'নিয়তির হাতে শুধু মৃত্যুকেই রেখেছি'

ফুল, পাখি, নদী, নৌকা, মানুষ, গ্রাম—বাংলাদেশই কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকলা। তাঁর তুলনা তিনিই। ছবির ক্যানভাসে যেমন, তেমনি বইয়ের প্রচ্ছদ ও নকশায়ও নির্মাণ করেছেন অনন্য রুচি। চিত্রকলার বাইরে লেখালেখি, সংগীতসহ নানা বিষয়েই ছিল তাঁর বিস্তার। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন দেশবরেণ্য এই শিল্পী। তাঁকে নিয়ে আয়োজন

কাইয়ুম চৌধুরীর ড্রইং
কাইয়ুম চৌধুরীর ড্রইং

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে শেষবার দেখা হয় গত ২৪ নভেম্বর বিকেল চারটায় কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সেমিনার কক্ষে। সেদিন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসার আত্মজীবনী আমার বেলা যে যায় গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন অতিথি হয়ে। সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল প্রথমা প্রকাশন।
আমাদের মূসা ভাইয়ের এই বইয়ের ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ ছিল কাইয়ুম ভাইয়ের। বইয়ের প্রচ্ছদটি তাঁরই আঁকা। তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়ের। সেদিনের অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের সহযাত্রী এবিএম মূসার কথা বলেছেন, করেছেন নানা সময়ের স্মৃতিচারণা। জীবনের আনন্দ-দুঃখ-বেদনার সময়গুলোতে কীভাবে একে অপরের কাছাকাছি থেকেছেন—সেসব কথা শুনিয়েছেন আমাদের কাইয়ুম ভাই।

আত্মপ্রতিকৃতি, কাইয়ুম চৌধুরী। জন্ম: ৯ মার্চ ১৯৩২—মৃত্যু: ৩০ নভেম্বর ২০১৪
আত্মপ্রতিকৃতি, কাইয়ুম চৌধুরী। জন্ম: ৯ মার্চ ১৯৩২—মৃত্যু: ৩০ নভেম্বর ২০১৪

