'রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চেয়েছি বিস্ময়ে, বিচারহীন হয়ে নয়'

>

বেগম আকতার কামাল। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
বেগম আকতার কামাল। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২৩-এ এবার পুরস্কার পেয়েছে মননশীল শাখায় বেগম আকতার কামালের গবেষণাগ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা। এই সংখ্যায় থাকল লেখকের সাক্ষাৎকার।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পিয়াস মজিদ

পিয়াস মজিদ: রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা—এই বইয়ে রবীন্দ্রভাবনা-বলয়ের এই বিশেষ দিকটি গবেষণার জন্য বেছে নেওয়ার কথা ভাবলেন কেন?

বেগম আকতার কামাল: রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমি আরও লিখেছি—মূলত তাঁর সাহিত্য নিয়ে। তারপর তাঁর ব্রহ্মসংগীত শুনে ভাবলাম, এই সংগীতের ভাববস্তু ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে; বিশেষত সেই সময়ে যখন আমাদের অধ্যাত্মবোধ লুপ্তপ্রায়। ‘ব্রহ্ম’ শব্দটিকে ধরে রবীন্দ্রভাবনার বীজবিন্দুকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি এই বইয়ে।

পিয়াস: ১৯৭৭-এ বেরিয়েছিল আপনার প্রথম বই; ত্রিশের কবি বিষ্ণু দেকে নিয়ে—বিষ্ণু দের কাব্য: পুরাণ প্রসঙ্গ। বলা যায়, গবেষণার পরিণত পর্যায়ে, প্রথম বইয়ের চল্লিশ বছর পর প্রকাশিত হলো রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা বইটি। ত্রিশের কবিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ব্রহ্মচিন্তার আন্তসম্পর্ক কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?

আকতার কামাল: আমি যখন ত্রিশের কবিতা ও বাংলাদেশের আধুনিক কবিতায় অভিনিবেশ করেছি, তখন আধুনিকতার পরিচয়ের এই বোধকে রবীন্দ্রপাঠে কাজে লাগিয়েছি। তখন রবীন্দ্রনাথও আমার কাছে নতুন আলোয় ধরা দিয়েছেন। বুঝেছি রবীন্দ্রনাথের বোধের পরম্পরা ত্রিশের কবিতাধারায়ও প্রবাহিত, বিশেষ করে জীবনানন্দে।

আর বিষ্ণু দের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনার বিশেষ সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি। বিষ্ণু দে মার্কসিস্ট ছিলেন। থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথিসিস, অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক ন্যায়ে বিশ্বাসী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথেও এই দ্বান্দ্বিক ন্যায়ের ক্রম খুঁজে পেয়েছি। তিনি উপনিষদ-বাউল দর্শন-বৈষ্ণব দর্শন এবং বেন্থাম-মিল-স্পিনোজার পাশ্চাত্য দর্শনকে একটি থিসিসের আকারে গ্রহণ করে নিজের বোধ, জীবনাভিজ্ঞতা, অনুভূতির রূপ ও রেখায় বিশ্বকে দেখতে চেয়ে এন্টিথিসিস দাঁড় করিয়েছেন এবং এই পথ ধরেই পৌঁছেছেন সিনথিসিসে। উপনিষদের মাঝে ব্রহ্মকে দেখেছেন, ব্রহ্মের মূলে গিয়ে মনন বা চিন্তাকে বুঝেছেন। বস্তুর গুণবাচক পরিবর্তন ধাপে ধাপে চূড়ান্ত জ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছায় আর জ্ঞানের সর্বোচ্চ অবস্থান ‘ব্রহ্ম’কেই প্রাচীন ঋষিরা বলতেন ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান; যে ব্রহ্ম অর্থান্তরিত হয়ে সমাজে হয়তো ভগবান বা ঈশ্বর হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এর আক্ষরিক অর্থ না নিয়ে রূপকটা নিয়েছেন। আমি যখন ব্রহ্মসংগীতগুলো শুনলাম তখন মনে হলো, যে কথা বলা হয়েছে তার আড়ালেও রয়ে গেছে অন্য কথা। এই আড়ালের কথাটিই ধরার চেষ্টা করেছি, যেখানে রবীন্দ্রনাথের জীবনসমগ্রের বোধ ও অনুভূতি সঞ্চিত আছে।

পিয়াস: এই বইয়ে আপনার মূল প্রতিপাদ্য ও আবিষ্কার কী?

­আকতার কামাল: আমি রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মজ্ঞানকে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছি। সৃজন ও মননের অনন্ত আকর হিসেবে মানুষকেই তিনি ‘ব্রহ্ম’ বলেছেন। এই ভাবনাকে তিনি তাঁর গান এবং শান্তিনিকেতন গ্রন্থের মধ্যে ব্যক্ত করেছেন। আমার প্রতিপাদ্য হচ্ছে রূপ ও অরূপ, সীমা ও অসীমের রবীন্দ্রনাথ। সেই যে গানের মতো পূর্ণতা অর্জিত হয়ে গেলে থাকে না অস্তিত্ব। মানুষ হিসেবে আমরা পূর্ণতার দিকে যেতে পারি, কিন্তু প্রকৃত পূর্ণতা কখনোই পাওয়ার নয় হয়তো। পূর্ণতার দিকে এই অনন্ত ধাবনের নামই ব্রহ্মসাধনা। জীবনধর্ম, সংসারধর্ম আর কর্ম বা দর্শনধর্মের ত্রিবেণীবন্ধনের রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানের যে সীমা স্পর্শ করতে চেয়েছেন তার মূলকথা হলো সুন্দর, কল্যাণ ও বিশ্বমানবতা। আমার বইয়ে এই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে খুঁজে দেখেছি।

পিয়াস: এই বই লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে নতুন কোনো কাজের চিন্তা মাথায় এসেছি কি?

আকতার কামাল: রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছি। এসব গানে শুধু কি প্রেম নাকি প্রেমের রূপকের আরও অনেক অরূপরতন খেলা করছে, তার সূত্র সন্ধানের চেষ্টা করব। আমার প্রিয় রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশটি কবিতা নির্বাচন করে তার ব্যাখ্যা রচনার ইচ্ছে আছে।

পিয়াস: রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা কতটা উত্তরাধিকারবাহিত আর কতটা তাঁর মৌলিক চিন্তার ফসল বলে মনে করেন?

আকতার কামাল: তিনি তো উত্তরাধিকারবাহিত অবশ্যই। পিতার কাছ থেকে উপনিষদে দীক্ষা নিয়েছেন। অবশ্য উপনিষদের শাস্ত্রাংশের বদলে নান্দনিক অংশটুকু নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে অন্বিত করেছেন। তিনি নিজেকে চিহ্নিত করেছেন ‘ব্রাত্য, মন্ত্রহীন’ নামে, নিজের ধর্ম আবিষ্কার করেছেন নিজেই। সৃজনশীল সত্তার সঙ্গে আত্মধর্মকে মিলিয়ে পরমের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। ১৫১টি ব্রহ্মসংগীত তাঁর অল্প বয়সের রচনা। ওই অর্থে গীতাঞ্জলির পর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রহ্মসংগীত লেখেননি, তবে তখন ব্রহ্মই এসেছে বন্ধু হয়ে, সখা হয়ে, প্রভু হয়ে—এক রূপক থেকে অন্য রূপকে। আমাদের অস্তিত্বের চারপাশে যে শূন্যতার বিস্তার, তাকে পূর্ণতায় রূপান্তর করতে কেউ ঈশ্বরভাবনার শরণ নেন। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি পর্বে যদিও ঈশ্বর ও প্রেমিকসত্তার উদ্ভাসন ঘটিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তিনি কিন্তু ‘সে’ নামে এক সত্তায় খুঁজে পেয়েছেন জগৎসংসারে যুক্ততার সূত্র। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই ‘সে’ বলতে তিনি সৃষ্টিশীলা নারীকেই বুঝিয়েছেন।

পিয়াস: ব্রহ্মভাবনার উপাদান কবিতায় নাকি গদ্যে পেয়েছেন বেশি?

