বিকেলটা আর বিকেল থাকল না, রক্তদহের বিলের মতো শুকিয়ে আধমরা হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়েছি মাত্র, ভাদ্রের আকাশে হলুদ আলোর বন্যা, আর ঠিক তখনই মায়ের ফোন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা হয়, মায়ের ফোন পেলে বিকেলগুলো মরে যায়। মায়ের ফোনকল যেন জীবনসুধা শুষে নেওয়ার অদ্ভুত এক যন্ত্র। আমি রিসিভ করলাম। মা বললেন, অফিস থেকে বেরিয়েছিস বাবা?
জবাবে বললাম, হুঁ।
মা বলল, আসার পথে একটু সিলিন্ডারের দোকান হয়ে আসিস। তোর আব্বার...।
কথা শেষ হলো না। কেটে গেল। অনুমান করি, মায়ের ফোনের ব্যালান্স শেষ হয়ে গেছে। গত পরশু কুড়ি টাকা ভরে দিয়েছিলাম। কুড়ি টাকা দিয়ে আর কত দিন? আমার এখন উচিত ফোনকল ব্যাক করা। আব্বার কী হয়েছে জানা দরকার। শ্বাসকষ্ট কি বেড়ে গেছে? হাসপাতালে নিতে হবে? বাসায় তো অক্সিজেনের সিলিন্ডার আছেই। নাকি সেটাও শেষ?
শেষ হওয়া অবশ্য বিচিত্র কিছু নয়। আব্বা ইদানীং একটু বেশিই অক্সিজেন খরচ করছেন। বয়স হলে যা হয়। খাঁই খাঁই স্বভাব বাড়ে। যতই বোঝানোর চেষ্টা করি, একজনের বেতন দিয়ে পাঁচজনের সংসার চালানো যায় না, খুব কষ্ট হয়, কে শোনে কার কথা? মা বলে, তিনি বেশি খান না। কিন্তু ছোট বোন মুনিয়া সেদিন ফিসফিস করে যা জানাল, তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ! মা নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে অক্সিজেন খান! ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পাঁচজনের সংসারে এক সিলিন্ডার দিয়ে এক মাসও যাচ্ছে না।
ইনহেলার আমাদের কাছে এখন ডালভাত। যত্রতত্র দেখা মেলে ইনহেলারের দোকান। ছোট্ট একটা ইনহেলার মুখে ঢুকিয়ে দুটো পাফ নিয়ে বুকভরে শ্বাস নিলাম। অবস্থা যা হয়েছে, প্রত্যেকের পকেটে পকেটে এখন অক্সিজেনের ইনহেলার। যারা একটু সামর্থ্যবান, সবার ঘরে ঘরে আছে অক্সিজেনের সিলিন্ডার। ঘরে–বাইরে কোথাও গাছ নেই। অক্সিজেন আসবে কোত্থেকে?
মোবাইল ফোনে মায়ের নম্বরে ডায়াল করতে চাই আমি। আব্বার কী হয়েছে জানা প্রয়োজন। যদি গুরুতর অসুস্থ হন, কালবিলম্ব না করে এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে আমাকে। বড় ছেলে হিসেবে এটাই এখন আমার কর্তব্য। কিন্তু পৃথিবীর সব সন্তান কি কর্তব্য পালন করছে? এই তো সেদিন কোনো এক ভাগাড়ে এক বৃদ্ধ মাকে ফেলে গেছে তার ছেলেরা। আহা রে! নিঃসন্দেহে এটা একটা খারাপ উদাহরণ। কিন্তু এই খারাপ উদাহরণটাই কেন মনে পড়ল? ভালো উদাহরণও তো আছে। অনেক ছেলেমেয়েই তো মা–বাবার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে। সেসব কেন মনে পড়ল না?
