অবিন্তা স্মৃতি-চিত্রমালা

‘অবিন্তাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য’, শিল্পী: রফিকুন নবী
‘অবিন্তাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য’, শিল্পী: রফিকুন নবী

অবিন্তা কবির যখন দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করার স্বপ্নে বিভোর, তখনই উগ্রবাদী ঘাতকের বুলেটে নিভে গেল তাঁর প্রাণ। একই সঙ্গে নিভে গেল ফারাজ আইয়াজ হোসেনসহ আরও অনেক তারুণ্য। বলছি হলি আর্টিজানের নৃশংস ঘটনার কথা। এর মধ্যে হলি আর্টজান ট্র্যাজেডিতে নিহত অবিন্তার স্মৃতি অমলিন রাখতে তাঁর পরিবারের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বাংলাদেশের ৬০ জন প্রবীণ-নবীন শিল্পীর চিত্রকর্ম নিয়ে ২২ এপ্রিল যাত্রা শুরু করেছে ‘অবিন্তা গ্যালারি অব ফাইন আর্টস’। আগে এটি পরিচিত ছিল ‘এ্যাথেনা গ্যালারি’ নামে।

প্রদর্শনীটি এককথায় প্রীতি ও প্রতিবাদে অবিন্তার প্রতি শৈল্পিক শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। রং, রেখা, টেক্সচার, গড়ন, ধরনের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে শিল্পীরা অবিন্তাকে স্মরণ করেছেন স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায়।

সন্তানহারা মা রুবি আহমেদের বাৎসল্য উঠে এসেছে কয়েকজন শিল্পীর চিত্রকর্মে। ফরিদা জামান, জামাল আহমেদ, কনকচাঁপা চাকমা, আবদুস সাত্তার তৌফিক, আইভি জামান ও আসিফ উজ জামানের ছবিতে মা ও সন্তানের স্নেহময় বন্ধন অটুট ধরা আছে। ‘মা ও মেয়ে’ শিরোনামের দৃষ্টিনন্দন আরেকটি ছবি এঁকেছেন দুলাল চন্দ্র গাইন। চিত্র জমিনে অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহে ক্যাকটাসকে অশুভ সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে মা ও মেয়ের শঙ্কাযুক্ত অভিব্যক্তি দেখিয়েছেন তিনি, যা নারীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিকূল অবস্থার ইঙ্গিতবহ।

হামিদুজ্জামান খান এঁকেছেন হাস্যোজ্জ্বল মুখ। আহমেদ শামসুদ্দোহা বাস্তবানুগ ও পরাবাস্তব ধারার মিশ্রণে অবিন্তার মুখ এঁকেছেন আকাশে উদীয়মান সূর্যের প্রতিরূপে। এভাবে শিল্পীদের কাজে এই তরুণীর মুখাবয়ব উঠে এসেছে নানা মূর্ছনায়।

‘মা ও শিশু’, শিল্পী: কনকচাঁপা চাকমা
‘মা ও শিশু’, শিল্পী: কনকচাঁপা চাকমা

অবিন্তা চেয়েছিলেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যপীড়িত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে। ‘অবিন্তার স্বপ্ন’ শিরোনামে সে অভিব্যক্তি মূর্ত করেছেন শেখ আফজাল। মুখাবয়বের অন্তরালে গভীর সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস দেখা গেল তৈয়বা বেগম লিপির ‘নিষ্পাপ আত্মা’, শহিদ কাজীর ‘সোনালি মেয়ে’ এবং সুলেখা চৌধুরীর ‘অন্ধকার সময়’ ছবিতে। তবে অবিন্তার প্রতিকৃতি নিয়ে অনেক শিল্পীর কাজে বাহ্যিক রূপ ছাড়া অন্তর্গত ভাব প্রকাশ পায়নি।

প্রদর্শনীর ছবিগুলোতে ফুটে উঠেছে অশুভ শক্তির প্রতি ঘৃণা। যেমন ‘মাংসাশী’ শিরোনামে ও বিক্ষিপ্ত রেখাবিন্যাসে আঁকা নিসার হোসেনের ছবিতে দেখা গেল হিংস্র পশুর বীভৎস অভিব্যক্তি, প্রকারান্তরে যা ঘৃণারই প্রকাশ বটে।

যন্ত্রণাময় অকালমৃত্যুকে রং, রেখা ও টেক্সচারের সমন্বয়ে বিমূর্ত অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন মোহম্মদ ইউনুস।

মনিরুল ইসলাম ‘যন্ত্রণাময় রাত’ চিত্রে দেখিয়েছেন কীভাবে সুন্দরকে ছেয়ে ফেলে অশুভ কালো ছায়া।

রফিকুন নবী ও দিলরুবা লতিফ রোজির আঁকা ফুলদানি থেকে ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ি যেন-বা নিষ্পাপ অবিন্তার অকালপ্রয়াণকে বিষাদময় করে তোলে। এই দুই শিল্পী বিকশিত হওয়ার আগেই অবিন্তার ঝরে যাওয়াকে এঁকেছেন প্রতীকী উপস্থাপনায়। অর্থবহ রং, প্রতীক, ব্যঞ্জনায় আতিয়া ইসলাম এ্যানির ‘বেদনাদায়ক স্মৃতি’ ও মাহবুব রহমানের ‘সাফারিং’ (ভোগান্তি) শিরোনামের ছবি দেখে মানসিক দ্রোহে তাড়িত হবেন দর্শক।

এ ছাড়া সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, কালিদাস কর্মকার, আবদুস শাকুর শাহ্, আবদুল মান্নান, শহিদ কবির, আনিসুজ্জামান, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, সুমন ওয়াহিদ প্রমুখ শিল্পীর কাজ রয়েছে প্রদর্শনীতে। সর্বোপরি কয়েকজন শিল্পীর কাজ প্রদর্শনীর বিষয়-ভাবনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। আনন্দের কথা হলো, বিক্রীত শিল্পকর্মের অর্জিত অর্থ ব্যয় করা হবে স্কুলের অ্যাসিড-আক্রান্ত অসহায়দের মধ্যে। ‘লাভিং মেমোরি’ (প্রীতিময় স্মৃতি) শিরোনামের প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২২ মে।