হাওয়া বয় শনশন, তারারা কাঁপে

করোনার এই সময়ে একটা পুরো বছর মৃতদেহ, ক্ষুধা, বন্দিত্ব নিয়ে আশা-নিরাশার টালমাটাল নিদানের কাল কাটিয়েছে মানুষ। এখন আবার বেড়েছে মৃত্যুর পারদ। দেশে কঠোরভাবে শুরু হয়েছে লকডাউন। গোটা করোনাকালকে ফিরে দেখার প্রয়াসে এ লেখা।

মঙ্গল গ্রহের লাল মাটি ভেদ করে চিরে যাওয়া হাজার–ক্রোশী একটা খাল আছে। সেই খালে জাল ফেলে বোয়াল মাছ ধরেন এক জেলে। এমনটাই জানালেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষের কবিতায়। দেখতে পাই অমিত বলছে, ‘কিন্তু লিলি, কোটি কোটি যুগের পর যদি দৈবাৎ তোমাতে-আমাতে মঙ্গল গ্রহের লাল অরণ্যের ছায়ায় তার কোনো একটা হাজার-ক্রোশী খালের ধারে মুখোমুখি দেখা হয়, আর যদি শকুন্তলার সেই জেলেটা বোয়াল মাছের পেট চিরে আজকের এই অপরূপ সোনার মুহূর্তটিকে আমাদের সামনে এনে ধরে, চমকে উঠে মুখ চাওয়াচাওয়ি করব।’ লেখক-কবি এমন ফিউচারিস্টিক কল্পলোকে যাবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী! রবীন্দ্রনাথ যেতেন। এসব কারণে এই শ্মশ্রুমণ্ডিত লেখকের কাছে ফিরে ফিরে আসতে হয় আমাদের।

ধু ধু লাল মাটির সেই গ্রহে গিয়ে, গ্রহান্তরের সেই ধীবরকে সঙ্গে নিয়ে, মঙ্গলের ঠিক কিনারায় দাঁড়িয়ে দূর মহাশূন্যে খুব বিপজ্জনকভাবে ভেসে থাকা নীল পৃথিবীটাকে কৌতূহলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কী ভীষণ নিরালম্ব লাগে। দূরে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে ওনাকে বলি, ওই যে দেখুন, পৃথিবী গ্রহবাসী এ মুহূর্তে কী ভীষণ থতমত খেয়ে বসে আছে। কী ভীষণ বিহ্বল তারা। পৃথিবীর বাতাসে এখন ফুলের গন্ধ আর হাহাকার মিলেমিশে আছে। একটা অণুজীব মানুষের ন্যানো টেকনোলজির অহংকেও ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। জন্মের রহস্যময় সহোদরার মতো মৃত্যু এখন মানুষকে অনুসরণ করছে পায়ে-পায়ে। একটা পুরো বছর মৃতদেহ, ক্ষুধা, বন্দিত্ব নিয়ে আশা-নিরাশার টালমাটাল নিদানের কাল কাটিয়েছে মানুষ। ভেবেছে, আতশবাজি দিয়ে পুরোনো বছরের স্মৃতিকে পুড়িয়ে দেবে সে। মঙ্গল গ্রহের জেলেভাইকে বলি, মানুষ তা পারেনি, ভ্রাত। জিন-পরির মতো সেই অণুজীব আমাদের সঙ্গে সমান্তরাল এক পৃথিবীতে সদম্ভে চলেছেন। আমাদের বলছেন, পৃথিবী শুধু তোমার না, আমারও। ঢেউ তুলছেন তিনি। মৃত্যুর ঢেউ। প্রথম পেরিয়ে দ্বিতীয়, দ্বিতীয় পেরিয়ে তৃতীয়। নিদানকাল কাটছে না মানুষের। কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। টুপটাপ টুপ করে আশপাশ থেকে ঝরে পড়ছে জীবন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ভেন্টিলেটর চালু থাকতে থাকতেই মারা যাচ্ছেন চৌকস সিইও। মারা যাচ্ছেন চামেলি হাতের নিম্নমানের মানুষ। আর কতটা ভার বহন করা যায়? চারদিকে মানুষকে খুব অভাগা দেখাচ্ছে, বিভ্রান্ত, ভীত দেখাচ্ছে।

