শাহনূর মামুনের বয়ানে নগর ও প্রকৃতি

শাহনূর মামুন অতি অল্প সময়েই জলরঙের ছবির জন্য বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেছেন, হয়েছেন দর্শকপ্রিয়। যে ধরনের ছবি তিনি আঁকেন, তার প্রধান আকর্ষণ প্রচলিত সৌন্দর্যবিদ্যার চর্চা এবং এর সঙ্গে তাঁর কাজে যা লক্ষণীয়, তা হলো ‘বাংলা ইম্প্রেশনিজম’। মামুনের বাংলা ইম্প্রেশনিজম এবং তাঁর কাজ নিয়ে কথার শুরুতে এটাও জানিয়ে রাখি, ঢাকার উত্তরার গ্যালারি কায়ায় ‘প্রকৃতির গল্প’ শিরোনামে এখন চলছে এই চিত্রকরের চতুর্থ একক প্রদর্শনী। তাঁর আগের তিনটি প্রদর্শনী থেকে এই প্রদর্শনীর বিশেষত্ব এই যে ভাষা ও উপস্থাপনায় নতুনত্ব আছে এখানে।

জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ থেকে আমাদের ভূচিত্র রচনার যে ধারা, এর পরম্পরায় আজ যেসব ভূচিত্র আমরা দেখছি, তাকে যদি একটি ছকে বন্দী করতে চাই, তবে ইম্প্রেশনিজমের ফ্রান্স-ব্রিটিশ-ডাচ বা অন্যান্য স্কুল থেকে একটা স্বতন্ত্ররূপে দেখতে পাব। আবার খানিক পেছনে গেলেই দেখা যাবে, চিত্রকলায় আমাদের ভিত্তি সৃষ্টিকারী শিল্পীরা চীন ও জাপানের ভূচিত্র দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছেন, যদিও তাঁদের শিক্ষাক্রম চালিত হতো বিলেতি ইম্প্রেশনিজমকে অবলম্বন করে। যার ফল হিসেবে আমরা আমাদের ভূচিত্র রচনায় ‘মিনিমাইজেশন’কে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখি।

ভারতীয় চিত্রকলায়, বিশেষত মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি-চিত্রে যে বিশদ বর্ণনার রীতি ছিল, তাঁরা তার বিপরীত। ইম্প্রেশনিস্ট রীতিতে আলোর গতি-প্রকৃতির প্রতি আমাদের শিল্পীরা বেশ যত্নবান। নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে তাঁরা করণকৌশল রপ্ত করেন।

মামুন ভাষা হিসেবে এই বাংলা ইম্প্রেশনিজমকেই ভিত্তি হিসেবে নিয়েছেন। বর্তমান শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ার কিছু শিল্পী জলরং ও ভূদৃশ্যের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন, যা গেল শতকের আশির দশকে প্রায় লুপ্ত হয়ে যায়। যে তরুণ প্রজন্ম এই আন্দোলনটি আবার গড়ে তোলেন, মামুন তাঁদের একজন পুরোধা।

শিল্পে আবেগ, দক্ষতা ও বুদ্ধি—এসবের মিলনে দৃশ্যভাষা সৃষ্টির চর্চা চলে। এই প্রক্রিয়ার শিল্প উপস্থাপনের ক্ষেত্রে চলে নানা ঢঙের প্রস্তাবনা প্রচলনের প্রায়োগিক প্রচেষ্টা। আবার কাঠামো, ছন্দ নিয়ে নানা কৌশলও যুক্ত হয় নির্দ্বিধায়।

ভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মামুনের অবদান নিয়ে কথার প্রথমেই বলতে হবে, তাঁর চিত্রে বস্তু তার স্বরূপ বদলে নতুন আদল গ্রহণ করে এই নিমিত্তে যে তার অন্তর অভিব্যক্তি এই আদলে বাঙ্‌ময় হয়ে ওঠে। আবার রংই ইম্প্রেশনিজমের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে থাকলেও ইম্প্রেশন-পরবর্তী শিল্পীরা রং নিয়ে যে ভিন্নমাত্রার উপস্থাপনার চেষ্টা করেছেন, তারও কিছু লক্ষণ পাওয়া যায় মামুনের কাজে। এখানে যদিও প্রথা থেকে তিনি বেরিয়ে আসেননি, তবে নতুন দ্যোতনা এনেছেন ছবিতে। তাঁর নান্দনিকতাও প্রচলিত ভাষাকাঠামোর অনুগামী, এরপরও যখন তাঁর পুরান ঢাকার গলির বিল্ডিংগুলোর কাঠামো ভেঙে যায়, নৌকা ছুটে যায় দ্রুত লয়ে, নৌকার গতির সঙ্গে প্রকৃতিও যেন নিজ অক্ষচ্যুত ভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়, তখন আমরা কিছুটা ভিন্ন ধ্বনির সংকেত পাই, যা হয়তো শিল্পীর ভবিষ্যৎ ভাষার মুখ্য উপাদান হয়ে উঠবে।

তবে শিল্পীর বর্তমান কাজের দিকে তাকিয়ে এ কথাও মনে আসে, তাঁর অধিকাংশ ছবিতেই পাওয়া যায় আমাদের সত্তর দশকের মধ্যবিত্তের ও বিদেশিদের পছন্দের ছবির ঢঙের পূর্ণ প্রত্যাবর্তন, যা অলোকেশ ঘোষ, সামসুদ্দোহারা বিশেষ দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন।

তবে এভাবে বিচারের পরও বলা যায়, মামুনের অর্জনের মধ্যে যা বিদ্যমান, এর অন্যতম হলো আলোকে কিছুটা অন্য দৃষ্টিতে দেখতে পারেন তিনি। মনস্তাত্ত্বিক রঙের প্রয়োগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন আবেশ আনার চেষ্টা লক্ষণীয়।

আদতে শাহানূর মামুন যে কাজটি করছেন, তা হলো তথ্যগত উপাদানে আর্কাইভ সৃষ্টিতে অবদান রাখা। এটা একটা বিশেষ পদ্ধতি, নিয়মিত ঘটনার ব্যক্তিগত দৃষ্টির বর্ণনা; তবে এটি আলোকচিত্রানুগ নয়। তারপরও চিত্রে মামুন এর বর্ণনা আঁকেন, নানা ধরনের নৌকার অভিব্যক্তি তথা নৌকা নিয়ে শহুরে অভিলাষ আছে তাঁর ছবিতে। তাই তাঁর প্রকৃতি বাস্তবকে ছাপিয়ে হয়ে যায় শিল্পীর ব্যক্তিগত। এ জন্য এ শিল্পীর নদীতে নগর আশ্রয় খোঁজে প্রশান্তির আশায়। আবার একই সঙ্গে তাঁর ঢাকাবিষয়ক ছবিতে যেভাবে, যে ঢঙে চিত্রিত হয় বিশাল উন্মুখ পথ-জটিলতা এবং নগরের সবকিছু ভেঙে পড়ার আতঙ্ক, তা আমাদের চিন্তাকে দেয় ভিন্ন বার্তা।

৬৬টি ছবি নিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া মামুনের প্রদর্শনীটি চলবে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত।