হিমালয়ের কান্না

দুই মেরুর বাইরে সবচেয়ে বেশি বরফ ধারণ করে রেখেছে হিমালয় পর্বতমালা। মানুষেরই নানা অত্যাচারে গলতে শুরু করেছে সেই বরফ। নেপাল থেকে ফিরে সেই বরফ গলার বর্তমান চেহারা ও ভবিষ্যত্ শঙ্কার গল্প শুনিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদআকাশ থেকেই হিমালয়ের বুক থেকে নেমে আসা জলের ধারা চোখে পড়ল। পাশ থেকে কেউ একজন বললেন, হিমালয় কাঁদছে। এই কান্না আনন্দ না বেদনার, তা ভেবে দেখার ফুসরত কারও নেই। সবাই দেখছে হিমালয়ের মন ভোলানো রূপ।এই রূপ দর্শনের মধ্যেই নেপালি যুবক পিতাম্বর ভুসাল মুখটা কালো করে বলে উঠলেন, ‘এই কান্না পুরো পৃথিবীর জন্য শোকের এবং ভয়ের।’ আসলেই তা-ই। অসতর্ক এই পৃথিবীবাসীর হয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে হিমালয়। এখনই সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়লে কাঁদতে হবে পৃথিবীবাসীকেও।এই কান্নার কথা আর হিমালয় বিপর্যয়ের কথাই আমরা জানতে গিয়েছিলাম কাঠমান্ডুতে। ‘আর্থ জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক’ নামের একটা সংগঠন বিপাকের মধ্যে থাকা হিমালয় সম্পর্কে আয়োজন করেছিলেন একটা কর্মশালার। এই কর্মশালায় বিপদের কথা যেমন বলা হলো, বলা হলো সতর্কতার কথাও। আর নেপালিরা বলল তাদের আতঙ্কের কথা।বরফ গলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় হিমালয়ের পাশের হ্রদগুলো দ্রুত বড় হচ্ছে। হ্রদের টলটলে পানির অপার সৌন্দর্য দেখতে সারা দুনিয়া থেকে পর্যটকের দল ধেয়ে আসছে। কিন্তু নেপালিরা এই বরফ গলা বেড়ে যাওয়া নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত। পিতাম্বর অবশ্য বললেন, ‘ভয় তোমাদেরও আছে। যত বেশি বরফ গলবে, তোমাদের দেশে বন্যার পরিমাণ তত বাড়বে। আর যে ২০টি হ্রদ বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা হলেও রক্ষা নেই। তোমাদের বাংলাদেশ হয়েই তা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাবে। যাওয়ার পথে পথে রেখে যাবে ধ্বংসস্তূপ।’নেপালের পর্বত ও হিমবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন প্রদীপ মুন। তিনি জানালেন, এই ১৫-২০ বছর আগেও হিমালয়ের তাবোচি পর্বতশৃঙ্গ পুরোপুরি বরফে আচ্ছাদিত ছিল। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে অল্প কিছুদিনের জন্য বরফ সরে গিয়ে পর্বতশৃঙ্গটি দেখা যেত। এখন পুরো পর্বতচূড়াটি সারা বছরই দেখা যায়।মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিবছর পৃথিবীর সমতল এলাকার তাপমাত্রা দশমিক ০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ছে। ৫০ বছর ধরে হিমালয়ের উঁচু এলাকায় সমতলের চেয়ে ছয় গুণ বেশি হারে তাপমাত্রা বাড়ছে। দক্ষিণ এশীয় সমন্বিত পর্বত উন্নয়ন কর্মসূচি—ইসিমুডের এক হিসাবে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।নেপালের প্রধানমন্ত্রী মাধবকুমার নেপাল নিজেই জানালেন, হিমালয়ের তিন হাজার ২৫০টি হিমবাহ গলতে শুরু করেছে। এখানকার বরফ গলার হার যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু তাতেও মানুষের হূদয় গলছে না। মানুষ প্রতিদিনই কার্বন নির্গত করে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হিমালয়ের বরফ গলে সৃষ্টি হওয়া হ্রদগুলোও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে। লক্ষ-কোটি বছর ধরে প্রাকৃতিক নিয়মে এই হ্রদগুলো থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে উপত্যকাগুলো হয়ে সমতল দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ত। কিন্তু বরফ গলার হার বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর পর পরই হ্রদ বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটছে।