আপনাদের একটা পরামর্শ দিই, অফিসের বসকে কোনোদিন বিশ্বাস করবেন না। রাজনীতিবিদ আর অফিসের বসের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই—দুই শ্রেণিই প্রতিশ্রুতি দেয়, পূরণ করে না। চাকরির শুরুতে বস বলেছিলেন, কনফার্মের পর লাফ দিয়ে বেতন বেড়ে যাবে। কিসের কী! শুধু বেড়েছে কাজ। আগে নিজের কাজ করতাম, ইদানীং বসের কাজও করতে হচ্ছে। বসের প্রেজেন্টেশন, ক্যাম্পেইন আইডিয়া, ট্যাগলাইন—এসব ঠিক করে দিই আমি। তাঁর কিছু খেতে ইচ্ছে হলে অর্ডার করতে হয় আমার ফোন থেকেই। এসব কাজের কোনো হিসাব আছে? আমরা শুধু প্রতিষ্ঠানের চাকরি করি, ব্যাপারটা তা নয়। চাকরি করি বসের জন্যও।
আজকের কথাই বলি। কাজ শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। বাসায় ডেঙ্গুতে কাবু হয়ে আছে তানিয়া। আগে বেরোতে হবে। এমন সময় কোমল গলায় ডেকে পাঠালেন শাহীন ভাই, আমার বস। বস কোমল সুরে ডাকলে ধরে নেবেন তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে:
১. বসের কোনো কাজ করে দিতে হবে।
২. বসকে টাকা ধার দিতে হবে।
৩. আপনার চাকরি চলে গেছে।
আমার ক্ষেত্রে আজ হয়েছিল ১ নম্বরটা। একটা কাজ ধরিয়ে পিঠ চাপড়ে বস বললেন, ‘একটু করে দাও। এটা তোমার কাছে ব্যাপারই না। জাস্ট আধা ঘণ্টা বসলেই হয়ে যাবে।’
‘ভাই, আমার স্ত্রী অসুস্থ। আপনাকে বলেছিলাম একটু আগে বের হব।’
‘ডেঙ্গু তো? কোনো ব্যাপার না। করোনা এসে ডেঙ্গুর মার্কেটটা কেড়ে নিয়েছে। এটা এখন সর্দি-কাশির মতো। চিন্তা নেই। দেরি হবে না। সমস্যা হলে ফোন দিয়ো।’
ডেঙ্গু কোনো ব্যাপার না? আপনার হলে তখন বুঝতেন। কিন্তু বসকে তো আর এটা বলা যায় না।
‘কাল করি কাজটা?’
‘কালকে পিচ। আজকের মধ্যে সব রেডি না হলে ক্লায়েন্টটা হারাব। বাসায় যাওয়া নিয়ে তুমি একদম ভেবো না। অফিসের গাড়ি তোমাকে দিয়ে আসবে। অ্যাই মনোয়ার, এখানে কফি দাও।’
কাজটা যখন শেষ করলাম, তখন ডিনারের সময় হয়ে গেছে। বসকে মেইল করে দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে সিকিউরিটিকে বললাম, ‘বাসায় যাব।’
‘বাসায় যাইবেন, যান।’ নির্বিকার জবাব সিকিউরিটির।
‘শাহীন ভাই বলেছিলেন, গাড়ি বাসায় দিয়ে আসবে।’
‘আমারে তো স্যার কিছু বইলা যায় নাই। আপনি অ্যাডমিনে ফোন দেন।’
এত রাতে অ্যাডমিনকে ফোন দিয়ে ঝামেলা করতে ইচ্ছে করল না। এই লকডাউনের রাতে কীভাবে বাসায় যাব? মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শাহীন ভাইকে কল করলাম। ধরলেন না। কাজ শেষ হয়ে গেলে বসেরা ফোন ধরেন না। এ জন্যই শুরুতে বলেছিলাম, বসদের বিশ্বাস করবেন না।
দুই.
রাইনখোলার মোড়ে এসে রিকশাওয়ালা বললেন, ‘আর যামু না। রাস্তা ভালো না।’
নামলাম আমি। এই রাস্তা যে খারাপ, তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? এখানে দুইবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছি আমি। শেষবারের ঘটনাটা ছিল অভিনব। একটা লোক হুট করে সামনে এসে বলল, ‘এক্সকিউজ মি ভাইয়া, আপনার কাছে আপেল আছে?’
‘মানে?’
‘মানে হলো…’ চকচকে একটা ছুরি সামনে ধরল লোকটা। তারপর বলল, ‘আমার কাছে ছুরি আছে। আপেল থাকলে দেন, কাইটা দুই ভাই মিলা খাই। না থাকলে মানিব্যাগ, মোবাইল দিয়া ভাগেন।’
সেদিন আমার কাছে আপেল ছিল না, আজও নেই। আমি ভয়ে ভয়ে এগোলাম। লকডাউনের পর অনেকেই এই লাইনে নেমেছেন শুনেছি। বাজারটা পেরিয়ে সামনে এগোতেই রাস্তার বাতি খট করে নিভে আবার জ্বলে উঠল টিমটিম করে। একটা কুকুরও নেই রাস্তায়। বুঝে ফেললাম, কী হতে যাচ্ছে।
‘ভাই, একটু সাইডে আসেন।’ পাশের গলি থেকে বলে উঠল ভীষণ ভারী একটা কণ্ঠ। আমি কণ্ঠ লক্ষ করে এগিয়ে গেলাম। মানিব্যাগ, মোবাইল বের করে রাখলাম আগেই। ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ?
গলির কাছে আসতেই বিকট একটা গন্ধ বাড়ি মারল নাকে। ভেতর ঢুকে ভয়ে মাথা চক্কর দিল। দুপায়ের ভরে দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা বাঘ দাঁড়িয়ে আছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার!
তিন.
‘ভাই! ও ভাই!’
চোখ খুললাম আমি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম নাকি? তাই তো মনে হচ্ছে। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে বাঘটা। চোখ খুলতে দেখে হাসল।
‘আপনি তো মিয়া টেনশনে ফেলে দিছিলেন! মরেটরে গেলে ভালো বিপদে পড়তাম!’
তানিয়া প্রায়ই বলে আমার নাকি মাথা খারাপ। এত দিন বিশ্বাস করিনি। আজ বুঝলাম, ওর কথা মিথ্যা না।
‘ভাই ওঠেন, প্লিজ!’ আবার বলল বাঘটা।
আস্তে উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম আমি। বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে পড়েছিলাম বোধ হয়। পিঠ ভিজে গেছে।
বাঘটা আমার কাঁধে থাবা রেখে বলল, ‘একটা উপকার করবেন ভাই? অ্যাপস দিয়ে কিছু খাবার অর্ডার করবেন? চিকেন, বিফ যা পান দেন।’
‘অর্ডার করব?’
‘জি। আমি এই সব প্রযুক্তি ভালো বুঝি না। চিড়িয়াখানায় থাকি তো। সেলফিটা বুঝি, এর বেশি মাথায় ঢোকে না।’
‘বলেন কী?’
‘দেশটা চোরে ভরে গেছে, বোঝেনই তো। আমাদের জন্য বরাদ্দ খাবার এরা বেইচা দেয়। আমরা থাকি না খাইয়া। দেখেন, ওজন কত কইমা গেছে? লোকজন দেখলে ভাবে ডায়েটে আছি! আপনাদের তো এখন লকডাউন। আমরা তো আজীবনই লকডাউনে থাকি। মাঝেমধ্যে দুইটা ভালো–মন্দ খাইতে মন চায়, তখন গার্ডরে ঘুষ দিয়া বের হই। দেরি কইরেন না, অর্ডারটা দেন।’
দ্রুত অর্ডার দিলাম আমি।
‘ভাইয়ের মন খারাপ নাকি?’ বাঘটা বলল। ‘আমারে বলতে পারেন। আমার নেটওয়ার্ক অনেক ফোন কোম্পানির চেয়ে ভালো। খাঁচায় বইসা অনেক কিছু কন্ট্রোল করি।’
অফিস, সংসারসহ যাবতীয় দুঃখের কথা বলে একটু হালকা হলাম। মানুষ আজকাল কথা শোনে না, বাঘটা ঠিকই শুনল মন দিয়ে। তানিয়ার ডেঙ্গুর কথা শুনে আফসোস করল খুব। বলল, ‘মশাগুলারে কত কইলাম, সাধারণ মানুষরে কষ্ট দিস না, এগো রক্ত সবাই খায়। শোনেই না। এদের লিডারশিপ বারবার চেঞ্জ হয় তো, ভুইলা যায়।’
‘আপনি মশাদের কথাও বোঝেন?’
‘আপনার কথা বুঝি আর মশার কথা বুঝব না?’
‘তা–ও ঠিক।’
‘খাবার আসতে দেরি হয় কেন? ফোন দিয়া দেখেন তো।’
চার.
খাবার নিয়ে বাঘটার হাতে ধরিয়ে দিলাম। বাঘটা মনে হলো খুশি হয়েছে।
‘খাবার ভালো। ফাইভ স্টার দিয়েন। আর চিড়িয়াখানায় আইসেন সময় পাইলে, গল্প করব। ভিতরে ঢুইকা বামে গেলেই আমার চেম্বার।’
চলে যাওয়ার আগে হঠাৎ ঘুরে বাঘটা বলল, ‘আপনি ভালো মানুষ। আপনার কথা আমি মনে রাখব।’
রাস্তার বাতিটা খট করে নিভে আবার জ্বলে উঠল। কোথাও কেউ নেই।
বাসায় ফিরে দেখি তানিয়ার প্রচণ্ড জ্বর। দ্রুত ওর কপালে জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। দুর্বল কণ্ঠে তানিয়া বলল, ‘জানো, মশাগুলো আমাকে সরি বলেছে।’
জ্বর আসলেই বেশি। প্রলাপ বকছে তানিয়া।
বসকে এসএমএস দিয়ে অফিস গেলাম না। দুদিন পর বস ফোন করে বললেন, ‘মুনির, আমার অবস্থা তো খারাপ। ডেঙ্গু হয়েছে। তোমার ওয়াইফের কী অবস্থা?’
ফোন রাখতেই কানের কাছে কয়েকটা মশা এসে পিনপিন করে বলল, ‘কাজটা ভালো করছি না?’