আমি গল্পকার নই। শব্দ দিয়ে গল্প বলার পারদর্শিতাও নেই তেমন। তবে আমি গল্প বলতে চাই আলো-ছায়া দিয়ে। ক্যামেরা নামের এডিসনের উদ্ভাবিত সেই যন্ত্র দিয়ে।
আজ শব্দ দিয়ে গল্প লিখতে বসে নিজেই জানি না কোথা থেকে শুরু করব। বরং সিনেমা আকারেই গল্পটা বলার চেষ্টা করি। সিনেমায় প্রথমে একটা টাইটেল আসে। লেখার ক্ষেত্রে শিরোনাম। ধরা যাক, আমার গল্পের শিরোনাম ‘সগীর আলী না খেতে পেরে দড়ি হইয়া গেছে’।
হাওর এলাকার মানুষ সগীর আলী। তার ঘরে দুই মেয়ে। তার বউ পুতুল বিবি নিকলির চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঘরের কাজ করে। হাওর এলাকার লোকজন ধান চাষ ছাড়া আর তেমন কাজ করতে পারে না। বর্ষার মৌসুমে তাদের কাজ থাকে না। এ সময় উপার্জন তেমন কিছু নেই। পুতুল তাই আকাইম্মা সগীর আলীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। রিকশা চালানোর শহর ঢাকায়।
ঢাকা শহরে এত আওয়াজ আর হর্ন। সগীর আলী যেন কিছু শুনতে পায় না। আগে থেকেই বেক্কল ছিল, এখানে এসে আরও বেক্কল হয়ে ওঠে সে। রিকশার পা–পেডেল মিলিয়ে এমন ভেজাল লাগে তার, বারবার শুধু অ্যাকসিডেন্ট করে বসে। একের পর এক মহাজন বদলায়।
একদিন নর্থ সাউথ থেকে এক আপা তার রিকশায় উঠে বলে, ‘বাঁয়ে প্লিজ...ব্রো।’ সগীর আলী বুঝতে পারে না। ‘কই যাইবাম’ বলে সে ডানে চলে যায়। আর মোটরসাইকেল এসে এইছা ধাক্কা দেয়, মুহূর্তেই আপাসহ রিকশা চিতপটাং। এদিকে আপা তো কী একটা ভাষায় কথা বলতে থাকে। সগীর আলী শুধু বোঝে ‘পাক পাক’, মানে হয়তো পাকশাকজাতীয় কিছু বলছে!
মহাজন এসে রিকশা নিয়ে যায়। মহাজন সগীর আলীর সব টাকাও নিয়ে যায়। কারণ, রিকশা মেরামতের জন্য যে টাকা লাগবে, তা তো তাকেই দিতে হবে। শেষে সগীর আলীর এমন অবস্থা হয় যে বাড়ি যাওয়ার টাকাটাও থাকে না তার কাছে। অগত্যা হাঁটতে হাঁটতে নিকলি রওনা দেয় সে।
তিন দিন তিন রাত কিছু না খেয়ে ভোরের আজানের সময় বাড়িতে পৌঁছায় সগীর আলী। পুতুল বিবি তাকে দেখে তো মহাবিরক্ত। তিন সপ্তাহ যে শহরে টিকতে পারে না, তার লগে কী কথা! পুতুল সগীর আলীকে একরকম ঘর থেকেই বের করে দেয়। বলে, ‘তুই আমার ঘরে ঢুকবি না, তোর জায়গা ওই গোয়ালঘরে। এখন তো আমার গরুটাও নাই। কাম পারোস না, উপার্জন পারোস না। বাইরেই পইড়া থাক।’
ঝগড়া শেষে দুই মেয়েকে নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজে চলে যায় পুতুল।
আজ আবার চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ে। বাড়িতে অনেক কাজ। সকাল থেকে তাই নিজের বাড়ির কথা মাথায়ই থাকে না পুতুলের। এদিকে হয়েছে আরেক সমস্যা। চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে আবার এলাকার এক ক্যাডার কাম ছাত্রনেতার সঙ্গে পালিয়ে গেছে। তাই নিয়ে এখন মহা সমস্যা। পুতুল যেহেতু ওই মেয়ের দেখাশোনা করত, বাড়ি থেকে এ জন্য তাকে ছাড়ছে না। এ এক মহাবিপদ!