প্রাচীন ধীবর আমাকে বলেন, মৃত্যুকে আপনি বুঝতে পারবেন না, বৎস। সে আশা ছেড়ে দিন, তাকে কী করে মেনে নিতে হয়, সেটা বরং শিখুন। তবে এই যে পৃথিবীর সব মানুষ এভাবে একই সঙ্গে, একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এ বড় অভূতপূর্ব ব্যাপার। প্রশ্ন থেকে যায়, জীবন বদলে দেওয়া এই প্রবল পরাক্রমশালী ঘটনায় মানুষ কি নিজেকে আবিষ্কার করছে নতুন করে? আমি বলি, ওই যে ফুটপাতের পাশে বেলুনঅলার মেশিন থেকে ঊর্ধ্বমুখী লাল-নীল বেলুনগুলো শহরে ফুটে আছে রডোডেনড্রনের মতো, সেই বেলুনঅলার নিজেকে আবিষ্কারের আর সুযোগ কই? তার আর ভয়ের ফুরসত কই? তার চারপাশে নতমুখ মানুষ। তাঁদের কারও কারও মুখে মুখোশ, কারও মুখে নেই। তাঁরা সবাই বেলুনঅলার মতো ভয়ের ব্যাকরণ ভুলে যেতে বাধ্য নন, তবু তাঁরা ভুলে গেছেন। তাঁরা বোকা বোকা সাহস নিয়ে ছোট্ট গোল রুটির মতো বেরিয়ে পড়েছেন জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার শূন্য করবেন বলে। অথচ আমরা তো জানি, প্রাচীন মহামারির কালে প্রবাদ প্রচলিত ছিল, ‘যারা ভয় পায় তারাই দীর্ঘজীবী হয়।’

কথা এই যে মহামারিকালে অবাধ চলাচলের ব্যক্তিস্বাধীনতা আসলে আত্মঘাতী। আবার বন্দিত্বও তো আত্মঘাতী কারও কারও কাছে। ফলে, এমন ক্রান্তিকালে প্রহেলিকা ভর করে আমাদের চারদিকে। আমরা বুঝি, যৌক্তিকতা একধরনের চিন্তা বটে, কিন্তু চিন্তা করে কিছু বের করাই যুক্তি নয়। গ্রহান্তরের জেলেভাইকে বলি, ভ্রাত, আমরা বলেছিলাম, মহামারির প্রাণভোমরা হাসপাতালে নেই, ওষুধে নেই, আছে এক মানুষের কাছ থেকে অন্য মানুষের মাঝখানের যে আকাশ, সেখানে। আছে জনপরিসরে। সেখানেই ঘাড় মটকাতে হবে তার। কিন্তু সে কথা যাদের শুনবার, তারা দাঁড়ে বসা ময়না। তারা কথা কয় না। ফলে নিশ্চিন্তে, উল্লাসে লাফিয়ে বেড়ায় ব্যাঙ, ঝোপের আড়ালে যে ওত পেতে আছে ঢোঁড়া, সেই দুঃসংবাদ সে জানে না। গ্রিক পুরাণের ডেডালাস তাঁর পুত্র ইকারুসকে দুটো পাখা বানিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, বাবারে, উড়ে পালিয়ে যা এই কারাগার থেকে, তবে সাবধানে উড়িস। খুব বেশি উঁচুতে উঠলে সূর্যের তাপে পুড়ে যাবি, আর খুব বেশি নিচ দিয়ে উড়লে জোয়ারের জল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তোকে।

অনন্তজীবী মঙ্গলের ধীবর আমাকে বলেন, দাঁড়ের কোন ময়না কথা কইবে, আর কোনটা কথা কইবে না, তা নগরের সবচেয়ে উঁচু দালানটি দেখলেই বোঝা যায়। মধ্যযুগে দেখেছি, পৃথিবীর আকাশের সবচেয়ে উঁচু স্পর্শ করে আছে গির্জা, ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেখলাম রাজপ্রাসাদ, আজকাল দেখি সবচেয়ে নাক–উঁচু সব বাণিজ্য ভবনের। আমি মঙ্গলের জেলেভাইকে বলি, তথাস্তু। এই মহামারিতে মানুষ যখন দুর্দশার পাতালে, মানুষ যখন মৃত্যুকূপের ভেতর নাভিশ্বাসে কাতরাচ্ছে, ঠিক তখন তাদের বিপদ, তাদের শোককে খুঁচিয়ে বাণিজ্য করা শেষে শিস দিতে দিতে চলে গেছে বহু মানুষ। তাকে বলি, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল যে শ্মশ্রুমণ্ডিত লেখক, তিনি একবার বলেছিলেন, ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ আপনি মঙ্গল গ্রহে বোয়াল মাছ শিকার করতে করতে কথাটা কি বিশ্বাস করেন, ভ্রাত? আপনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের কথা বলছিলেন। কে কাকে আবিষ্কার করবে, জনাব? সবাই এখন নিজেকে পেয়ে গেছেন। তাঁরা কেবল আত্মপ্রেম, আত্মতৃপ্তিতে অন্যদের একটু একটু করে থলের ভেতর থেকে বের করে মোহরের মতো সত্য বিতরণ করেন। না, সবাই করেন না বটে। তবে যাঁরা করেন না, তাঁরা বিপদে আছেন। দ্য ইডিয়টের সেই বিখ্যাত পার্টিদৃশ্যের মতো কে আর আছে যে একটু আলতো করে আঙুল দিয়ে ঠেলা দিয়ে ফুলদানিটা মেঝেতে ফেলে দেবে? চুরমার হয়ে যাবে ফুলদানি। ভেঙে যাবে মিথ্যা আলাপ, মিথ্যা মানুষ, মিথ্যা কারবারির পার্টি।