গত ৩৫ বছরে হিমালয়ের ৩০টি হ্রদ বিস্ফোরিত হয়েছে। ইসিমুডের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০টি হ্রদ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এর মধ্যে ছয়টি হ্রদ যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। এই হ্রদগুলো বিস্ফোরিত হলে প্রায় হিমালয়ের ভাটিতে অবস্থানরত ৩০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।১৯৫৪ সালে তিব্বতের কাছে ওয়াং কু হ্রদ বিস্ফোরণের ঘটনাটি এ যাবত্কালের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল। হ্রদটি বিস্ফোরণের পর পাঁচ হাজার ২৫০ মিটার উঁচু থেকে প্রায় তিন মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ব্রহ্মপুত্র নদে এসে পড়েছিল। এতে চীনের গায়ানজ শহর পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে যায়।১৯৮১ সালে নেপাল-চীন সীমান্ত এলাকার ঝাংঝাংবো হ্রদ বিস্ফোরণে নেপালের সানকোসি জলবিদ্যুেকন্দ্র, ফ্রেন্ডশিপ সেতুসহ প্রচুর অবকাঠামো পানির তোড়ে ভেসে যায়। আর্থিক হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ তিন মিলিয়ন ডলার। পরের বছর ডিমটুসো হ্রদ বিস্ফোরিত হলে নাসচি জলবিদ্যুেকন্দ্রসহ ১৪টি ছোট সেতু ধ্বংস হয়। ১৯৯৪ সালে ভুটানের লুগ হ্রদ বিস্ফোরণে প্রচুর অবকাঠামো পানির তোড়ে ভেসে যায় এবং ২০ জন মারা যায়।তবে ঝুঁকিতে থাকা হ্রদ বিস্ফোরিত হলে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে, তার কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত করা হয়নি। ভারত ও নেপাল সরকার মিলে এ বিষয়ে একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালানোর ব্যাপারে সম্প্রতি রাজি হয়েছে।ইসিমুডের হিমবাহ বিশেষজ্ঞ প্রদীপ মুন আশঙ্কার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, এখন যে হিমবাহগুলো ঝুঁকিতে আছে, তা বিস্ফোরিত হলে বসতি এলাকা বেশি তলাবে। ফলে মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি বেশি হবে। বরফ গলে হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গ নগ্ন হয়ে যাওয়ায় রোগবালাই বেড়ে যাওয়া ও প্রতিবেশব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকবে।মানুষ এই বিপর্যয় নিয়ে যেন মাথা ঘামাতেই রাজি না। সমতল বা শহরে কার্বন নির্গত করেই মানুষ ক্ষান্ত হয়নি। উঁচু পর্বতেও তারা এই কার্বন পৌঁছে দিচ্ছে। হিমালয়ের বুক থেকে কেটে নিচ্ছে গাছ-গুল্ম-লতা। বিরান করে ফেলেছে হিমালয়ের অনেক বন। পৃথিবীর অন্যতম নদী ও পানির উত্স হওয়া সত্ত্বেও শীত ও বসন্তে হিমালয়ের বুক ফেটে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে শুষ্ক বনে তৈরি হচ্ছে দাবানল। এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটার বন দাবানলের কারণে পুড়েছে।হিমালয় অঞ্চলের দেশগুলো থেকে দাবি তোলা হয়েছে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোকে ২৫ বছরের মধ্যে কার্বনের পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমাতে হবে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো বলছে, আমরা কার্বন কমাব না। তোমরা বরং আমাদের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে যাও। তোমাদের দেশের মানুষকে বলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে সমস্যাগুলো হবে, তা মোকাবিলা করে কীভাবে টিকে থাকা যায়, সেই চেষ্টা করো।