শীলা বসাকের পূর্ণ ছবি

শীলা-লিপিমালা
শীলা-লিপিমালা

লোকসংস্কৃতি গবেষক শীলা বসাকের সঙ্গে জানাশোনার শুরু তাঁর বাংলার কিংবদন্তি বই মারফত। এ বইয়ে দুই বাংলার বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা নানান কিংবদন্তি, এর উৎসমুখ এবং কিংবদন্তিগুলো গড়ে ওঠার পেছনের কাহিনি পড়ে রীতিমতো শিহরিত হয়েছিলাম। এরপর পড়া হলো বাংলার নকশি কাঁথা। লেখকের কী বিস্তর পরিশ্রম এই বইয়ে! মাঠ সমীক্ষার ভিত্তিতে নকশি কাঁথার উৎস সন্ধান করে এখানে তিনি নকশাদার কাঁথার ক্রমবিকাশকে যেভাবে সাজিয়েছেন, তা চমকজাগানিয়া। এক্ষণে মনে পড়ছে, বাংলার নকশি কাঁথার একটি অংশ: ‘চট্টগ্রামের ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে যে বাড়িতে ছিলাম, রাতে শোবার সময় দেখি গায়ে দেবার জন্য পায়ের কাছে একটি নকশি কাঁথা ভাঁজ করে রাখা হয়েছে। কাঁথা অনুসন্ধান করতে গিয়ে নকশি কাঁথা গায়ে দিয়ে শোয়া—এ যে কী অনুভূতি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম, ভাষায় তা বলা যাবে না।’
হ্যাঁ, নিষ্ঠার সঙ্গে অনুভবের যোগ ঘটলেই দিনের পর দিন লোকসংস্কৃতির বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করা যায়। কখনো কিংবদন্তি, নকশি কাঁথা, ধাঁধা, ব্রতপার্বন, কখনো বা প্রবাদ-প্রবচন—এগুলো নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে শীলা বসাক সেই কাজটি যথার্থভাবেই করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও মিলেছে, পেয়েছেন ‘লোকসংস্কৃতি গবেষণা পদক’ ও ‘আনন্দ পুরস্কার’।
ভাবার কারণ নেই, কলকাতার বাসিন্দা শীলা বসাকের দুটি মাত্র বই পড়েই তাঁর সমন্ধে লেখা হচ্ছে এসব। দুই বইয়ের বাইরে সম্প্রতি পড়া হয়েছে আরেকটি বই—শীলা-লিপিমালা। বাংলাদেশের আনিসুজ্জামান এবং কলকাতার পবিত্র সরকার ও পল্লব সেনগুপ্ত—ত্রয়ী মিলে সম্পাদনা করেছেন এই ঢাউস গ্রন্থ। আদতে এটি শীলা বসাক স্মারকগ্রন্থ। ২০১৫ সালের ৮ মার্চ শীলার আকস্মিক মৃত্যুর পর ২০১৭ সালে বেরিয়েছে বইটি।
স্মারক বই হলেও এখানে পাওয়া যাবে তার চেয়ে বেশি কিছু। একজন নিষ্ঠ গবেষকের অবয়ব নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় বিবেচনায় রাখা যেতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই সংকলন; এক ঝলকে সূচির দিকে তাকালেই বিষয়টি মালুম হয়। সম্পাদকেরা একে সাজিয়েছেন কয়েক ভাগে: শীলার ‘স্মৃতিচারণ’, তাঁর ‘গ্রন্থালোচনা’, ‘পত্রপত্রিকায় শীলা’, ‘চিঠিপত্র’—এগুলোর সঙ্গে ‘মৌলিক রচনা’ অংশে জুড়ে দিয়েছেন লোকসংস্কৃতির বহুমাত্রিক উপাদান নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের একগুচ্ছ লেখা। ফলে শীলাকে জানা-বোঝার পাশাপাশি লেখাগুলো পড়ে পাঠক তাঁর আজীবনের কাজের ক্ষেত্র যে লোকসংস্কৃতি, তার নানা অনুষঙ্গ সম্পর্কেও জানতে পারবেন সহজেই। এটিই প্রথাগত সংকলন থেকে বইটিকে ভিন্ন করে তুলেছে।

>

শীলা-লিপিমালা
সম্পাদনা: আনিসুজ্জামান, পবিত্র সরকার ও
পল্লব সেনগুপ্ত
প্রচ্ছদ: কৃষ্ণেন্দু চাকী, প্রকাশক: পুস্তক বিপণি, কলকাতা, প্রকাশকাল: মে ২০১৭, পৃষ্ঠা: ৫০৭
দাম: ৬৪০ টাকা।

বইয়ের শুরুতে সম্পাদক ত্রয়ের ‘পূর্ববাচন’-এর স্মরণ নেওয়া যাক: ‘যাঁরা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে জানতেন তাঁদের অনেকেই দেখেছেন যে কীভাবে পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশের দূর দূর প্রান্তের নানা গ্রামে পৌঁছে গিয়ে মৃত্তিকা-সংলগ্ন মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলে শীলা তাঁর গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন, এবং তীক্ষ্ণধী বিশ্লেষণের সাহায্যে সেগুলিকে সংস্কৃতিজিজ্ঞাসু পাঠকের জন্য সাজিয়ে দিয়েছেন।’
শীলার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগটি নানাজনের লেখাতেই স্পষ্ট। ‘স্মৃতিচারণ’ অংশে ‘দেশজ ভাবনায় শুদ্ধ মানুষ’ লেখায় ডিজাইন বিশেষজ্ঞ চন্দ্রশেখর সাহা যেমন বলেছেন: ‘বাংলাদেশের যশোর, রাজশাহী, জামালপুর ও চট্টগ্রামে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছিলেন নকশি কাঁথার গভীরে অবগাহন করে, বিষয়বস্তুর অন্তরটাকে আবিষ্কার করতে।’ কেবল তা-ই নয়, লোকসংস্কৃতি গবেষক আশরাফ সিদ্দিকীকে গুরু মানতেন তিনি। যোগাযোগ ছিল ওয়াকিল আহমেদ, মোহাম্মদ সাইদুর, শামসুজ্জামান খান—এই বাংলাদেশি লোকসংস্কৃতি গবেষকদের সঙ্গে। আর আনিসুজ্জামান, আবদুল খালেক, রুবী রহমান, সেলিনা হোসেন, আবুল আহসান চৌধুরী, লিলি ইসলাম প্রমুখের সঙ্গে ছিল তাঁর হৃদিক সম্পর্ক। ফলে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও আলোচ্য বইটি বাংলাদেশের অনেকের লেখায় সমৃদ্ধ, বিভিন্ন লেখায় বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির বিচিত্রতার প্রসঙ্গও এসেছে।
ওপার বাংলার বিশিষ্টজনেরাও মূল্যায়ন করেছেন তাঁকে। এঁদের মধ্যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নবনীতা দেবসেন, সমরেশ মজুমদার, তপোধীর ভট্টাচার্য, দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন আছেন, একইভাবে রয়েছেন দুলাল চৌধুরী বা শিবেন্দু মান্নার মতো লোকসংস্কৃতিবিদও।
মোদ্দা কথা, গবেষক ও ব্যক্তি—দুই শীলা বসাক, দুই শীলার লিপিমালাই ধরা আছে এই পুস্তকে। কখনো গবেষক শীলার মুখ, কোনো সময় আটপৌরে, পারিবারিক শীলার খণ্ড খণ্ড ছবি—এভাবে পুরো বইয়ে শীলা বসাকের একটি পূর্ণ ক্যানভাসই তো পাই আমরা।
‘শীলার অমলিন স্মৃতি’ নামে আনিসুজ্জামানের লেখার অংশ উদ্ধৃত করে এ লেখায় ক্ষান্ত দেব: ‘ধাঁধা-ব্রত-কিংবদন্তি-নকশিকাঁথা—যে-বিষয়েই শীলা গবেষণা করে থাকুন না কেন, তার লক্ষ্য ছিল সে-বিষয়ের সামাজিক দিকটি অধ্যয়ন করা।...খুব কম গবেষকই এত শ্রম দিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেন। তার অধীত বিষয়ের সঙ্গে নাড়ির যোগ রয়েছে সাধারণ মানুষের।...তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে সে যায়নি, জীবনের সরল সত্যকে পুনরাবিষ্কার করতে চেয়েছে এবং তাতে সফল হয়েছে।’
কীভাবে লৌকিক মানুষের ‘সরল সত্যকে পুনরাবিষ্কার’ করেছেন শীলা, জানতে হলে এই শীলা-লিপিমালা পড়তে হবে তো বটেই, আরও ভালো হয় পাঠক যদি আরেক পা এগিয়ে শীলা বসাকের লেখা বইগুলোও পড়েন।