পরের দিন জাপানের হিরোশিমা শহরে যাই এক সম্মেলনে অংশ নিতে। ঢাকায় ফিরি ১ ডিসেম্বর। ফেরার পথে ব্যাংককে ছিল পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। সকালেই আইপ্যাডে দিনের কাগজে দেখি, গত রাতে (৩০ নভেম্বর) ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’-এ বক্তৃতা শেষে আবার ‘একটি কথা’ বলার আগেই মৃত্যুবরণ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। এই সংবাদ পড়ে বিমূঢ়-বিস্মিত হয়ে যাই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি সিলভিয়া নাজনীনকে বলেছেন, ‘নিয়তির হাতে শুধু মৃত্যুকেই রেখেছি, বাকি সব মানুষের পরিশ্রমের ফসল।’ এমনই ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
ব্যাংককের বিমানবন্দরে যখন বসে ছিলাম, মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রথম পরিচয়ের কথা। ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারির কোনো এক সকালে হরতাল-অবরোধের মধ্যে আমি আর আসাদুজ্জামান নূর (বর্তমানে সংস্কৃতিমন্ত্রী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের একুশের সংকলনের প্রচ্ছদের জন্য কাইয়ুম চৌধুরীর বাসায় যাই। তিনি দ্রুতই আমাদের প্রচ্ছদটি করে দেন। একই সঙ্গে সেরা শিল্পীদের চিত্রকর্ম নিয়ে নতুন আরেকটি সংকলন করার প্রস্তাব দেন তিনি। তাঁর প্রস্তাবমতো সেই সংকলনটিও বের করি আমরা।
সেই পরিচয়ের পর থেকে আমাদের যোগাযোগ বাড়ে। আমরা ক্রমেই আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। তাই আমাদের জীবন-সংগ্রামের উত্থান-পতনের দুঃখ-বেদনা থেকে শুরু করে সফলতা-ব্যর্থতারও অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর সব চিন্তা, সব উদ্যোগের সঙ্গে আমি এবং আমার বন্ধুরা একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের কাইয়ুম ভাইও সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি এবং সংবাদপত্র-প্রকাশনাসহ আমাদের সব কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন, উদ্যোগী হয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথম আলোর নামলিপি থেকে শুরু করে গ্রাফিক ডিজাইনের ছোটবড় সব ধরনের কাজকর্ম-নিমন্ত্রণপত্র, বিশেষ সংখ্যা, সব ঈদ সংখ্যার প্রচ্ছদ, শিল্প-সাহিত্যের ক্রোড়পত্রের সাজসজ্জায় ছিল তাঁর বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া, তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। এ ছাড়া তিনি প্রথম আলোতে ছড়া, কবিতা, প্রিয় বন্ধুদের স্মৃতিকথা ও বিশেষ নিবন্ধ লিখেছেন। বলা যায়, প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু তাঁর মৃত্যু-অবধি তিনি আমাদের সঙ্গেই ছিলেন, আমাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ একজন হয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৬৯ সাল থেকে দেশের রাজনীতির নানা উত্থান-পতন, সংগীত, চিত্রপ্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডের সুবাদে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। ব্যাংককে সেদিন সকালে বারবার শুধু মনে পড়ছিল তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা-ঘনিষ্ঠতা আর বহুমুখী কাজের সুবাদে মেলামেশার কথা। এভাবেই ৪৫ বছরের ঘনিষ্ঠতা আমাদের, কত উজ্জ্বল সময় কেটেছে!
২৪ নভেম্বরের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মাত্র দুই দিন আগে সন্ধ্যা থেকে বেশ রাত পর্যন্ত বন্ধু আবুল হাসনাত ও আমি শিল্পসাহিত্য-দেশ-রাজনীতি নিয়ে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে কত-না কথা বলেছিলাম। তাঁর স্বপ্নের কথা, শিল্প নিয়ে নানা ভাবনার কথা সেদিন তিনি আমাদের বলেছিলেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল আশাবাদ। নানা কথা-আলোচনার মাঝে তাঁর শরীর-স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার কথা বলেছিলাম। আমাদের পরামর্শ ছিল সকালে আবার যেন হাঁটাহাঁটি শুরু করেন কাইয়ুম ভাই। আমি জানতাম, হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘদিন সকালে নিয়ম করে রমনায় হাঁটতেন তিনি। সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর বহুমুখী কর্মব্যস্ততার কারণে। আর সেটাই আমাদের শেষ উচ্ছল গল্পসল্প হবে, তা কে জানত?