মনের মধ্যে মল্লযুদ্ধ চলে আমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পকেট থেকে ইনহেলার বের করে পরপর তেরোটা পাফ নিই। তারপর দেখি, ইনহেলার আর কাজ করছে না। অক্সিজেন শেষ হয়ে গেছে। ফুটপাতের পাশে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে থাকা ইনহেলার রিচার্জারের কাছ থেকে ইনহেলার রিফিল করে নিই আমি। আগে রাস্তার পাশে এভাবে মোবাইলের রিচার্জাররা বসে থাকত। তাদের কাছ থেকে মোবাইলে টাকা রিচার্জ করা যেত। এখন অক্সিজেনের রিচার্জাররা বসে থাকে।
ইনহেলার মুখে পুরে আরও দুটো পাফ নিয়ে ধাতস্থ হই। মনে পড়ে, ভালোবাসার সমান বয়সী এক বালিকা—যার নাম তরু—যাকে আমি ভালোবাসি বলে নিজেই নিজের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়ে রেখেছি, সেই তরু একদিন আমাকে শিমুল তুলোর মতো নরম গলায় বলেছিল, আমাকে একটা বেলিফুলগাছের অক্সিজেনের ইনহেলার কিনে দেবে? আমি ‘দেব’ বললেও আজও কিনে দিতে পারিনি। ছোট বোনটার বিয়ে আটকে আছে নিমগাছের অক্সিজেনওয়ালা দুটো প্রমাণ সাইজের সিলিন্ডার উপহার দেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করতে পারছি না বলে। না না, এটা যৌতুক-টৌতুক ধরনের কিছু নয়, আগে যেমন বিয়ের সময় কনের ঘর সাজিয়ে দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল—এই ধরুন টিভি, ফ্রিজ, ফার্নিচার ইত্যাদি; এখন সেখানে অক্সিজেনের সিলিন্ডার দিতে হয়। সময়ের সঙ্গে কত কিছুই তো বদলায়। এখন ভালোবাসায়, কর্তব্যে, আবেগে, আবদারে, ব্যবসায়, ছলনায়—সবকিছুতেই সিলিন্ডার। অক্সিজেনের সিলিন্ডার!
হাঁটতে হাঁটতে বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি আমি। মাকে একটা ফোন করি। সংসারের অন্য কিছুও তো প্রয়োজন হতে পারে। হয়তো তেল নেই। কিংবা গুঁড়া মরিচ শেষ হয়ে গেছে। আমার ফোন শব্দ করতেই ধড়ফড় করে ফোন ধরে মা। কণ্ঠে হাঁপানির সুর। বলে, জলদি আয়। তোর উকিল চাচা কখন থেকে বসে আছে!
মা ইদানীং কথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলে। তারও তো বয়স হলো! আমি যখন অফিস থেকে বের হই তখন মা ফোন করে সিলিন্ডারের কথা বলেছিল। আর এখন বলছে উকিল চাচার কথা। উকিল চাচা এল কোত্থেকে?
বাসায় ঢুকে দেখি সত্যি সত্যি উকিল চাচা বসে আছেন। আব্বা বসে আছেন। মা বসে আছে তাদের পাশে। ছোট দুই বোনও বসে আছে। ঘটনা কী? সবাই কিসের আয়োজন করছে?
তারপর উকিল চাচা ও আব্বার কাছ থেকে যা শুনলাম, তাতে আমার চোখে পানি চলে এল। আমাদের বাড়ির উঠোনের এক কোনায় একটা নিমগাছ আছে। ঢাকা শহরে তো বটেই, আশপাশের দশ জেলার মধ্যে একমাত্র গাছ। সেই গাছ আব্বা আমাদের তিন ভাই–বোনের নামে উইল করে দিচ্ছেন। আব্বার কথা, অদূর ভবিষ্যতে এই গাছ নিয়ে আমাদের মধ্যে ভীষণ ক্যাচাল হবে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ তো হবেই, চাই কি খুনখারাবি-রক্তপাত ঘটে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। এসব যেন না ঘটে, সে জন্য উকিল চাচাকে ডেকে এনেছেন। উকিল চাচা আমাদের নামে সমানভাবে ভাগ করে উইল তৈরি করেছেন। সবার স্বাক্ষর দেওয়া শেষ। আমারটা কেবল বাকি।
উইলপত্র হাতে নিয়ে কোথায় যেন ডুবে যেতে থাকলাম আমি। চোখ ভারী হয়ে এল। এ রকম হয়, যখন গভীর আবেগ আমাকে গ্রাস করে, আমি তখন চোখ খুলে থাকতে পারি না।