রাদিচের চিঠি

গাড়িতে উঠেই তিনি বলে বসেন: ‘রাজশাহীতে নাকি আপনারা এখন রবীন্দ্রনাথের পূজা শুরু করেছেন।’
প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মূল বাংলা ভাষায় লেখা বই দীর্ঘ দুরূহ পথ: উইলিয়াম রাদিচের পাঁচটি বক্তৃতা
উইলিয়াম রাদিচ
উইলিয়াম রাদিচ

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে বাংলার অধ্যাপক ড. উইলিয়াম রাদিচে আমাদের পণ্ডিত মহলে স্বনামখ্যাত কবি ও প্রবন্ধকার। স্বরচিত কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ, মাইকেল মধুসূধন দত্ত প্রসঙ্গ—আরও বহুবিদ বিষয়ে লেখা তাঁর রচনাবলি তাঁকে আমাদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় করেছে। অবশ্য মানুষ হিসেবেও তিনি খুব অমায়িক ও মিশুক।

দুঃখের বিষয় কিছুকাল আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে তিনি প্রায় অর্ধচৈতন্য জীবন যাপন করছেন। ২০১৫ সালের শেষ দিকে লন্ডন অবস্থানকালে বহু চেষ্টা করেও আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তবে তাঁর সহকর্মী বাংলার শিক্ষক ড. হানারুথ টমসনের মাধ্যমে অক্সফোর্ডে নির্জন বাসে বিশ্রামরত রাদিচেকে আমি কেবল শুভেচ্ছা জানাতে পেরেছি।

.
.

পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে আমার কাছে রাদিচের কয়েকটি চিঠি থাকার কথা। কিন্তু হাতের কাছে পেলাম দুটি মাত্র চিঠি। প্রথম চিঠিটি লেখা ১৯৯০-এর ১০ জুন। এর দু-এক বছর আগে তাঁর সঙ্গে রাজশাহীতে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি সেখানে বাংলা বিভাগে বক্তৃতা করেন। এই চিঠিতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানান, কেননা বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর চারটি বক্তৃতা গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে আমি দ্রুত তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলাম। বইটি প্রকাশের কৃতিত্ব অবশ্য আমার পূর্বসূরি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের। তবে চিঠি পাওয়াতে রাদিচের বড় লাভ হলো। তিনি সেটি সেখানে কর্মরত তাঁর শিক্ষক ক্যানসার আক্রান্ত ড. তারাপদ মুখোপাধ্যায়কে না জানিয়ে বইটি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন। তারাপদ বাবু তাঁর মৃত্যুর পূর্বাহ্নে একটি কপি পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন।

বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত তাঁর চারটি বক্তৃতার সূচি এখানে তুলে দিলাম: ১. বাংলা কবিতা, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও মধুসূদনের কবিতা—অনুবাদের সমস্যা; ২. গদ্য অনুবাদকর্মে সমস্যা ও আনন্দ; ৩. আমার নিজের কবিতা, আমার কবিতায় বিভিন্ন প্রভাব এবং আমার কবিতা ও বাংলা কবিতার সম্পর্ক; ৪. বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ও মধুসূদনের স্থান। (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত চারটি বক্তৃতা বর্তমানে দীর্ঘ দুরূহ পথ: উইলিয়াম রাদিচের পাঁচটি বক্তৃতা শিরোনামে প্রথমা প্রকাশন থেকে পুনরায় প্রকাশিত হয়েছে।)

রাদিচে আমাকে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছিলেন ১৯৯৫-এর ১৬ ডিসেম্বর। এর কিছুকাল আগে তিনি রাজশাহীতে আবার এসেছিলেন। ব্রিটিশ কাউন্সিল সূত্রে অবহিত হয়ে আমি তাঁকে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের অতিথি সুইটে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার নাজিম মাহমুদসহ বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে। নাজিম তখন রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের একজন হোমরাচোমরা। কিন্তু সহজ সরল রাদিচে তাঁকে একটু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেন, যখন গাড়িতে উঠেই তিনি বলে বসেন: ‘রাজশাহীতে নাকি আপনারা এখন রবীন্দ্রনাথের পূজা শুরু করেছেন।’ তিনি বাংলাতেই কথাটি বললেন। অবশ্য আমরা সবাই একটু হেসে বিষয়টি হজম করে ফেললাম। রাদিচে সেবার রাজশাহীতে কয়েকটি বক্তৃতা করেছিলেন। আমাদের ইনস্টিটিউটে প্রদত্ত বক্তৃতা আমি পরে জার্নালে ছাপিয়েছি, যার কপি পেয়ে তিনি আমাকে লিখেছিলেন দ্বিতীয় চিঠিটি।

