‘সাধু হে, যাব না তিবেত, আমার ঘরের পাশে বন’—এই কবিতা কবি আবুল হাসান লিখে দিয়েছিলেন বুলবুল চৌধুরীকে। তারও অনেক বছর পর সূত্রাপুরের শিংটোলার বাসায় বসে কথা হচ্ছিল সেদিন। বললেন, ‘আপনে আইজ পুরানা পল্টন যাইবেন?’
‘যাইতে পারি।’
‘আমি যামু বাংলাবাজার। পাবলিশার ফোন করছিল, ধ্রুবর লগে কি আপনার দেহা হইব?’
‘হইতে পারে।’
‘হ, কী কমু! নিজের দিকে খেয়াল রাহে না, যত্ন নেয় না। আমি আর কত কমু!’
একদা ২৪ পুরানা পল্টন লেন বলে একটা বিরাট বাড়ি ছিল। সেই বিল্ডিংয়ের চারতলায় ধ্রুব এষ। সেই দিন রাতের দৃশ্য হয়তো এ রকম: যথারীতি আড্ডা জমে গেছে। বাপ্পা হয়তো গিটার বাজিয়ে গান ধরেছে, মামুন হয়তো খুব মনোযোগ দিয়ে কলমে স্কেচ করছে, মারজুক হয়তো রাস্তার জ্যামে আটকা পড়েছে, নইলে এতক্ষণে পৌঁছে যেত, মাহবুব রেজা হয়তো শসা কাটছেন, আবু সাঈদ জুবেরী বলছেন, ‘হাসন রাজার গান তো শুনছেনই, আজ আমার গান শোনাব। শুনবেন?’
‘শুনব।’
কিন্তু সেই সময়ই হয়তো দরজায় টোকা পড়ল। কেউ বলল, ‘কেউ মনে হয় আইল!’
কিন্তু সে টোকা তো ধ্রুব এষের মুখস্থ, তাই তিনি দরজা খুলতে খুলতেই বললেন, ‘আর কে!’ অর্থাৎ তিনি টোকার শব্দ ধরেই যা জানালেন এবং দরজা খোলার পর যিনি ঘরে ঢুকলেন, তিনি বুলবুল চৌধুরী। তাঁর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার, ভাবি অনেক ধরনের রান্না করা তরকারি প্রায় নিত্যদিনের মতোই করে পাঠিয়েছেন ধ্রুব এষের জন্য। এই বুলবুল চৌধুরীই হয়তো দুপুরে বলেছেন, ‘কী কমু! ছেলেটা নিজের দিকে খেয়াল রাহে না, যত্ন নেয় না। আমি আর কত কমু!’ এখন এই রাতে সেই বুলবুল চৌধুরীর কাশির দমক শেষে হয়তো তাঁকেই খুব চাপে ফেলে দেন ধ্রুব এষ, বলেন বা বলতে থাকেন, ‘এইভাবে মানুষ বাঁচে? ডাক্তার দেখাবে না, ওষুধপত্রে সামান্য টান নেই। কেমনে কী?’
ঝুঁকে বসে থাকা মানুষ বুলবুল চৌধুরী তাঁর চশমা চোখ থেকে খুলে আবার চোখে লাগাচ্ছেন। রাত ঘন হচ্ছে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ এসে মাতাল করে দিচ্ছে। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ যে মাদক, সে কি কেউ অস্বীকার করবে? এখানে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু করার আছে? হয়তো চারতলা থেকে সবাই ছাদে চলে যাচ্ছেন। উত্তম সেন বললেন, ‘মাসুক ভাই, আপনারা ছাদে যান, আমি মিথুনরে নিয়ে উঠতিছি।’ বুলবুল চৌধুরী বলেন, ‘আমার লিখতে হইব। পত্রিকার চাপে আছি। পাবলিশারের চাপ আছে মিয়া। আমি যাই, আপনেরা চাঁদে যান।’
‘চাঁদে যাব কীভাবে? আমরা কি নভোচারী নাকি?’
