আমাদের বইবাড়ি

আসছে বইমেলা, কর্মব্যস্ত বাংলাবাজার। ছবি: সুমন ইউসুফ
আসছে বইমেলা, কর্মব্যস্ত বাংলাবাজার। ছবি: সুমন ইউসুফ

গ্রামের বসবাস ছেড়ে ১৯৫৮ সালে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় এসে কেএল জুবিলি হাইস্কুলে ক্লাস থ্রির ছাত্র হয়ে ঢুকেছিলাম। ইতিমধ্যে মাতুলালয়ে থাকা অনেক রকম বইয়ের মধ্যে কয়েকটা রূপকথার বই পড়ে পড়ে আমি বেশ আয়ত্তে নিয়েছিলাম। স্কুলে ঢুকে টের পেলাম সহপাঠী কায়েস আহমেদও এদিকে ঝোঁক পোহায়। আমার নিজেরও ওই নেশা জানতে পেরে একদিন সে আমন্ত্রণ জানাল, ‘নতুন বই পড়বে তো চলো আমার ঘরে।’

ভাগ্য অন্বেষণে ওপার বাংলা ছেড়ে আসা বাবার হাত ধরে কায়েস এসেছিল ঢাকায়। আমন্ত্রণ পেয়ে তার বাসায় গিয়ে পেয়েছিলাম কলকাতা থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোর পত্রিকা শুকতারার অনেকগুলো সংখ্যা। সেই সঙ্গে ছিল কয়েকটি রূপকথা, বিভিন্ন লেখকের লেখা কিশোর গল্প-উপন্যাস আর ছড়ার বই। ওসব পড়ে চলার এক ফাঁকে ফের কায়েসের ডাক পেলাম। সে বলেছিল, ‘চলো, নতুন কোনো বই কিনতে যাই।’

সেবারে তার পাশাপাশি হয়ে ঢুকেছিলাম পুরোনো ঢাকার জুবিলি স্কুলের কয়েক পা সামনের এলাকা বাংলাবাজারে। সেদিনে, সেই সময়ে নতুন-পুরোনো—সব রকম পাঠ্যবইয়ের বিক্রি চলত বাংলাবাজারের মূল রাস্তার পুব দিকের পোস্ট অফিসের দেয়াল ঘেঁষে ঠেক নেওয়া কয়েকটা অস্থায়ী দোকানে। নিজের পাঠ্যবই কেনার প্রয়োজনে ওদিকে আমার বার কয়েক প্রবেশ ঘটেছে। আর কায়েস আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তামা, কাঁসা, পিতল, রং ইত্যাদি বিক্রির নানা রকম দোকানের মাঝে দাঁড়ানো প্রকাশনা সংস্থা নওরোজ কিতাবিস্থানে। সেখানে ঢুকে কী বই কিনেছিলাম, তার নাম আজ আর স্মরণে নেই। তবে বলতেই পারি, সেটি ছিল আমার প্রথম পড়া এ দেশের কোনো মুসলমান লেখকের লেখা বই।

সেই থেকে কায়েস আর আমি মাঝেমধ্যেই বই কিনতে বাংলাবাজারে যেতাম। ওরকমভাবে বেরিয়ে নওরোজ কিতাবিস্থান ছাড়াও একে একে ঢুকেছিলাম স্টুডেন্ট ওয়েজ, খান ব্রাদার্স, আহমদ পাবলিশিং হাউস এবং আরও কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থায়।

মনে পড়ে, ওরকম ঘুরে ঘুরে আমাদের সংগ্রহে নিয়েছিলাম জসীম উদ্‌দীন, বন্দে আলী মিয়া, মোহাম্মদ নাসির আলী, সাজেদুল করিমসহ দেশের অনেক বরেণ্য লেখকের লেখা বই। ক্লাস নাইনে থাকতে স্কুল ম্যাগাজিনে ‘চোর’ শিরোনামে একটা গল্প লিখে কায়েস হলো লেখক। এ সময় আমরা হাতে তুলে নিয়েছিলাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, আবু জাফর শামসুদ্দিনের পাশাপাশি আরও অনেক গুণী লেখকের রচনা।