আকতার কামাল: অবশ্যই চিন্তাশীল গদ্যে আর প্রভূত পরিমাণে তাঁর গানের অমৃত-সম্ভারে। এই যে ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ গানটি প্রেমের গান হিসেবেই গাইছি আমরা, কিন্তু অনেকেই জানেন না হয়তো এটা তাঁর অল্প বয়সে লেখা ব্রহ্মসংগীত। রোমান্টিকরা ঈশ্বরকে উপাসনালয়ের আনুষ্ঠানিক অঙ্গন থেকে মানুষের মনোমন্দিরে নিয়ে এলেন। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনাও এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার্য। তাঁর কবিতা ও গদ্যে ব্রহ্মের রূপকে সহস্রতালে বেজে উঠেছে মানববন্দনার সুর।

পিয়াস: এই বইয়ের দুটো প্রবন্ধ আছে ‘পিতৃনামের প্রতীক-শৃঙ্খলা’ এবং ‘মাতৃকল্পের রূপক’। ব্রহ্মভাবনায় নারীর পরিসর কতটুকু?

আকতার কামাল: রবীন্দ্রনাথের ভেতর পিতার প্রবল প্রভাব ছিল। ভাবতে অবাক লাগে, তিনি মাকে কোনো বই উৎসর্গ করেননি, যদিও জীবনস্মৃতিতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে মায়ের কথা আছে। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এটি কি পিতৃপ্রতাপ না পুরুষতন্ত্রের প্রভাব? কিন্তু গভীরে তলিয়ে দেখেছি, এই সৃষ্টিশীল মানুষটি পিতার রূপক ভেদ করে জননীসত্তাকে প্রায়শই প্রবলভাবে তুলে ধরেছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির কায়াজুড়েও আছে জননীসত্তার ছায়াবিস্তার।

পিয়াস: রবীন্দ্রনাথ-নজরুল নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভক্তিবাদে নিমজ্জিত থাকি আমরা। এই বই লিখতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতার গল্পটি জানতে চাই।

আকতার কামাল: রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যের প্রাণপুরুষ। প্রাণকে তো অস্বীকারের উপায় নেই। মুগ্ধতার কথাও স্বীকার করি। তবে মুগ্ধতার চেয়ে বেশি আমার ভেতর কাজ করেছে বোধ, তাঁর কাছ থেকে উপার্জিত বোধ। প্রাণপুরুষের কথা যখন লিখছি, তখন ভক্তি-অতিভক্তি বাদ দিয়ে তাঁর অপার-অসীম সৃষ্টিশীল সত্তার বিচার করেছি। দেখেছি রহস্যের পর রহস্যের পর্দা খুলে যাচ্ছে কিন্তু ধরা যাচ্ছে না। এটা তো শুধু রবীন্দ্ররহস্য নয়, সৃষ্টিরহস্যও বটে। মাঝে মাঝে মনে হয় সারা জীবন ব্যয় করেও এই রহস্যের ভেদ করা সম্ভব নয়। আর এই বইটির কথা যদি বলি, তো বলব কবিদের ওপর যেমন কবিতা ভর করে, তেমনি এই বইটির ভাবনা আমার ওপর ভর করেছিল। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় সভাপতি এবং অনুষদ-ডিনের দায়িত্বে ছিলাম। সেই কঠিন সময়ে আমার ভাবনা যেন স্বচ্ছভাবে নেমে এল রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা বইটির অবয়বে।

পিয়াস: শিক্ষকতা করছেন দীর্ঘদিন, রবীন্দ্রনাথও পড়াচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শিক্ষক ও লেখক—এই দ্বিবিধ সত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন কীভাবে?