মঙ্গলের জেলে বলেন, কিন্তু ঝড়ের সময়েই তো ঝাউগাছ তার শক্তি দেখায়। মানুষ দেখাবে না? আমি বলি, আমারও তো সেই কথা, ভায়া। এখন একটা থমথমে কাল। ‘নিস্তরঙ্গ কালো জলে বাইনার নাও ভাসে।’ কিন্তু এই যে বানের জলে ভেসে গেল, ভেসে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্ন, ঝড় থামলে তাদের ছাদের ওপর উঠবে নাকি বিখ্যাত চাঁদ? এই করোনা-সাগর পাড়ি দিয়ে যারা ওই পারে পৌঁছাবে, তারা কি ভবিষ্যতে আরও বিবেচক হবে না? জীবনের চিন্তা আর অপচিন্তার ছটফটানির ভেতর বনজঙ্গলের ছায়া নেমে আসবে নাকি তাদের জীবনে? জুম, গুগল মিট, স্ট্রিম ইয়ার্ডের আশ্চর্য উদ্বোধন সত্ত্বেও তারা কি টের পাবে না মুখোমুখি বসে এক কাপ চা খাওয়ার মতো অকিঞ্চিৎকর ঘটনার মাধুর্য? মহামারি কি নতুন করে আমাদের চেনাবে প্রেম? করোনার ওপারে প্রেমিক-প্রেমিকা একে অন্যকে কি বলবে, ‘কুসুম, শুধু ইনফরমেশন আর ইনফরমেশন, তোমার কাছে আইডিয়া নাই?’ তখন কেউ একজন কি গাইবে, ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তা না না না।’ তারা কি আরও আরও কবিতা পড়বে? তারা কি টের পাবে কোনো কোনো ভোরে আশ্চর্য কোনো কবিতা পড়লে মনে হয় পৃথিবীতে রাত বলে কিছু ছিল না। ভোরের বাতাসে কি কান্না পাবে তাদের? মনের ভেতর মৃদু, শান্ত, সমুজ্জ্বল একটা ঝিলের জন্ম হবে কি? মানুষ তখন কি শুধু আধুনিক না হয়ে শাশ্বত হতে চাইবে? তারা কি জন্ম, ভালোবাসা, মৃত্যু এবং নিশ্বাস থেকে নিশ্বাসে যাওয়ার মাঝখানের বেদনাগুলোকে আরও একটু ভালোভাবে জানবে পারবে, বুঝতে পারবে?

মঙ্গলের জেলে আমাকে বলেন, শোনো রে ভাই, শেষ কথা এই যে মানুষ বস্তুত খুব নাজুক। খুব ঠুনকো একটা প্রাণী সে। সে আসলে তালপাতার সেপাই। সে আসলে খুব ক্ষুদ্র একটা নিষ্প্রয়োজন। সবাই সে কথা জানে না। না জানুক। অন্তত তুমি জানো।

আমরা যখন কথা বলি, মঙ্গল গ্রহে তখন রাত নামে। সেখানেও বাতাস বয়, সেখান থেকেও মহাশূন্যে আকাশভরা তারা দেখা যায়। গ্রহের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমি বলি, মানুষ বড় ক্লান্ত জেলেভাই। তার একটু বিশ্রাম দরকার। মানুষের জন্য মায়া হয় আমার। জেলেভাইকে একটা কবিতা শোনাতে ইচ্ছা হয়। আমি মঙ্গলের লাল মাটিতে, হাজার-ক্রোশী খালের পারে দাঁড়িয়ে আওড়াই:

‘হওয়া বয় শনশন, তারারা কাঁপে

হৃদয়ে কি জং ধরে পুরানো খাপে?’