পাঠতৃষ্ণা বেড়ে ওঠার পর পা রেখেছিলাম বাংলাবাজার-লাগোয়া লিয়াকত অ্যাভিনিউয়ে। সেদিনে সেখানে মিলত ওপার বাংলার লেখক সমরেশ বসু, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নীহারঞ্জন গুপ্ত ছাড়াও অনেকের সুলভ সংস্করণের বই। এগুলো মুদ্রিত হতো ‘নারায়ণ মেশিন প্রেস’ নামে একটা ছাপাখানা থেকে। পরে জেনেছিলাম, প্রকৃতপক্ষে ওই প্রেসের অস্তিত্বই ছিল না। ওসব বই ছিল পাইরেসির ফসল।

স্কুলের চৌহদ্দি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কায়েসের সঙ্গী হয়ে ঢুকেছিলাম বাংলাবাজার লাগোয়া বিউটি বোর্ডিংয়ে। তখন প্রায় সময়েই ওখানকার চায়ের টেবিলে জড়ো হতেন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হকসহ সমসাময়িক কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় জায়গাটায় রোজই আসতেন সেই সময়ের তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, গল্পকার কায়েস আহমেদ, শাকের চৌধুরী ছাড়াও অনেক তরুণ কবি-সাহিত্যিক। এ দিনগুলোয় গোটা তিনেক গল্প লিখে তাঁদের দলে ভিড়তে পেরেছিলাম। কায়েস তো ছিলই, সেই সঙ্গে নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসানের নিকট-সঙ্গী হয়ে উঠেছিলাম আমি। একদিন আবুল হাসান আমাকে বলল, ‘খান ব্রাদার্স থেকে আমার কবিতার বই বেরোচ্ছে; চল, যাই ওখানে।’

সেবারে প্রকাশনা সংস্থাটি অন্যতম কর্ণধার ফিরোজ খানের (মোসলেম খানের ছেলে) সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় হাসান বলেছিল, ‘বুলবুল গল্প লেখে।’

পরবর্তী সময়ে আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ আর কায়েস আহমেদের সঙ্গে গিয়েছিলাম স্টুডেন্ট ওয়েজের অধিকারী লিয়াকত উল্লাহর সামনে। তারাও ওখানে আমি গল্প লিখি, এমন পরিচয়ই দিয়েছিল। তবে তাদের মতো নিজের কোনো বই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশ পায়নি বুঝে আমি ওদের মতো পুরোপুরি লেখক হওয়ার সাধ ধরেছিলাম।

বাংলাবাজারে গিয়ে শুধু নিজের কিনে নেওয়া বইটিই নয়, প্রকাশকদের প্রকাশিত অন্যান্য লেখকের বইও আমি নজরে নিতাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই তালিকায় ছিল দেশের প্রকৃত লেখকদের অনেক বই। তখন বেরোত বেদুইন সামাদ, আকবর হোসেন ও আকবর উদ্দীনের পাশাপাশি আরও কিছু জনপ্রিয় লেখকের বই। ওই দিনগুলোতেই প্রকাশ পেয়েছিল নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা এবং গল্পকার কায়েস আহমেদের বাইরেও অনেক সম্ভাবনাময় কবি-সাহিত্যিকের বই। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে প্রকাশ করেছিল খান ব্রাদার্স।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় বাংলাবাজারের দিকে মুখ করা হয়েছে খুবই কম। তবে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর চিত্রপরিচালক হওয়ার লক্ষ্যে যোগ দিয়েছিলাম মাসিক সাহিত্য ও সিনেমা পত্রিকা জোনাকীর কাজে। সেটির অফিস ছিল বাংলাবাজারের মাওলা ব্রাদার্সের ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া রাস্তার শেষ সীমানায়। তারই আশপাশজুড়ে স্কুল-কলেজ এবং সাহিত্যের বই বের করার বেশ কয়েকটা প্রকাশনা সংস্থা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। চলতি পথে সেসব দোকানে অনেকের দেখা-সাক্ষাৎ মিলত।

সারি সারি বইয়ের দোকান, এর নাম বাংলাবাজার। ছবি: প্রথম আলো
সারি সারি বইয়ের দোকান, এর নাম বাংলাবাজার। ছবি: প্রথম আলো

