রয়েল বেঙ্গল বিটলু

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

বিটলুর ইচ্ছা সে বড় হয়ে বাঘ হবে। যে সে বাঘ নয়। একেবারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ওই যে যেটা সুন্দরবনে থাকে, যাকে সবাই তোয়াজ করে চলে। সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

এমন ইচ্ছা হওয়ার পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। সেবার যখন সবাই মিলে সুন্দরবন বেড়াতে গেল, তখন তার বড় আপা বলেছিল, ‘দেখ বিটলু, বেশি ছোটাছুটি করিস না। বাঘ ধরে নিয়ে যাবে।’

বিটলু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘বাঘ ধরে নিলে কী হবে?’

বড় আপা বলেছিল, ‘কী হবে, সেটা ধরে নিয়ে গেলেই বুঝবি। রয়েল বেঙ্গল টাইগার মুখের কথা নয়। সবাই তাকে ভয় পায়।’

সেদিনই বিটলু ঠিক করে ফেলেছে সে বড় হয়ে বাঘ হবে। সে এমনিতে নরম-সরম মানুষ। ক্লাসে ছাত্র হিসেবেও মাঝারি। কেউ তাকে ঠিকমতো পাত্তাটাত্তা দেয় না। তাই যখন দেখল রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে সবাই কেমন ভয় পায়, তখনই সে তার লক্ষ্য ঠিক করে ফেলল। তার বন্ধুদের কত রকম ইচ্ছা; কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ শিক্ষক হবে। বিটলু হবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার!

বাঘ হওয়ার প্রস্তুতিও সে এখন থেকেই নিচ্ছে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘ্র্যাঁও ঘ্র্যাঁও করে কয়েকটা হাঁক ছাড়ে সে। প্রথম প্রথম বাসার সবাই খুব অবাক হয়েছে। বড় আপা তো বলেই বসেছিল, ‘এমন বিড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করছিস কেন?’

বিটলু বলেছিল, ‘বিড়াল না, আমি বাঘের মতো ঘ্র্যাঁও ঘ্র্যাঁও করছি।’

বড় আপা তারপর আর কিছু বলেনি। কেমন যেন ভয়মাখা চোখে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনো সমস্যা হয় না। বাসার সবাই বিষয়টা মেনে নিয়েছে। প্রতিদিন সকালে তার মুখ থেকে বের হওয়া বাঘের ডাকে সবাই এখন অভ্যস্ত। বিটলু চেষ্টা করছে নখ বড় রাখার। কিন্তু স্কুলের স্যার দেখে ফেললে পিঠে আস্ত বেত ভাঙবে বলে সাহস করে উঠতে পারছে না। তবে সে চিন্তার ভেতর আছে, কোনো না কোনো একটা বুদ্ধি বের করেই ফেলবে।

স্কুল থেকে বিটলু সাধারণত হেঁটেই বাসায় ফেরে। আজও আসছিল সে। দুই হাত দিয়ে ব্যাগের বেল্ট দুটি শক্ত করে ধরে ভাবছিল, বাঘ হলে সে কী কী করবে। একটা আলাদা টি-শার্ট বানাতে হবে। যার ওপর বড় করে ইংরেজিতে বি লেখা থাকবে। বি-তে বিটলু, আবার বি-তে বাঘ। পিঠে থাকবে সুপার ম্যানের মতো লাল কাপড়। সে যখন দৌড়াবে, তখন কাপড়টা পতপত করে উড়বে। দেখতে ফাইন লাগবে। আর চোখে থাকবে কালো রঙের মুখোশ। শুধু চোখ দেখা যাবে। হাঁটতে হাঁটতেই চোখ বন্ধ করে বিটলু নিজেকে চিন্তা করল। কল্পনাতে দেখতে পেল, তাদের বাসার সামনে লাখ লাখ লোক দাঁড়িয়ে আছে। কারও হাতে বিটলুর ছবি, কারও হাতে প্ল্যাকার্ড। সবাই চিত্কার করে স্লোগান দিচ্ছে, ‘আমাদের মাঝে কি বাঘ আছেএএএএএএ?’

এর পরের স্লোগান শোনাচ্ছে সমুদ্রের গর্জনের মতো।

‘আছেএএএএএএএএ...কোন সে বাঘ? বিটলু বাঘ, আরও জোরে, বিটলু বাঘ...’

চোখ বন্ধ করে বিটলু যখন এসব আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিল, ঠিক তখন সে কিছু একটার সঙ্গে ধড়াম করে ধাক্কা খেলো। কিসের সঙ্গে ধাক্কা লাগল, সেটা সে বুঝতে পারল না। তবে ধাক্কা খেয়ে রীতিমতো উড়ে গিয়ে পড়ল খানিকটা দূরে। চোখ খুলে তাকানোর আগেই বুঝতে পারল, বেশ কয়েকজন মানুষ তাকে টেনে ওপরে তুলে ফেলেছে। এমন কিছুর জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।

ঘাড়ের ওপর বসেই বিটলু দেখতে পেল তাকে ঘিরে বেশ কিছু মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠিক সামনে পড়ে আছে হ্যাংলা-পাতলা ধরনের একটা ছেলে। পাবলিক ইতিমধ্যেই ছেলেটাকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। ছেলেটার সামনে একজন মোটাসোটা মহিলা দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে হ্যান্ডব্যাগের ভেতরটা উথালপাতাল করছে। যেন সেখানে কোনো গুপ্তধন লুকানো আছে।

ঘটনা ঘটেছে অনেকটা এমন: বিটলু চোখ বন্ধ করে বাঘ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছিল ফুটপাত দিয়ে। ঠিক সেই সময় এক ছিনতাইকারী একজন মহিলার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। অন্য সময় হলে কিংবা চোখ খোলা থাকলে বিটলু কখনোই ছিনতাইকারীকে ধরার চেষ্টা করত না। কিন্তু চোখ বন্ধ থাকায় সে সোজা গিয়ে ধাক্কা খায় ছিনতাইকারীর সঙ্গে। এক ধাক্কাতেই কুপোকাত হয়ে গেছে হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটা। ধরা পড়েছে। আর লোকজন ভেবেছে, একটা বাচ্চা ছেলে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেছে!

এই ঘটনা নিয়ে পরদিন একটা অখ্যাত পত্রিকায় ছোট্ট একটা খবর ছাপা হলো। শিরোনাম অনেকটা এমন, ‘এ যেন ছোট্ট রয়েল বেঙ্গল টাইগার!’ বিটলু খবরটা কাঁচি দিয়ে কেটে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। হোক না সেটা ছোট্ট খবর। কিন্তু সে জানে, এটা তার রয়েল বেঙ্গল টাইগার হওয়ার পথে ছোট্ট একটা ধাপ। তার ভাগ্যে লেখা আছে বাঘ হওয়া। আর কেউ সেটা ঠেকাতে পারবে না!