আকতার কামাল: এই দ্বিবিধ সত্তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি, আবার জয়ও করি। রবীন্দ্রনাথ পড়াতে গিয়ে শুধু রবীন্দ্রনাথের কথাই তো বলি না, তাঁর সূত্র ধরে নিজের কথাও এসে যায়। ছাত্রছাত্রীদের বলি, বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দুটো লাইনও যদি তারা বহন করে নিয়ে যায় এবং তা যদি তাদের জীবনদর্শনে বিন্দুবৎ উজ্জীবন জোগায় তাহলেই আমি সার্থক। না, শিক্ষকতা এবং গবেষকসত্তার মধ্যে কোনো বিরোধ কাজ করে না আমার।

পিয়াস: এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু বলে মনে করেন?

আকতার কামাল: দার্শনিক কান্টের মতো আমিও মনে করি, অধ্যাত্মবোধ চিরমানুষের অন্তর্গত বিষয়। একুশ শতাব্দীতে এসেও একে আধুনিক মানুষের চর্চাবহির্ভূত বিষয় ভাবা যাবে না। আজকের বস্তুবাদী, অশান্ত পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের শান্তিতত্ত্বের কথা বারবার মনে আসে আমাদের। বিশেষত, ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরলে বস্তুভোগ আর প্রাপ্তির ভেতরে পৃথিবীর ভেতরে লুকানো হাহাকার-শূন্যতা টের পাওয়া যায়। তখনই আসে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনার মতো মানববিদ্যার প্রাসঙ্গিকতা।

পিয়াস: বলা হয় রবীন্দ্রনাথ মানেই রূপান্তরের খেলা, নিজেই বলেছেন তিনি ‘নানা রবীন্দ্রনাথের মালা’। ব্রহ্মভাবনায় এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি কেমন?

আকতার কামাল: রূপান্তর বারবার ঘটেছে। ওই যে তাঁর শেষ প্রান্তের কবিতায় আছে ‘প্রথম দিনের সূর্য’। কবির অস্তিত্ব বিস্মিত হয়ে সত্তাকে জিজ্ঞাসা করে ‘কে তুমি’? আবার সারা জীবন ক্রিয়াশীল প্রেমিকসত্তা, রাজনৈতিক সত্তা, সমাজসত্তা উল্টো আবার অস্তিত্বকেই প্রশ্ন করে—জীবনভর এত কিছু করা হলো, এর পেছনে ‘কে তুমি’? কবিতারই ভাষায় বলতে হয় ‘মেলে নি উত্তর’। তাঁর কাছে অস্তিত্ব ও সত্তার পরিধি এত ব্যাপক ছিল যে নিজেই এর তল-কূল পেতেন না। অবাক বিস্ময়ের বিষয় এই যে জীবনভর বিশ্বাসানুগামী রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন কিছুটা সংশয়ী।

পিয়াস: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আপনাকে প্রাণিত করেছে এমন বইপত্র...

আকতার কামাল: তপোব্রত ঘোষের রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে বই, সৈয়দ আকরম হোসেনের রবীন্দ্র উপন্যাস-সম্পর্কিত বইটি। আবু সয়ীদ আইয়ুবও একসময় খুবই ভালো লাগত, কিন্তু এখনকার পাঠে আইয়ুবের রবীন্দ্রবিচার বড্ড মুগ্ধতাভরা মনে হয়। তাঁর রবীন্দ্র-ব্যাখ্যায় মননের সঙ্গে কল্পনার যথাযোগ ঘটেছে বলে মনে হয় না। স্পিনোজা, ফয়েরবাখ, লাকার লেখা, উত্তরাধুনিকদের ভাবনাচিন্তা আমার রবীন্দ্র-অনুধ্যানে সহায়ক হয়েছে।

পিয়াস: সুরের ইন্দ্রজাল ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীতের ভাবসম্পদ দর্শনগতভাবে কতটা অধিগম্য আমাদের?