হিমালয়কেন্দ্রিক আরেকটি গবেষণা সংস্থা চায়না ডায়ালগের বিজ্ঞানীরা আরও মারাত্মক আশঙ্কার কথা বলছেন। সম্প্রতি তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন হিমালয় ও তিব্বতের মালভূমি এলাকার আকাশে বাদামি মেঘ (ব্রাউন ক্লাউড) দেখা যাচ্ছে। এই মেঘগুলো হিমবাহে আঘাত করে বরফ গলার হার দ্বিগুণ করে দিচ্ছে। বাদামি মেঘ সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দুই হাজার মিটার উঁচু এলাকায় ডিজেল-পেট্রলের ধোঁয়া, কারখানা থেকে সৃষ্টি হওয়া কার্বনকে দায়ী করছেন। এই ধোঁয়াগুলো বায়ুমণ্ডলের স্পর্শকাতর স্থানে প্রবেশ করে মিথস্ক্রিয়া ঘটাচ্ছে। তৈরি করছে মারাত্মক দূষিত বাদামি মেঘ। হিমালয় অঞ্চলের আগামী দিনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে এই বাদামি মেঘকে চিহ্নিত করছেন এ অঞ্চলের বিজ্ঞানীরা।জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেল—আইপিসিসির বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী সৃষ্টির পর এ পর্যন্ত হিমালয়ের ৬৭ শতাংশ বরফ গলে গেছে। ১০০ বছরের মধ্যে বাকি বরফ গলে যাবে। বিশেষ করে ৩০ বছরের মধ্যে বরফ গলার হার মারাত্মকভাবে বেড়ে যাবে। ফলে এর ভাটির দেশগুলোতে বন্যা বাড়বে। বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপের মতো দেশ মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হবে।নেপালিরা নিজেদের পৃথিবীর ছাদের বাসিন্দা বলে থাকে। অনেকে বলে, আমরা তো সাগরমাতা। বিজ্ঞানীরা বলেন, হিমালয়ের পর্বতমালা পৃথিবীর ভূ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। হিমালয়ের পর্বতগুলো পাঁচ হাজার ৩১০ বর্গকিলোমিটার বরফ দিয়ে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। ১০০ বছরের মধ্যে এই হিমবাহগুলো গলে গেলে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে এ অঞ্চলের সব দেশে।হিমালয়, তিব্বত ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা এলাকার সাতটি দেশ চীন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ তাই পর্বতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভুটান, ভারত ও নেপাল হ্রদ বিস্ফোরণের আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। নেপালের টুসো রলপা ও টামা কোসি এলাকায় পূর্বাভাসযন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। অন্য এলাকাগুলোতেও একই যন্ত্র বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী মাধবকুমার নেপাল বললেন, হিমালয় নিয়ে তাঁরা হিমালয়ের নদীগুলোর উজান-ভাটির সব দেশের মধ্যে ঐক্য চান।কর্মশালায় বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদেরা বললেন অনেক কিছু। শেখাতে চাইলেন জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক। কিন্তু সবচেয়ে বড় শিক্ষক হিসেবে প্রকৃতিই যেন সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল। জানিয়ে দিল মানুষ কীভাবে তার সৌন্দর্য, সম্পদ নিংড়ে সভ্যতা তৈরি করেছে। সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে ছাড়ছে কার্বন বিষ। বাড়িয়ে ফেলছে উষ্ণতা। ডেকে আনছে সভ্যতার মৃত্যুঘণ্টা। হিমালয়ের বরফ গলতে থাকা তারই একটি প্রাথমিক পূর্বাভাস। আমরা মানুষেরা কি হিমালয়ের কান্না শুনতে পাচ্ছি? না পেলে নিজেদেরই কান্নার প্রস্তুতি নেওয়া ভালো!