নক্ষত্র নিভে যায়
আহাদুজ্জামান মোহম্মদ আলী
প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রচ্ছদ: পল ক্লির চিত্র অবলম্বনে
১২০ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।
নক্ষত্র নিভে যায় নামের আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীর কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আহাদুজ্জামানের কবিতা পরিণত।’ আনিসুজ্জামান যথার্থই বলেছিলেন। কবি আহাদুজ্জামান সারাটা জীবন ধরে কবিতা পাঠ করেছেন, দেশি-বিদেশি; কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ফলে, কবিতার বোধ, জীবনের বোধ এবং কবিতার সাংগীতিকতা এবং রহস্যমেদুরতা তাঁর আত্মস্থ। ‘পূর্বলেখ’–এ কবি বলেছেন, ‘কবিতা অনিবার্য। কিন্তু কেন, তা যদি জানতাম!’ জাঁ ককতোর এই কথা পড়েছিলাম গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি আর্নস্ট ফিশারের দ্য নেসেসিটি অব আর্ট বইয়ে। আহাদুজ্জামানের কাব্যগ্রন্থে দুই ধরনের কবিতা আছে। প্রথম ভাগের শিরোনাম ‘খোয়ানো শব্দের লেশ’ এবং দ্বিতীয় ভাগ ‘শোক আর দ্রোহের দাগ’।
‘কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে’—রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। কিন্তু আহাদুজ্জামানের বইয়ের উৎসর্গপত্রটা উল্লেখ করি: ‘সিতারা পারভীনকে/ সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আহাদুজ্জামান তাঁর স্ত্রী—সহকর্মী জীবনসঙ্গিনীকে হারান অকালে, এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সিতারা পারভীন লোকান্তরিত হন। কবির কবিতার প্রথম ভাগে সেই বিচ্ছেদবেদনা শিল্পিতভাবে বিম্বিত হয়েছে। কবি লিখেছেন:
‘তোমার ব্যবহৃত কলম,
ব্যক্তিগত টেলিফোন ডিরেক্টরি,
তোমার বইপত্র, টুথব্রাশ, চিরুনি,
পরিধেয় বস্ত্র, বিছানার চাদর,
টুকিটাকি আরও অনেক কিছু
তোমার কাছে পৌঁছানোর পথের
গোপন খবর আমাকে বলে দেয়,
যদিও সে পথে এগোনো বড় মুশকিল।
[...]
পথের শেষ কোথায় তা জানার
সহজ কোনো উপায় কি নেই?
(‘পথের শেষ কোথায়?’)
প্রথম আলোয় আহাদুজ্জামান স্যারের ভূমিকাসমেত একটা কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবার্ট উডফক্সকে নিয়ে। বিনা অপরাধে সব মিলিয়ে ৪৫ বছর জেল খেটেছেন লুইজিয়ানার অ্যালবার্ট উডফক্স। এরপর নিজের জীবনের এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন সলিটারি শিরোনামের একটি বই।
‘অ্যালবার্ট এখনো স্বপ্ন দেখে’ শিরোনামে আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীর সেই কবিতায় পাই—
‘চার দশকের বেশি
কেটেছে জেলখানায়,
অ্যাঙ্গোলা জেলের নির্জন
ন ফুট বাই ছ ফুট সেলে
প্রতিদিন তেইশ ঘণ্টা বন্দী।
মা, তুমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতে,
অ্যালবার্ট, কবে তুমি ছাড়া পাবে?
এই করতে করতে তোমার
আয়ু গেল ফুরিয়ে,
নিউ অরলিন্সের গ্রেভইয়ার্ডে
যাওয়া হয়নি আমার,
তোমাকে গুডবাই না বলার ভার
সয়েছি বহুকাল,
বড্ড হেভিওয়েট সেই ভার।
কালেভদ্রে কেউ জানতে চাইত
কী করে কাটছে সময় সেলে,
আমি আমার মতো
নিজেকে নিয়েছি গুছিয়ে,
সেলকে রূপান্তরিত করেছি
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে,
নিঃসঙ্গ বিতর্কের প্ল্যাটফর্মে,
আইনের আলোকিত স্কুলে,
নির্যাতন আর নৈরাশ্য
তিক্ত ক্রোধ
ক্লস্ট্রোফোবিয়া
কোনো কিছুতে ভেঙে যাইনি আমি,
সেলের সালাখোঁ দিয়ে দেখতাম
রোজ ভোরবেলা
একটা সংবাদপত্রের গাড়ি
এসে দাঁড়াত,
তার জ্বলে থাকা হেডলাইট
আমাকে জানান দিত
একদিন বাইরে আসবে তুমি,
হবে সংবাদের লিড হেডলাইন,
আমি বাঙ্কে বসে
অপেক্ষা করতাম
রাতের আকাশ দেখব বলে
যেখানে তারায় তারায়
মিশে আছে আমার মা।’
এভাবে বর্ণনা করতে করতে আহাদুজ্জামান অ্যালবার্ট উডফক্সের জীবনের কঠিন বাস্তবতা উন্মোচন করেছেন ওই কবিতায়, যা শেষাবধি খুবই মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে। তাঁর এই কবিতার বইয়ের অন্য কবিতাগুলোতেও মর্মস্পর্শী নানা আলোড়ন আছে। আছে এমন কিছু চরণ, যা প্রবাদের মতো হয়ে ওঠে:
‘একই স্রোতস্বিনীতে দুবার পা ফেলা যায় না,
একই গৃহে আর ফেরা হয় না,
ভালোবাসার কথা দুবার বলা যায় না।’
আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলীর কবিতাগুলো সহজ, সারল্যমাখা। আমি বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।