলদাড়ি কেটে ফেলেছে। আরও ছাগলের মতো দেখায় এখন। দাড়িছাড়া ছাগল। দাড়িছাড়া ছাগলের মাথার দাম দশ লাখ কেন হবে? কেস ডাবলের ডাবল ঝিনচ্যাক। দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলল লিপ্পা। রেড পড়ে যাবে টার্গেট সন্ধ্যায়।
কোনো রকম টেনশনই হচ্ছে না লিপ্পার। নাজরানাকে নিয়ে সে একদিন সারাদিন ঘুরল। স্টার সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখল, চায়নিজ খেলো এবং মগবাজারের হোটেল নিবাস, ১০২ নম্বর রুমে একটা প্রাইভেট সন্ধ্যা কাটাল। কানা সুলেমান জানে ঘটনা। সমর্থন করে। শালা শ্বশুর! জেল খেটেছে সাত-আটবার। লিপ্পা? খাটেনি। ধরাই পড়েনি কখনো এবং পড়বেও না। ডেঞ্জারাস খিলাড়ি সে।
নির্দিষ্ট সন্ধ্যা অল্প আগে হয়েছে। লিপ্পা যখন নাজরানাদের গলিতে ঢুকল, তখনই লোডশেডিং হলো। এখনো কারেন্ট ফেরেনি। ভালো হয়েছে। অন্ধকারে নাজরানার সঙ্গে কিছু প্রাইভেট ঘটনা ঘটেছে। মুড যথেষ্ট ভালো লিপ্পার। নাজরানার ঘ্রাণ আটকে আছে তার শরীরে। অন্ধকারে শিস দিল সে। দেড়তলা হলুদ বিল্ডিংয়ের গেট পার হয়ে ঢুকল। গেট খোলা ছিল। বিল্ডিংয়ের বুয়া খুলে রেখে গেছে। ট্যাগরা খলকু ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দুই হাজার টাকা গেছে এই খাতে। রেড থাকে একতলার মাঝখানের ঘরে। আবার শিস দিল লিপ্পা। পাটকাঠি দুপুরে এসেছিল। সন্ধ্যার আগে আগে চলে গেছে। খলকু দেখেছে। রেডের ঘরের দরজা আটকানো না। মোম জ্বলছে ঘরে। রেড কী করছে?
পা উঠিয়ে চেয়ারে বসে আছে। মোমের শিখার নাচ দেখছে তাকিয়ে। মোমের শিখা নাজরানার মতো নাচছে। মডার্ন ডান্স পারে নজরানা।
রেড দরজায় লিপ্পাকে দেখল। বিস্মিত হলো, ‘অ্যাই! কে? আপনি কে?’
লিপ্পা নিঃশব্দে হাসল, ‘ডরাইছেন?’
‘আপনি কে?’
লিপ্পা আবার নিঃশব্দে হাসল।
‘কে আপনি?’
‘ইস্টাইকার।’ লিপ্পা বলল।
‘কী?’
‘আপনে রেড, আমি ইস্টাইকার।’
‘কী বলছেন এসব?’
‘আমার নাম লিপ্পা।’
এই সময় রেডের ফোন বাজল। ডেঞ্জারাস খিলাড়ি লিপ্পা গেমের সময় মোবাইল ফোন অফ করে রাখে। রেডের ফোন খাটে। ডিসপ্লের সবুজ আলো বাড়ছে-কমছে। ফোনের রিংটোন ‘পোলাপাইন্না’।
টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার...
রেড উঠল।
লিপ্পা বলল, ‘ফোন ধরবেন? না।’
‘তার মানে? আমার ফোন বাজছে, আমি ধরব না? আপনার কী সমস্যা? আপনি কে? এখানে কী?’
সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে গেছে নাকি? আর দেরি করা যাবে না। কারেন্ট ফিরতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। শার্টের নিচে কোমরে গুঁজে রাখে, লিপ্পা মেশিন বের করল। এটা একটা উজি। জার্মানির জিনিস। সাইজে ছোট হলেও ডেঞ্জারাস দেখতে। দশ লাখ টাকার রেড পড়ে যাবে এখন। ডেড হয়ে যাবে। উজির সেফটি ক্যাচ অফ করল লিপ্পা। এই সময় রেডের চোখে চোখ পড়ল তার। চোখের তারা টু চোখের তারা। নিঃশব্দে রেড হাসল।...কী হলো?...কী হচ্ছে?...লিপ্পা কী দেখছে?...চোখের তারায় কী রেডের?...ইয়া মাবুদ!
হাড়হাড্ডি ঠান্ডা হয়ে গেল লিপ্পার। এমন ভয় সে কখনো পায়নি। মনে হচ্ছে ঠান্ডা কয়েকটি সাপ হিলহিল করছে তার শরীরের ভেতরে। মগজে, গলায়, ফুসফুসে, মূত্রথলিতে। বরফ-ঠান্ডা হিলহিল। কোথায় যাবে এখন লিপ্পা? কানা সুলেমান...নাজরানা...!
নাজরানারা দুই তলায় থাকে। কী করে...নাজরানাদের দুই তলায় কী করে উঠল লিপ্পা?
দরজা খুলে বিস্মিত নাজরানা বলল, ‘কী হইছে আপনের?’
উদ্বিগ্ন গলায় বলল।
‘কিছু হয় নাই।’ লিপ্পা বলল।
‘কিছু হয় নাই মানে? মদ খাইছেন? চউখ দুইটা এমন লাল ক্যান? ডাকাইতের মতো! কী অইছে? আপনে টলতেছেন ক্যান?...আরে! আরে! আপনের দেখি জ্বর! ওরে আল্লারে! আব্বা! ও আব্বা!...’
জ্বরে অচেতন হলো লিপ্পা। জ্ঞান ফিরল পুরান ঢাকার একটা ক্লিনিকে। সিনেমায় যেমন দেখায়, ঘটনা তেমনই। জ্ঞান ফিরলে প্রথম সব আবছা আবছা, পরে স্পষ্ট। স্পষ্ট চোখে লিপ্পা প্রথম নাজরানাকে দেখল। সাত দুনিয়ার মমতা চোখে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে নাজরানা। এই জিনিস কখনো দেখেনি লিপ্পা। পায়নি। চিন্তা করেনি। চোখ কী রকম ভিজে এল তার। দুর্বল শরীরে বিরাট একটা সিদ্ধান্ত নিল সে।—আর না!