‘শাকিল যে কইল আপনেরা চাঁদে যান।’
‘কী বলেন বুলবুল ভাই, উত্তম সেন বলেছেন ছাদে যাইতে।’
‘ঠিক আছে, আপনেরা যান, আর সময় পাইলে শিংটোলায় আইসেন।’
বুলবুল চৌধুরী সূত্রাপুরের দিকে রওনা হলেন, ওখানেই তাঁর বাসা। একদা তাঁদের পরিবার নরসিংদী থেকে এসেছে। ওখানে সহায়-সম্পত্তি এখনো আছে। সারা জীবন লেখালেখিতে নিবিষ্ট থেকে গেলেন, অফিশিয়ালি নিবিষ্ট করেননি নিজেকে। সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। পেয়েছেন পাঠকের ভালোবাসা, স্ত্রী-সন্তানের সান্নিধ্য। কিন্তু বুলবুল চৌধুরীর মধ্যে এক ঘাপটি মারা জিপসি লুকিয়ে ছিল। মোটেও তিনি প্রথাগত সাংসারিক চরিত্রের মানুষ ছিলেন না। এই প্রশ্ন আমি আর কোনো দিন করতে পারব না যে, ‘বুলবুল ভাই, আপনি কি জিপসিদের কেউ? আপনি কি আদতেই পুরান ঢাকায় থাকেন? লক্ষ্মী যে বলল, “বাবরি চুলের মানুষটা থাকে পাহাড়ে। মাঝেমধ্যে আমার ঘরে আসে।”’ বুলবুল চৌধুরী থাকতেন নীল উপত্যকায়। সেখানে লক্ষ্মী বলে একজন সোমত্ত বালা ছিল, লক্ষ্মীর ঘরের দরজার চৌকাঠে লেখা, ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে।’
একদিন সেই ঘরের দরজার ছবি দেখেছি বুলবুল ভাইয়ের কাছে। বললাম, ‘লক্ষ্মীটা কে বুলবুল ভাই?’
টুকা কাহিনীর লেখক হাতে বানানো শলাকার মুখে আগুন দিতে দিতে বলেন, ‘যাইবেন? একদিন আপনেরে নিয়া যামু। লক্ষ্মীরে দেহায়ে আনুমনে।’
রাস্তা দিয়ে তিনি হাঁটেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যান? নীল উপত্যকা কোন দিকে? বুলবুল চৌধুরী যখন হাঁটেন, একটি হাত থাকে তাঁর প্যান্টের পকেটে ঢোকানো। সেই হাত পকেটের মধ্যেই নড়াচড়া করে। পুরু লেন্সের চশমা পরা বুলবুল চৌধুরীকে দেখে মনে হয়, গত দেড় শ বছরে তাঁর মতো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাঁটাচলা করা লোক আমরা আর দেখিনি। একাডেমি-শাসিত এই মহানগর বুলবুল চৌধুরীর বৈশিষ্ট্য একচুলও নড়াতে পারেনি। স্বজন তিনি, হারিয়ে ফেলা আপন মানুষ তিনি। আর পাব না তাঁকে? এই কথাই তো মনের মধ্যে চাপা আর্তনাদ লুকিয়ে রেখে বলছিলেন ইরাজ আহমেদ। বলছিলেন যে, ‘গত ৩০-৩৫ বছর ধরে চেনা আমাদের বুলবুল ভাই আর সত্যিই নেই?’ আবিদা নাসরিন কলি কি ইরাজ আহমেদের পাশে বসে ডুব দিচ্ছিলেন স্মৃতির পুকুরে?
একবার এক বসন্তদিনে বুলবুল চৌধুরী ও তাঁর সঙ্গে একটি বালিকা, এই দুই চরিত্র নিয়ে সারা দিন শুটিং করেছিলাম। বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে নানাভাবেই সংযোগ ঘটেছে আমার। শহীদুল জহিরের গল্প কাঁটার লোকেশন পুরান ঢাকা। ভূতের গলি বা ভজহরি সাহা স্ট্রিট, র ্যাঙ্কিন স্ট্রিট, কলতাবাজার, নারিন্দা, ধুপখোলা মাঠ—এই সব অঞ্চলে আমরা কাঁটা সিনেমার শুটিং সম্পন্ন করেছি। বুলবুল ভাইয়ের কাছে কাঁটা টিমের অনেক ঋণ থেকে গেল।
২৮ আগস্ট ঢাকায় তিনজন লেখক মারা গেছেন। রম্যলেখক আতাউর রহমান, ট্রিলার ফিকশন মাস্টার শেখ আবদুল হাকিম ও ঐতিহ্য-অভিমুখী কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী। ট্রিলার ফিকশন মাস্টার শেখ আবদুল হাকিম ও বুলবুল চৌধুরী সেই সংঘের সুহৃদ, যে দলে বাকি আর দুজন কথাসাহিত্যিক আবু সাঈদ জুবেরী ও ধ্রুব এষ। ৩০ বছর ধরে এই চতুষ্টয় নারিন্দার একটি বাড়িতে মিলিতে হতেন এবং সারা দিন তাসের দিন করে দিতেন। মুড়ি আবার ভেজে গরম-গরম অবস্থায় ঘি আর চিনিতে মিশিয়ে চিবোতেন তাঁরা। তারপর পান। পান চিবোতে ভালোবাসতেন তাঁরা। এক দিনে আড্ডার দুই সঙ্গী উধাও?
