ক্যানভাসে সুফিসংগীত

‘লালন’, শিল্পী: এ জেড শিমুল
‘লালন’, শিল্পী: এ জেড শিমুল

‘পৃথিবী জয় করার জন্য কেউ ব্যবহার করেছে প্রেম, আবার কারও অস্ত্র বোমা। তবে বোমা দিয়ে ভূখণ্ড দখল করা গেলেও মনকে জয় করা যায় শুধু প্রেম দিয়েই।’ এ জেড শিমুলের একক প্রদর্শনী ‘ইমোশন অব সুফি মিউজিক’ বা সুফিসংগীতের অনুভূতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওপরের কথাগুলো শিল্পীর নিজেরই। তাঁর এই কথার মধ্যে আছে সমসাময়িক উগ্রপন্থীদের প্রতি ঘৃণা।
ঈশ্বর ও মানুষকে একই প্রেমের বাঁধনে বেঁধে ইন্দ্রিয়াতীত বিষয় উপলব্ধি করতে পারেন সুফিসাধকেরা। খ্রিষ্টীয় আনুমানিক দশম শতকে পারস্য থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে এ সম্প্রদায়। দ্বাদশ শতকে সুফি প্রভাব ব্যাপক হয়ে ওঠে উপমহাদেশজুড়ে।
অধ্যাত্মচেতনায় সুফিদের সাধারণ জীবন ও তাঁদের সংগীতচর্চার ভাবকে বিষয় করে ছবি এঁকেছেন শিমুল। তাঁর মতে, সুফি একটা দর্শন। বৈষ্ণব, বাউল, কীর্তন প্রভৃতি দেহতত্ত্বের গানকে তিনি সুফিদর্শনের মর্মবাণীর সঙ্গে একাত্ম করে তুলনা করেছেন। তাই সাধু, বাউল, সুফিদের বেশভূষা, সাধন, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্রসহকারে সাংগীতিক আবহ তুলে ধরেছেন প্রদর্শনীতে। ‘আবহ’—এ শব্দ সচেতনভাবেই উচ্চারণ করেছি। কারণ, প্রদর্শনীকক্ষে লালনের গান যে বাজছিল, সেখানে ছিল সুফিতত্ত্ব, ফকিরিতত্ত্ব ও বাউলতত্ত্বের সমন্বয়।
প্রদর্শনীতে ঢুকতেই চোখে পড়ল বাঁশি, ঢোল, খমক, একতারা, মৃদঙ্গ ও করতাল—সুফি, ফকির, বৈষ্ণব, বাউল সংগীতের বাদ্যযন্ত্রাদি। প্রদর্শনীকক্ষের এক কোণে বসে লোকগীতি, মারফতি, মাইজভান্ডারি ও বাউলগান গাইছেন মরমি শিল্পীরা। এই সুরের ঝংকার আবার মূর্ত হচ্ছে গ্যালারির দেয়ালে সাঁটানো ক্যানভাসে—রং, রেখা ও টেক্সচারে।
সংগীতের সুর যেমন মূর্ত নয়, সুরের লহরি কানে বেজে মনে যেমন উদয় হয় ভাবের, তেমনি শিমুল তাঁর ‘ইমোশন অব সুফি মিউজিক’ সিরিজচিত্রের কোনো কোনো কাজে ফর্ম বা গড়ন তৈরির চেষ্টা করেননি। দিয়েছেন রূপের আদল। এই রূপের মাধ্যমে সুফিসংগীতের ভাবদর্শন আত্মস্থ করা যায়। হ্যাঁ, মিলনের দর্শনকে নিজের রং ব্যবহারেও গ্রহণ করেছেন তিনি। মিশ্র মাধ্যমের কোনো কোনো ছবিতে তেলরং, অ্যানামেল রং ও অ্যাক্রিলিক রং ঢেলে মিশিয়েছেন একত্রে। ঢেউখেলানো রেখার বৃত্ত হয়ে কেন্দ্রে পৌঁছানোর চেষ্টা এবং মুহূর্তেই আবার বিলীন হয়ে যাওয়া—এমনভাবে ঘূর্ণমান রেখা মিলেমিশে কখনো উজ্জ্বল আলোর আভাস, কখনো-বা অন্ধকার মায়াচ্ছন্ন ভাব-আবেদন—এটিই হচ্ছে শিমুলের ছবির বৈশিষ্ট্য।
অধ্যাত্মসংগীতের মধুর লীলায় হৃদয়কে উদ্দীপ্ত করে ভাবতন্ময়তায় নৃত্য করতে সুফিদের ‘হাল’ বা দশাগ্রস্ত হওয়ার দৃশ্য পাওয়া যায় ‘দারভিশ অন মিউজিক’ সিরিজচিত্রে। এই ছবিতে যে নাচের কথা বলা হলো, সেটি তুরস্কের সুফিদের একটি নাচ। রঙের ভাষায় এখানে এটি চিত্রিত হয়েছে উপমহাদেশের সুফিদের বেশভূষাকে আশ্রয় করে। আলোচ্য ছবিতে ঘূর্ণমান দরবেশদের মুখমণ্ডলের ভাষা, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা ও সাবলীলতা—এসব কিছুতে ঈশ্বর ভাবাদর্শে লীন হওয়ায় আবহটি মিশ্রিত রং-উপাদানে হয়েছে দারুণ প্রাঞ্জল। একধরনের রোমান্টিক মেজাজ প্রতিভাত হয় এখানে। এ ছাড়া ‘খ্যাপা’, ‘সাধু’ শিরোনামের আধা বিমূর্ত ধারায় বাউল ও সাধুদের এঁকেছেন শিল্পী। এখানে আছে পারস্যের সুফি কবি জালালুদ্দীন রুমী ও বাংলার লালন সাঁইয়ের প্রতিকৃতিও। ‘রুমী’ শিরোনামের চিত্রে ক্যানভাসের সঙ্গে নকশাখচিত কাপড় সেঁটে দেওয়ায় তৈরি হয়েছে একধরনের টেক্সচার।
আমাদের দেশে সুফিসাধকেরা পূর্ণিমা রাতে সংগীতের আসর করেন। শিমুলের ছবিতে তাই চিত্রে চাঁদের আকৃতি প্রতীকীরূপে হয়ে বারবারই এসেছে। তবে শেষ কথা হলো, প্রদর্শনীতে বাংলাদেশি সুফিঘরানার ছোঁয়া ছিল অপেক্ষাকৃত কম। রং ব্যবহারে পারদর্শিতা, রং মিশ্রণের মধুরতা এবং ব্রাশিংয়ে জড়ত্ব, অর্থাৎ পরিপক্বতার অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।
ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ২৪ মার্চ শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি আজ শেষ হবে।