বিশ্বভারতীর ছাপচিত্র

‘অনুসরণ’, িশল্পী: অজিত শীল
‘অনুসরণ’, িশল্পী: অজিত শীল

দেশের গ্যালারিতে বিদেশি শিল্পীদের ছবি প্রদর্শিত হলে শিল্পানুরাগী দর্শক নিশ্চয়ই নতুনত্বের আস্বাদ নিতে পারেন। কথাটি বলা হলো ভারতীয় ছাপচিত্রশিল্পী অজিত শীল ও উত্তম কুমার বসাকের ছাপচিত্র দেখার পর। তাঁরা দুজনেই বিশ্বভারতীর ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষক। ‘গ্যালারি শিল্পাঙ্গণ’-এর আমন্ত্রণে ‘দুইয়ের মধ্যে বহুত্ব’ বা ‘ডাইভারসিটি ইন ডুয়ালিটি’ শিরোনামে শুরু হয়েছে তাঁদের ছাপচিত্র প্রদর্শনী।

ছাপচিত্র মূলত করণকৌশল-নির্ভর। অজিত শীল সহজাত প্রবণতায় করণকৌশলকে আয়ত্ত ও প্রয়োগে করে কাজ করেছেন। নর-নারীর সম্পর্কের অনুভূতিই তাঁর বিষয়। নর-নারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, প্রেম, ঘৃণা, ক্রোধের অনুভূতি, প্রবল অনুরাগ, উৎসাহ, দূরদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি—এমন নানা অনুভূতি বোঝাতে চিত্রজমিনে প্রতীকী পুরুষ হিসেবে এঁকেছেন কচ্ছপ। এ ছাড়া সুশ্যামল প্রকৃতি, মানুষ ও পশুপাখির সম্পর্কের নানা বিষয় এঁকেছেন ময়ূর, কচ্ছপ, ফুল, ফল, পাখি, গাছপালার রসময় অভিব্যক্তিতে। পরিমিত রং ও রেখা ব্যবহারে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে ‘খণ্ডিত’ শিরোনামের চিত্রের কথা বলা যায়। এই লিথোগ্রাফিতে জলরং বৈশিষ্টাবলি বিদ্যমান এবং প্ল্যাটোগ্রাফিতে পরিলক্ষিত হয় টেম্পারা বৈশিষ্ট্য। তবে রৈখিক গুণ, টেক্সচার ও একাধিক রঙের সুপরিকল্পিত বিন্যাস তাঁর ছাপচিত্রের গুণ-বৈশিষ্ট্যকে মাধুর্যমণ্ডিত করেছে।

‘শান্তির জন্য কান্না’, িশল্পী: উত্তম কুমার বসাক
‘শান্তির জন্য কান্না’, িশল্পী: উত্তম কুমার বসাক

উত্তম কুমার বসাকের অধিকাংশ ছাপচিত্র এচিং পদ্ধতিতে করা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বস্তুরূপ ফ্যান্টাসির দৃষ্টিতে দেখেছেন এ শিল্পী। প্রাণিজগৎ ও মানুষের অস্তিত্বকে উপস্থাপন করেছেন প্রতীকায়িত ঢংয়ে, চেতন-অবচেতনের সংশ্লেষে। সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা, ঐতিহ্য ও পরম্পরার খণ্ডিতাংশ চিত্রের মধ্যে ছোট ছোট প্যানেলে দেখেছেন ‘ক্লোজ আপ’ দৃষ্টিতে; যা মূল চরিত্রের ফিগারকে কেন্দ্র করে চারপাশে বিন্যস্ত এবং ছবির গল্প কখনো বর্ণনায়, কম্পোজিশনের জন্য, কখনো বা ব্যবহৃত হয়েছে টেক্সচার হিসেবে। মূল ছবির এসব খণ্ডিত দৃশ্যকল্প সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে চলচ্চিত্রের মতোর ধারাবাহিক গল্প বলে নিবিষ্ট রাখে দর্শককে।

‘লাইভ সার্কেল’ বা জীবন আবর্ত নিয়ে কাজ করেন উত্তম। একটা নস্টালজিক ভাবনার প্রতীক হিসেবে ঐতিহাসিক মসজিদ-মন্দির কিংবা বিশেষ স্থানের অংশ তুলে ধরেন ঐতিহ্যর স্মারক হিসেবে। জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি নকশাধর্মী কাঠামোর বিন্যাস তাঁর নির্মাণশৈলীর বৈশিষ্ট্য। ‘শান্তির জন্য কান্না’ ছবিতে বাঘকে তিনি ব্যবহার করেছেন হিংস্রতার প্রতীক হিসেবে। কোনো কোনো কাজে ফুল এসেছে শান্তির প্রতীকরূপে। তাঁর ছবিতে যেমন বর্ণনামূলক আখ্যান তৈরির চেষ্টা আছে, রয়েছে আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, ঐতিহ্য ও স্মৃতি—পাখি, শাপলা, বাঘ, মুকুট, আলোর দ্যূতি ও উড়ন্ত পরির অবয়বে। যেমন, ‘স্বপ্ন’ ছবিতে দেখা যায় উড়ন্ত পরিকে। কখনো মুকুট আসে সৌন্দর্য, আশা ও স্বপ্নের প্রতীক হয়ে।

সব মিলিয়ে বিশ্বভারতীর এই দুই ছাপচিত্রীর কাজে আঙ্গিক প্রয়োগের পারদর্শিতা, আঙ্গিকের সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব শিল্পভাবনা ও রসবোধের যে মিলন, তা অনন্য। ১২ মার্চ শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে আজ ২৪ মার্চ পর্যন্ত।