তিন দিন আটকে রেখে, সবকিছু মিটমাট হওয়ার পর ছাড়া হলো পুতুলকে। তিন দিন পর বাড়ি ফিরে সে দেখল, সগীর আলী যেখানে বসে ছিল, সেখানে একটা বিশাল মোটা দড়ি। সে বুঝতে পারল, তিন দিন কিছু না খেতে পেয়ে তার বেক্কল স্বামী সগীর আলী দড়ি হইয়া গেছে। এবার শুরু হলো পুতুলের আছাড়ি-পিছড়ি কান্না, ‘হায় হায়, আমি এটা কী করলাম! আমার স্বামী তো দড়ি হইয়া গেল।’
গ্রামের এক মুরব্বি এসে দেখলেন ঘটনাটা তো সত্যি। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কী কুদরত!’ কিন্তু এ দড়ির কবর দেওয়ার কোনো বিধান তো নেই। কবর যখন হলো না, তখন গ্রামের কিছু মানুষ এই কুদরতের উপকার নিতে চাইল। কেউ এসে নিজের শরীর সেই দড়ির সঙ্গে স্পর্শ করল। এক বাচ্চার মা তার অসুস্থ সন্তানকে দড়ির সামনে নিয়ে দড়ি ছোঁয়াল, যাতে তার জ্বর কমে যায়।
ধীরে ধীরে সগীর আলীর দড়ির কুদরতে গ্রামে সবাই-ই কিছু না কিছু উপকার পেতে শুরু করল। তারা কিছু কিছু টাকাপয়সাও রেখে যেতে লাগল। শহর থেকে কয়েকজন বিজ্ঞানের শিক্ষক এসে ব্যাপারটি যে অবাস্তব, তা লোকজনকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ এই গ্রামের কুদরতে কোনো কলঙ্ক লাগতে দেবে না, পারলে বর্শা আর কোঁচ দিয়ে ওই বিজ্ঞানের শিক্ষকদের দৌড়ানি দেবে। চেয়ারম্যান সাহেবকে ওই শিক্ষকেরা বোঝাতে চেষ্টা করে, কিন্তু চেয়ারম্যান বুঝতে পারে, তাকে যারা ভোট দেয়, সেই মানুষের বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া যাবে না। আবার বিপক্ষে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। তাই তিনি তাদেরকে বিদায় করে দেন।
এসব দেখে গ্রামে আসে কিছু এনজিও কর্মী। তাদের ফান্ড আবার নাকি ইথিওপিয়া থেকে এসেছে। সে দেশের না খেতে পারা মানুষদের সহায়তায় আমাদের দেশের কিছু শিক্ষিত বাটপার ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ নামের এনজিও খুলেছে। তারা এই মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা করল, এটা একটি কুদরতি দড়ি। এই দড়ি এখানে ফেলে রাখা যাবে না। এর উপকার অনেক। গ্রামের পশ্চিম পাশে একটা নালা আছে, যেখানে রাস্তা শেষ হয়। মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার সময় তাদেরকে নালায় নেমে রাস্তা পার হতে হয়। কোনোভাবে যদি দুই পাশ দিয়ে এই দড়িটা বেঁধে দেওয়া যায়, তাহলেই ছোট একটা ডিঙি নৌকা দিয়ে দড়ি ধরে ধরে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে। এটা শুনে সবাই রাজি হয়।
লাস্ট শট। সুবহে সাদিকে সূর্য ওঠে আর মেয়েরা দড়ি ধরে নালা পার হয়। সগীর আলী নামের দড়িটি দুলতে থাকে। দেখে মনে হয়, দড়িটি মিটমিট হাসছে।
পোস্ট টাইটেল শট। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ নামের এনজিও এই কাজের জন্য ইংল্যান্ডের রানির কাছ থেকে রাইট পদক পায়। তারপর তারা ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ নামে আরও একটা এনজিও খোলে। চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের জামাই এবার এমপি ইলেকশনে দাঁড়াবে। আর আমাদের পুতুল দুই মেয়েকে নিয়ে আবার হাওরের পানিতে সগীর আলীকে খোঁজার চেষ্টা করবে।