পটচিত্রের নগর-সংস্করণ

‘আমার অধিকার’, িশল্পী: শম্ভু আচার্য্য
‘আমার অধিকার’, িশল্পী: শম্ভু আচার্য্য

যন্ত্র-সভ্যাতার বিকাশে গ্রামীণসমাজের শিল্প-সংস্কৃতিতে এসেছে নানা পরিবর্তন। বদলে যাচ্ছে প্রথা, বিশ্বাস ও বিনোদনের ধরন। বেদে-বেদেনি গীত ‘পটের গান’ আগের মতো শোনা যায় না। পটশিল্পীরা এখন অন্য পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু বিক্রমপুরের বংশানুক্রমিক পটশিল্পী ধারার নবম উত্তর প্রজন্মের পটচিত্রশিল্পী শম্ভু আচার্য্য এখনো প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে এঁকে চলেছেন পটচিত্র ও পটচিত্রের আঙ্গিকে চিত্রকলা। সম্প্রতি ‘পটকাব্য পরম্পরা’ নামে হয়ে গেল তাঁর একক প্রদর্শনী।

বিষয়, আঙ্গিক, উপকরণ এবং করণ-কৌশল কিছুটা বদলে নিয়ে শম্ভু আচার্য্য যে চিত্রকলা এঁকেছেন, তাকে পটচিত্রের নগর-সংস্করণ বলাই ভালো। লোকচিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিলেখ বা সীমারেখার ব্যবহার। শম্ভুর কাজে রেখার পরিমার্জিত প্রয়োগ ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে আলো-ছায়ার ব্যবহারে ত্রিমাত্রিক আবেদনের ফলে লোককলা ও চারুকলার যুগলবন্দী ঘটেছে।

‘জীবনযুদ্ধ’, শিল্পী: শম্ভু আচার্য্য
‘জীবনযুদ্ধ’, শিল্পী: শম্ভু আচার্য্য

পটচিত্রের আঙ্গিকে মূলত চিত্রই এঁকেছেন তিনি। কারণ যে উদ্দেশ্যে পটচিত্র আঁকা হতো এই প্রদর্শনীর পটচিত্র সে উদ্দেশ্যে অঙ্কিত নয়। আলপনা ব্যবহারও পটচিত্রের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তবে উপকরণ এবং করণ-কৌশলে পটচিত্র ধারার পরম্পরা থেকে বিচ্যুত হননি শম্ভু। এখনো তিনি মোটা মার্কিন কাপড়ে ইটের গুঁড়া ও চক পাউডারের সঙ্গে তেঁতুল বিচির আঠা দিয়ে তৈরি করেন তাঁর চিত্রজমিন।

কুপির কালি, এলা মাটি, তিলক মাটি, রাজানীল, জিংক অক্সাইড, সিঁদুর, ডিমের কুসুম, সাবুদানা, বেলের কষ ইত্যাদি ভারতীয় চিত্ররীতির উপকরণ ব্যবহার করে কাজ করেছেন এই শিল্পী। ছবিগুলো সমসাময়িক বিষয়চিন্তা, ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের উপকরণ এবং সম্ভ্রান্ত শ্রেণির নগরবাসী কিংবা তথাকথিত ‘হাই আর্ট’ ক্রেতাদের আকর্ষিত করার জন্য আঁকা হয়েছে চার কোনা ক্যানভাসে, যা পটের আয়তন ও একাধিক দৃশ্যবিন্যাসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ বর্গাকৃতি কিংবা আয়তাকৃতির ক্যানভাসে তিনি একক দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন অধিকাংশ কাজে।

প্রদর্শনীতে দেখা গেল গাজীর পট ও একটি কুষ্ঠিবিষয়ক পট। গাজীর বীরত্ব-ব্যঞ্জনা, রামায়ণমহাভারত-এর নানা ঘটনা, মনসামঙ্গল, রাসলীলা, জনপ্রিয় লোকগাথা, কিংবদন্তি প্রভৃতি থেকে নেওয়া হয়েছে এসব চিত্রের বিষয়। বাদ পড়েনি সমসাময়িক গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের দৃশ্যাবলি। কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, তাঁতীর সরল জীবন যেমন উঠে এসেছে, তেমনি দিনমজুর নারীশ্রমিকের ইট ভাঙার দৃশ্যও আছে। হয়তো শিল্পরসিক ও ক্রেতাদের রুচি সামলানোর চেষ্টায় চিত্রে মাত্রাতিরিক্ত পরিমার্জন করেছেন শিল্পী। তবে পরিমার্জনটি কিন্তু ম্লান করেছে লোকশিল্পের সরলতা, সিগ্নতা আর মুগ্ধতা। মসৃণ রেখা ব্যবহার এবং কোথাও কোথাও আলো-ছায়ার ব্যবহার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রের শিল্প রসকেও ক্ষুণ্ন করেছে। উদাহরণ হিসেবে ‘গরুর গাড়িতে নববধূর নাইয়র যাওয়া’র ছবিটির কথা বলা যায়। এ চিত্রটিতে বাংলার টেপাপুতুলের আদলে অঙ্কিত গরুর অবয়ব যে লোকচিত্র রস সৃষ্টি করেছে, তা একই ছবিতে ব্যবহৃত বাস্তবানুগ ধারায় অঙ্কিত হারিকেনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

শম্ভু তাঁর ছবিগুলোকে বহুমাত্রিক চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেন। এ জন্য তাঁর একটি ছবিতে দেখা যায়, কৃষক ও কিষানির প্রেমময় অভিব্যক্তি। যেখানে চিত্রের ফিগার উপস্থাপন, ফিগারের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ অলংকরণধর্মী আয়তক্ষেত্র এবং রেখার ব্যবহার একাডেমিক চারুকলার প্রচেষ্টার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বজরায় চড়ে পদ্মা বিহার দৃশ্য’ ছবিতে গ্রাফিক ঢঙ পরিলক্ষিত হয় বেশি। ‘পাখি, রাসলীলা বিশেষত কারুশিল্পীদের শোলার তৈরি খেলনা’র ছবিতে নকশার ব্যবহার, পরিমার্জিত রেখার ব্যবহার, রঙের ঔজ্জ্বল্য—এগুলোকে মোগল মিনিয়েচারের দরবারি শিল্পীদের অনুপুঙ্খ উপস্থাপনের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

শম্ভু আচার্য্য মূলত ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র ধারার চিত্রকে অনুবাদের আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে বিলুপ্তপ্রায় লোকচিত্রধারা উপস্থাপিত হয়েছে নতুনভাবে।