সেদিনের সেই সন্ধ্যা-রাতের আলোচনায় কাইয়ুম ভাইকে বলেছিলাম, জাপান থেকে ফিরে এক দিন দুপুর থেকে অপরাহ্ণ পর্যন্ত আমার বাসায় ফরাসি দুই ভাস্কর অগাস্টিন রঁদা আর কেমিলে ক্লদেলের জীবননির্ভর প্রেম-ভালোবাসা-সংঘাতের চলচ্চিত্রটি দেখব। একটি পুরো বেলা গল্প করে আনন্দে কাটাব, সেই ইচ্ছাটা আর পূরণ হলো না। কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে সেই চলচ্চিত্রটাও আর একসঙ্গে দেখা হলো না। দেশের বাইরে—কলকাতা, প্যারিস, নিউইয়র্কে গেলে তাঁর পছন্দের কোনো বই, চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্রের সিডি এনে কাইয়ুম ভাইকে উপহার দিতাম। সেসব পেয়ে কী যে খুশি হতেন! গত সেপ্টেম্বর মাসে প্যারিস থেকে তাঁর জন্য এেনছিলাম শিল্পী ভ্যান গঘকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র। মাদ্রিদ থেকে এনেছিলাম ফ্লেমিংগোর বাজনার সঙ্গে আনুশকা শংকরের সেতারের সিডি।
গত এক দশক দেশ-বিদেশে শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন, ভ্রমণ, অনুষ্ঠান নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। জীবনকে নানাভাবে উপভোগ করার এক ধরনের উৎসাহী প্রয়াস ছিল তাঁর। এসব নিয়ে নতুন অনেক পরিকল্পনাও ছিল তাঁর। শিল্পী গৌতম চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, আবার ভুটানে যাবেন ছবি আঁকতে।
কিছুদিন আগে বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক সুবীর চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছিলেন, গভীরভাবে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন কাইয়ুম ভাই। মাঝেমধ্যেই বলতেন, আমাদের জীবনের সক্রিয় এক সঙ্গীকে হারালাম। আমাদের বন্ধু সুবীর তো দেশ-বিদেশের বহু শহরে নিয়ে গিয়েছিলেন কাইয়ুম ভাইকে।
প্রায় ষাট বছর আগে ১৯৫৬ সালে, তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র; ভাবতেই বিস্ময় জাগে, হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম প্রেসক্লাবে। সেখানে তখন মুর্তজা বশীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীর আর কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী চলছিল। খবরটি হয়তো পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছিলাম। ১৯৬১ সালে সারা পাকিস্তানের সেরা শিল্পী পুরস্কার পাওয়ায় আমাদের আনন্দের কথা আজও মনে পড়ে। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বেশ কিছু পুরস্কার-স্বীকৃতি-সম্মাননা পেয়েছেন।
শিল্পকলাজগতে ড্রয়িং, প্যাস্টাল, জলরং, তেলরং—সব মাধ্যমে তিনি সফল হয়েছিলেন। আর প্রচ্ছদশিল্প ও প্রকাশনাজগতে তিনি ছিলেন একক নায়ক। আমাদের প্রথমা প্রকাশনের প্রায় সকল বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন তিনি। ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তার সকল প্রচ্ছদ করেছিলেন কাইয়ুম ভাই। নিয়মিত ছবি আঁকার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় অসংখ্য কার্ড-পোস্টারও করে দিয়েছেন অনেক প্রিয় মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠনকে। ছড়া-কবিতাসহ শিল্পকলার সব শাখাতেই তাঁর প্রধান বিষয়বস্তু ছিল পাখি, পাখা, নৌকা, নদী, গ্রাম প্রভৃতি। একই সঙ্গে স্বাধীনতা, লাল-সবুজ পতাকা আর কৃষক-শ্রমিক-মজদুর-নারী-তরুণদের প্রতি কাইয়ুম চৌধুরীর ছিল প্রধান পক্ষপাত। কারণ এসবের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ও চেতনা প্রতিভাত হয়েছে। তাঁর চিত্রকর্ম, ছড়া, কবিতা ও বিভিন্ন লেখায় মূলত লোকজ বাংলাদেশ, সংগ্রামী বাংলাদেশই মূর্ত হয়ে উঠেছে বারবার।
কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর মৃদু কণ্ঠস্বর আর আবেগভরা হৃদয় নিয়ে বাংলাদেশের ষাটের দশকের উত্থানপতনের এক নিরলস পথিক ছিলেন। ৪৫ বছর ধরে কাছ থেকে তাঁর প্রায় সব কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার ফলে একটা কথা বারবার বুকের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হয়, একজন মানুষ কত দিতে পারে! দীর্ঘ সময়ের এই অভিজ্ঞতা থেকে বলি, তাঁর কাছে কোনো কিছু চেয়ে পাইনি, এমন দৃষ্টান্ত নেই। ব্যক্তিগতভাবে জানতাম, আরও অনেক নতুন কিছু করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। সবকিছুরই সমাপ্তি ঘটল তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে।
আমাদের সময়কালের সকল অর্জনের পেছনে রয়েছেন একজন কাইয়ুম চৌধুরী। আমরা বারবার বলি, প্রথম আলোর সব সফলতা, যা কিছু অর্জন, তার পেছনে ছিলেন একজন কাইয়ুম চৌধুরী।
আমরা বহু পড়েছি, বীরের মৃত্যু হয় সম্মুখসমরে, যুদ্ধক্ষেত্রে। কাইয়ুম চৌধুরী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে—মঞ্চে সংগীত নিয়ে কথা বলতে বলতে। আরও ‘একটি কথা’ বলতে চেয়েছিলেন তিনি। নিশ্চয়ই সেটা ছিল সংগীত কিংবা বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কথা। এ রকমই মহান মৃত্যু হয়েছিল কাইয়ুম চৌধুরীর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কামরুল হাসানেরও।