আকতার কামাল: রবীন্দ্রনাথের গান মানেই বাণী ও সুরের বিশেষ সম্মিলন। বাণী বা সুর কোনোটাই যেন একে অপরকে ছাপিয়ে বড় না হয়ে ওঠে, তা নিয়ে তিনি ভাবিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো গীতিকবিতা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এর রূপক ধরা গেলে, উপমা-উৎপ্রেক্ষা বোঝা গেলে দেখব কী গভীর দর্শনের সমাবেশ সেখানে! ‘মেঘশিশু’ কিংবা ‘মোহমেঘে অন্ধ করে রাখে’র মতো বাক্যবন্ধ শুধু নতুন শব্দের খেলা নয়, নতুন বোধেরও দ্যোতক।

পিয়াস: প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি কেমন?

আকতার কামাল: আমার লেখার পাঠক কিন্তু অধিকাংশই প্রান্তবাসী। দূর মফস্বল থেকে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া পাই। এই বইটি লিখেও পাঠকের প্রতিক্রিয়া পেয়েছি বেশ। আশ্চর্য বিষয়, এমন জটিল বিষয় নিয়ে লেখা প্রবন্ধের বই এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় মুদ্রণে গেছে। গেল কলকাতা বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গের পাঠকও আগ্রহের সঙ্গে বইটি সংগ্রহ করেছেন। প্রকাশক বলছেন ‘এটা আমার লক্ষ্মী বই’। আর প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের স্বীকৃতি লাভ করায় আমি আনন্দিত। এর মধ্য দিয়ে বইটি আরও অনেক পাঠকের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাবে। বিচারকমণ্ডলী ও প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।

পিয়াস: শেষ বেলায়ও জানতে চাই আপনার নিজের একান্ত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে...

আকতার কামাল: রবীন্দ্রনাথকে আমি দেখি শরৎচন্দ্রের মতোই ‘আপনার পানে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই’। আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চেয়েছি বিস্ময়ে, তবে বিচারহীন হয়ে নয়।

রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা  বেগম আখতার কামাল  প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা l প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা l প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২০ পৃষ্ঠা l দাম: ১৬০ টাকা।
রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা বেগম আখতার কামাল প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা l প্রকাশক: কথাপ্রকাশ, ঢাকা l প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২০ পৃষ্ঠা l দাম: ১৬০ টাকা।

প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪২৩

মননশীল শাখা

বেগম আকতার কামালের

রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা

অভিজ্ঞানপত্র

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গবেষণাকর্মের ঐতিহ্য ও উৎকর্ষ সামগ্রিক বিচারে তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এই আকিঞ্চনের মধ্যেও কিছু কিছু বিষয় নিয়ে গবেষণা নিজ শক্তিতে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে। এমন একটি বিষয় বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র-প্রতিভার বহুমুখিনতাই যে তাঁকে নিয়ে গবেষণার এই বিস্তারকে উৎসাহিত করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেসব গবেষণার আছে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট ফসল।

গবেষণার সেই ধারাবাহিকতায় এবার যোগ দিয়েছেন বেগম আকতার কামাল। তাঁর গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনাতে দেখা যায় রবীন্দ্রদর্শনের একেবারে কেন্দ্রভূমি নিয়ে অনুসন্ধান। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিশ্বাসকে বেগম আকতার কামাল শুধু আধ্যাত্মিকতা ও অধিবিদ্যার নিরিখেই বিচার করেননি, উদ্‌ঘাটন করতে চেয়েছেন এর যৌক্তিক ও সৃজনশীল স্বরূপও। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিশ্বাসকে বোঝার চেষ্টা করেছেন প্রাসঙ্গিক ও কল্পনার যুক্তি দিয়ে।

বেগম আকতার কামাল মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিমানসে ব্রহ্মাণ্ড যে প্রতিরূপে ধরা পড়েছে তার সঙ্গে মননশীল বিশ্লেষণের কোনো মৌলিক তফাত নেই। এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে গবেষক ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রতিরোধক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনাকে দাঁড় করান।

বেগম আকতার কামাল রচিত রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মভাবনা গ্রন্থটিকে আমরা আনন্দের সঙ্গে মননশীল শাখায় প্রথম আলো বর্ষসেরা বই হিসেবে পুরস্কৃত করছি।