একদিন বুলবুল ভাই আমাকে বললেন, ‘মিয়া, শুটিং হইব কেমনে? একটি বালিকা টিস্যু পেপার নিয়ে একটু পরপর আমার কাছে আইব আর কইব, আসেন ঘাম মুছাইয়া দেই। আমার বন্ধু হুমায়ুন ফরীদিকে দেখছি তো, সেই রকম হইলে আমারে কইয়েন, চিন্তাভাবনা কইরা দেখুমনে।’ অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি বুলবুল চৌধুরীর বন্ধু ছিলেন। বন্ধু ছিলেন ১৯৭৫-এ প্রয়াত কবিবন্ধু আবুল হাসানেরও। এক মন্ময় তারুণ্যের ঢাকা শহরে কেটেছে তাঁদের যৌবন-অতিক্রান্ত গল্পগুলো। বুলবুল চৌধুরীর স্মৃতিচারণা থেকে যদি বলি, ‘জুবিলী স্কুলের ছাত্র ছিলাম আমরা। বাংলাবাজার ঠিক তারই পাশঘেঁষা এলাকা। তারও খানিক সামনে শ্রীশ দাস লেনের শেষ প্রান্তে ইট-সুরকির গাঁথুনিতে তোলা পুরোনো দিনের দ্বিতল বাড়িজুড়ে বিউটি বোর্ডিংয়ের অবস্থান। অন্য অংশে রাতযাপনের জন্য ভাড়ায় মিলত কামরা। এটির নিচতলার একাংশে চা-নাশতা ছাড়াও দুপুর ও রাতের খাবারদাবার মিলত। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বিউটি বোর্ডিংয়ের জানালা ডিঙিয়ে সেই দৃশ্যে চোখ গেলেও কখনো তাতে সমবেত হইনি। তাই কায়েস আহমেদের আহ্বানে বিপুল উত্তেজনা নিয়েই বিউটি বোর্ডিংয়ে পা রাখি আমি।’
এরপর তো বুলবুল চৌধুরীর লেখক হয়ে ওঠার জীবন। তাঁর ভাষায়, ‘নিজেতে তোলপাড় তোলা সেই খেয়ালের বশে পাঠ্যবইয়ের পাতা উল্টে গেলেও সব পাঠই গুলিয়ে আসে। এ সময় কলেজে যাওয়ার নাম করে সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে ফিরতাম অধিক রাতে। কখনো-সখনো লেখকদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দিতাম রাত। ক্লাসেও কমই উপস্থিত হয়েছি। মূলত লেখক-কবির সঙ্গ আমার কাম্য হয়ে উঠেছিল।’
এভাবেই আমরা পেয়েছি পরিণত লেখক বুলবুল চৌধুরীকে। অবশ্য তাঁর একটি নিকনেম আছে, ভুলভুল চৌধুরী। বুলবুল চৌধুরীর এই নামের খবর খুব বেশি লোক জানে না। যিনি জানেন বা যিনি নামটা দিয়েছিলেন, তিনি একদিন প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন, ‘ধোয়ার অন্তর্গত মানুষ কে, জানো?’
বললাম, ‘কে?’
তিনি বললেন, ‘ভুলভুল চৌধুরী।’
শুরুর দিকে সমকাল নামের একটি দৈনিকে আমি কাজ করতাম। এখানে ভুলভুল চৌধুরীকেও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম কিছুকাল। লেখক বুলবুল চৌধুরীকে মূল্যায়ন করবার যোগ্যতা আমি রাখি না। শক্তিশালী পাঠক-সমালোচক তা করবেন। আমি শুধু তাঁর সঙ্গে আমার এ জীবনে নানাভাবে যুক্ত হওয়া বা জড়িয়ে যাওয়ার টুকরো টুকরো চিত্র মনে করতে চাইলাম এবং আমি এ-ও জানি, যা লিখলাম, তা তাঁর সঙ্গে জমে থাকা স্মৃতিসমগ্রের খুব সামান্যই। হয়তো লেখাটি প্রকাশ হওয়ামাত্রই আমার মনে পড়তে থাকবে সেই সব স্মৃতি, যা নির্জন ঝিলের মতো থমকে থাকে সারা দুপুর, হয়তো যত দিন আমাদের বেঁচে থাকা হবে, হঠাৎ হঠাৎ আড্ডায় এসে শরীরকে খুব ঝুঁকিয়ে বসবেন, বলবেন, ‘একটা গল্প শুরু করছি। শোনেন...।’ বুলবুল ভাই লেখা হয়ে যাওয়া কয়েক পৃষ্ঠা গল্প শোনাবেন, আর লেখা যা হওয়া বাকিটা, তিনি মুখে মুখেই শোনাবেন। এ রকম কত হয়েছে তাঁর সঙ্গে। সব কি আর এক চাহনিতে মনে পড়ে?