নজরুলের জীবনের কয়েক পর্ব

ক্ষান্তিহীন নজরুলচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ আবদুল মান্নান সৈয়দকে ২০০৬-এ নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলের জীবন ও সৃষ্টি বিষয়ে ‘স্কলার-ইন-রেসিডেন্স’ পদে বৃত করে। বছরব্যাপী গবেষণার ফল হিসেবে নজরুল জীবনের অন্যতম প্রধান তিন বর্ষ ‘১৯২২ ’, ‘১৯২৮’ ও ‘১৯৪১’ সালের ঘটনা ও সৃষ্টিপ্রবাহ বিষয়ে প্রকাশ পায় কাজী নজরুল ইসলাম: তিন অধ্যায় বইটি।

নজরুলের ৪৪ বছরের সুস্থ-সবল জীবনের মধ্যে ১৯২২ সালকে মান্নান সৈয়দ গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করেন প্রথম কবিতাগ্রন্থ অগ্নি-বীণা, প্রথম গল্পগ্রন্থ ব্যথার দান, প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ যুগ-বাণীর প্রকাশনার কারণে। ওই বছরই নজরুলের সম্পাদনায় অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু প্রকাশ পায় এবং যুগপৎ যুগ-বাণীধূমকেতু বাজেয়াপ্ত হয়। ১৯২৮ নজরুলের সংগীতজীবনের প্রবেশক হিসেবে গুরুত্ব পায়। এ বছর তাঁর প্রথম গীতিগ্রন্থ বুলবুলসঞ্চিতা প্রকাশ পায়। বাংলা গজল গানের উদ্গাতা হিসেবে তখনই আবির্ভূত হন নজরুল। ১৯৪২-এ ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ার অব্যবহিত আগে ১৯৪১ ছিল তাঁর সৃষ্টিশীলতায় নিমজ্জিত হওয়ার বছর। এ সময় দ্বিতীয় পর্যায়ে কবি দৈনিক নবযুগ সম্পাদক হিসেবে অবতীর্ণ হন এবং কলকাতা বেতারে গীতি-আলেখ্য রচনা, সুরসংযোজনা, পরিচালনা ও দুষ্প্রাপ্য সুর উদ্ধারে ব্রতী হন।

কাজী নজরুল ইসলাম: তিন অধ্যায় আবদুল মান্নান সৈয়দ
কাজী নজরুল ইসলাম: তিন অধ্যায় আবদুল মান্নান সৈয়দ
কাজী নজরুল ইসলাম: তিন অধ্যায় আবদুল মান্নান সৈয়দ
প্রচ্ছদ: সমর মজুমদার
প্রকাশক: নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশকাল: ২৫ মে ২০০৭
১৯২ পৃষ্ঠা
দাম: ১৫০ টাকা।

মান্নান সৈয়দ নজরুলকে দেখতে চেয়েছেন বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতের প্রশস্ত পরিসরে। তাই অগ্নি-বীণার প্রকাশবর্ষ ১৯২২-এ এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড, জেমস জয়েসের ইউলিসিস, হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ, ইয়েটসের লেটার পোয়েমস প্রভৃতির প্রকাশতথ্য সমবেত করেন। এর মধ্য দিয়ে নজরুলকে সমসাময়িক বিশ্বনন্দনের অংশী হিসেবে বিবেচনা করেন তিনি। অতঃপর বিদ্রোহী বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘এক ডিসেম্বরে, বছরের শেষ সপ্তাহে, কলকাতায়, শীতের রাত্রিতে খুব সম্ভবত রাত্রি জেগে লেখা হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’। সে এক প্রাকৃতিক ঘটনা। শীতের বিরুদ্ধে—নিখিল নাস্তির শীতের বিরুদ্ধে সে এক অমর অগ্নিকুণ্ড।’

এতৎসঙ্গে তিনি অগ্নি-বীণার প্রথম সংস্করণের একটি ভূমিকা উদ্ধার করেন, যা থেকে জানা যায়, এই অমর গ্রন্থের প্রচ্ছদশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, অবন-শিষ্য বীরেশ্বর সেন।

‘১৯২৮’ অংশ শুরু হয় এমন শিহরণজাগা তথ্যে যে ঢাকার জাগরণ পত্রিকায় ‘নজরুলিস্তান’ নামে একটি বিভাগ চালু ছিল, যেখানে নজরুল-সংক্রান্ত সংবাদাবলি স্থান পেত। এ পর্বে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগ এবং ‘চল্ চল্ চল্ কবিতার রূপ-রূপান্তর’ ও এর নজরুলকৃত হিন্দি রূপান্তরও আলোচিত হয়েছে। ঢাকায় নজরুল যে তিন নারীর সংস্পর্শে এসেছেন—ফজিলাতুন্নেসা, উমা মৈত্র, রানু সোম (প্রতিভা বসু)—তাঁদের পরিচিতি বর্ণিত হওয়ার পাশাপাশি নজরুলের সঙ্গে তাঁদের সংযোগসূত্র ব্যাখ্যা পেয়েছে এখানে। নজরুল বিষয়ে প্রতিভা বসুর সাক্ষাৎকারও সংযোজিত হয়েছে। ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া’ গানটি রচনার স্থান-কাল সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু, আবদুল কাদির ও নলিনীকান্ত সরকারের তিনটি পৃথক মত উল্লেখ করেন গবেষক; প্রামাণ্য নজরুল-জীবনী রচনায় তথ্যের এমন বিচিত্রতা বিভ্রম-উদ্রেকী। জনলগ্নতায় লেখক বাংলার নজরুলের সঙ্গে আন্তসাদৃশ্য খুঁজে পান স্প্যানিশ কবি লোরকার। লোরকার জিপসি ব্যালাডস আর নজরুলের বুলবুল যে ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হলো, এ ঘটনাকে নেহাত কাকতাল মনে করেন না তিনি।

‘১৯৪১’ অংশে ‘চির-জনমের প্রিয়া’ কবিতা ভেঙে পাঁচটি গান লেখার তথ্য এবং একটি কবিতার তিনটি লেখন বিষয়ে তথ্য ও ব্যাখ্যা যোজনা করে মান্নান সৈয়দ প্রমাণ করেছেন নজরুল কতটা নিরীক্ষাশীল। ১৯৪১-এর ৯ জানুয়ারি থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত কলকাতা বেতারে প্রচারিত নজরুল-অনুষ্ঠানমালার বিবরণ এই বইয়ের গুরুত্ব বাড়িয়েছে।

এভাবে নতুন তথ্যে এবং নিগূঢ় বিশ্লেষণে আবদুল মান্নান সৈয়দ রচিত কাজী নজরুল ইসলাম: তিন অধ্যায় অনায়াসে হয়ে উঠেছে পূর্ণাঙ্গ নজরুল-জীবনী রচনার অন্যতম সহায়সূত্র। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে প্রকাশের পর থেকে এখন অব্দি বইটি প্রায় অপ্রচারিতই থেকে গেছে।