এতে তিনি লিখেছেন আমার সঙ্গে প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিচিত হওয়া ড. ডেভিড ম্যাথিউসের কথা। ম্যাথিউস রাদিচের সহকর্মী, উর্দুর অধ্যাপক। প্যারিসে তিনি ইকবালের ওপর এক অসাধারণ বক্তৃতা করেন। দুর্ভাগ্য, এরপর ২০০০ সালে আমি লন্ডনে এক সম্মেলনে গেলে তাঁর আর দেখা পাইনি। শুনলাম তিনি সোয়াসের (SOAS) চাকরিতে আর নেই। কোথায় গেছেন কেউ বলতে পারে না। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমার এক অসাধারণ বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন।

এ শতাব্দীর প্রথম দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানসহ রাদিচে একদিন এসেছিলেন আমার বাসায় । আমাকে ও আমার স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন দুটি বই।

এরপর টরন্টোর অধ্যাপক জোসেফ টি ও কর্নেলের মৃত্যুতে, কবি শামসুর রাহমানের তিরোধানে তাঁর অসামান্য শোকজ্ঞাপক লেখা আমি তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। ২০০৫-এ টরন্টোতে রবীন্দ্র সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে কিছু ভালো সময় কেটেছে আমার। রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা তাঁর একটি মজার কবিতা সবার সঙ্গে উপভোগ করেছি আমিও।

উইলিয়াম রাদিচের লেখায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক ভেতরের রহস্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর বাংলা ও ইংরেজি রচনার একটি নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন বর্তমানে বাংলা একাডেমি গ্রহণ করলে সাহিত্যানুসন্ধিৎসুরা উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। লেখার শেষে ইংরেজিতে আমাকে লেখা রাদিচের চিঠি দুটি তুলে দিচ্ছি।

মাহমুদ শাহ কোরেশী

মহাপরিচালক

বাংলা একাডেমি

ঢাকা।

জনাব কোরেশী,

আপনার চিঠির জন্য অনেক ধন্যবাদ, দ্রুততার সঙ্গে আমাকে চারটি বক্তৃতার একটি কপি পাঠানোর জন্যও। এটা পেয়ে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। বইটি যাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে সেই ড. মুখার্জির হাতে আমি এটি তুলে দিতে পেরেছি। এ কাজটি করতে পেরে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত, যদিও দুঃখজনকভাবে, ড. মুখার্জি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারত্মক অসুস্থ। তাঁর শরীরে সব সময়ই ব্যথা। তিনি একেবারেই কাজ করতে পারেন না। বইটি সম্পর্কে আমি তাঁকে কিছু বলিনি, তাঁকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়, বইটি হাতে পেয়ে তিনি বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছেন।

নভেম্বরে আমাকে বইটির আরও কিছু কপি পাঠাবেন। পশ্চিমবঙ্গে কি কিছু পর্যালোচনা কপি পাঠিয়েছেন? হয়তো বাংলাদেশ এলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহায়তা নিয়ে আমি এটা করতে পারব।

মনে আছে, রাজশাহীতে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আপনার সঙ্গে আবারও দেখা হওয়ার অপেক্ষায় আছি।

শুভ কামনা

আপনার একান্ত

উইলিয়াম রাদিচে

চিঠি: দুই   

১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫

জনাব কোরেশী,

ক্ষমা করবেন, বিএস জার্নালে আমার নিবন্ধ-সংবলিত কপিটি পাঠানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে দেরি হয়ে গেল। ডেভিড ম্যাথুস আমাকে কপিটি পৌঁছে দিয়েছেন। প্যারিসে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ তিনি কতটা উপভোগ করেছেন, সে কথাও তিনি আমাকে বলেছেন।

রাজশাহীতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটা আনন্দদায়ক ছিল। আমি আশা করি, আইবিএসের উত্তরোত্তর উন্নতি হোক, আর আপনার সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যে আবার এখানে অথবা ওখানে দেখা হবে।

১৯৯৬ সালের জন্য শুভ কামনা।

আপনার একান্ত

উইলিয়াম রাদিচে