জোনাকীর চাকরি নিয়ে চিত্রপরিচালক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় চিত্রজগৎ চোষে বেড়ালেও কোথাও থির হতে না পারার কারণে আমি অন্য মোড় নিয়েছিলাম। তারপর নানা ঘটনা ঘটিয়ে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রথমে একটা হ্যান্ড ফিটিং অফসেট এবং পরে একটা অটোমেটিক অফসেট মেশিনওয়ালা প্রেসে যুক্ত হই। এ ক্ষেত্রে কাজ পেতে দ্বারস্থ হয়েছিলাম বাংলাবাজারের পরিচিত প্রকাশকদের দুয়ারে। তাঁরা তো বটেই, এ সময়ে গড়ে ওঠা অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক, কাকলীর সেলিম আহমেদ, সময়ের ফরিদ আহমেদ ছাড়াও অনেকেই আমাকে কাজে কাজে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাবাজার নিয়ে বকর বকর করতে গিয়ে, বই বিক্রির কথা বললে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালের নাম সর্বাগ্রে এসে যায়। তবে তাঁদের বাইরেও অন্যান্য লেখকের বই পাঠক কমবেশি হাতে তুলে নিয়েছেন।

মাঝে কয়েকটি গল্প লিখে পরিচিতি মিললেও কোনো প্রকাশকের উদ্যোগে নয়, গুরুদেব আবু শাহরিয়ার নিজের পয়সা খরচ করে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ টুকা কাহিনি প্রকাশ করেছিলেন। ওই সংস্করণ ফুরিয়ে যাওয়ার পর বিদ্যা প্রকাশের মুজিবুর রহমান খোকা ওই টুকা কাহিনি ছাড়াও ছাপলেন কহ কামিনীপাপপুর্ণি নামে আমার দুটি উপন্যাস। সময় প্রকাশনের ফরিদ বলতেন, ‘বুলবুল ভাই, আপনার একটা বই ছাপতে চাই।’

তাঁর জন্য লিখলাম জলটুঙ্গি নামের উপন্যাস। কাকলীর সেলিম ভাইয়ের ডাকে ঘরবাড়ি এবং অনন্যার মনিরুলের ডাকে দিলাম দম্পতি নামক উপন্যাস। আগামী প্রকাশনীর ওসমান গণি, নসাসের (নওরোজ সাহিত্য সম্ভার) ইফতেখার রসুল জর্জ বের করলেন আমার দুটো গল্পের বই।

ছাপাছাপির কাজ করতে গিয়ে বাংলাবাজারের প্রায় সব সৃজনশীল প্রকাশকের সঙ্গে ওঠ-বস ঘটলেও মাঝে আমার প্রেসের ব্যবসা গুটিয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমি তাঁদের অনেকের লেখক হয়ে ওখানটায় আজও গতায়াত বজায় রেখেছি। মনে পড়ে, ফরিদ বাংলাবাজারের সময় প্রকাশনের জন্য ঘর নিয়ে যাত্রা শুরুর আগে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, ‘রোজ এসে আমার দোকানে আড্ডা দেবেন, বুলবুল ভাই।’

পরে কখনো-সখনো সময় প্রকাশনায় ঢুকলেও দেখেছি ফরিদ খুবই আটকে আছেন বইয়ের কাজে। শুধু তিনি নন, সব প্রকাশকেরই অমন অবস্থা। আর একুশে বইমেলা উপলক্ষে তাঁদের সবিশেষ ব্যস্ততাই চোখে পড়ে।

ঠিক যে, আমাদের এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো, প্রকাশকেরা দেশের সব লেখকের বই তো বটেই, বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদও প্রকাশ করে যাচ্ছেন। প্রচ্ছদের প্রয়োজনে নানা সময়ে তাঁরা অনেক শিল্পীর দ্বারস্থ হয়েছেন। সেই দলে আছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, মুস্তফা মনোয়ার, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, হাশেম খান, কাজী হাসান হাবিব, আফজাল হোসেন, ধ্রুব এষ, মাসুক হেলাল, মামুন হোসাইন ছাড়াও বেশ কয়েকজন শিল্পী।

বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলী—সে তো আছেই, বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রচ্ছদবিচারও। আজ এই দুই-ই আমাদের বইয়ের ক্ষেত্রে পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হওয়ার দিকে ধাবমান। প্রকাশকেরাও সেগুলো রূপায়িত করতে গিয়ে মুদ্রণ সৌকর্যের ধার ধারছেন। এসবের মিশেল ঘটায় শুধু আমার দৃষ্টিতে কেন, সবার চোখেই বাংলাবাজার হয়ে উঠেছে বইবাড়ির বাংলাবাজার।