রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা: পুনশ্চের অস্পষ্টতা

২ মার্চ ‘শিল্পসাহিত্য’ পাতায় রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা প্রশ্নে মোহাম্মদ আজম যে ‘পুনশ্চ’ সংযুক্ত করেছেন, তাতে ‘মাতৃভাষা’ সম্পর্কে দেওয়া ব্যাখ্যা সীমিত অর্থে সত্য। প্রধানত অঞ্চলবিশেষের উপভাষাকে তিনি মাতৃভাষা বলেছেন। অথচ মাতৃভাষা আর অঞ্চলবিশেষের উপভাষা আলাদা হতে পারে। যেমন জার্মানিতে বসবাসকারী একটি ফ্রেঞ্চ দম্পতির সন্তানের মাতৃভাষা নিশ্চয় ওই অঞ্চলের ভাষা হবে না। এমনকি উপভাষা বলতেও কেবল আঞ্চলিক ভাষাকে বোঝানো হয় না। সাধারণ মানুষেরও ধারণা, অঞ্চলগত ভাষিক পার্থক্য নিয়েই একটি ভাষার নানা উপভাষা তৈরি হয়। অথচ উপভাষার আরেকটি প্রধান ভাগ হলো সামাজিক উপভাষা—যেখানে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগত ও পেশাগত ভাষার বৈচিত্র্যকে উপভাষিক মর্যাদা দেওয়া হয়। এমনকি এটাও বলা হয়, প্রত্যেক মানুষের ভাষিক বৈশিষ্ট্য যেহেতু এক নয়, অতএব, প্রত্যেক মানুষই আলাদা আলাদা উপভাষা বহন করে। মোহাম্মদ আজমের ‘মাতৃভাষা’র সংজ্ঞায়নের সঙ্গে একে মেলাতে গেলে বলতে হয়, পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষ একেকটি ‘মাতৃভাষা’র প্রতিনিধি!

আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষার শিশুরা বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রমিত বাংলা শেখে, যাকে মোহাম্মদ আজম বলেছেন ‘দ্বিতীয় ভাষা’। আসলে এটি ‘প্রথম ভাষা’। শিশুর প্রথম ভাষা তার আঞ্চলিক ভাষা ও মাতৃভাষার অনুরূপ হতে পারে; কিন্তু এগুলো এক অর্থ বহন করে না। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে মাতৃভাষার সম্পর্ক স্থাপনের সময় আঞ্চলিক উপভাষার বিষয়টিকে টেনে আনা খুব যৌক্তিক হয় না। আর ‘মাতৃভাষা নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনো বিরোধ নেই’ বলতে যদি বোঝানো হয়—যে যার মতো কথা তো বলেই, কে বাধা দেয় তাকে—তবে ভাষার রাজনীতি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। ‘বাংলাদেশের মানুষ নদীয়ার ভাষায় কথা বলবে, নাকি মৈমনসিং-এর বাংলায় কথা বলবে—এ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোনো উদ্বেগ ছিল না’ বলছেন? এর চেয়েও ভয়ংকর উদ্বেগ ছিল। ১৯৪৯ সালে গঠিত ‘পূর্ববঙ্গ সরকারী ভাষা কমিটি’ যেসব সুপারিশ করেছিল ‘শহজ বাংলা’ নামে, তাতে সংস্কৃত (অর্থাৎ হিন্দুয়ানি) শব্দ কমিয়ে আরবি-ফারসি (অর্থাৎ মুসলমানি) শব্দ বাড়ানোরও সুপারিশ ছিল। এই উদ্যোগকে মুনীর চৌধুরী (১৯৭০), হুমায়ুন আজাদ (১৯৮৪) মেনে নেননি। কারণ, তা শুধু লিখিত বাংলাকেই আক্রান্ত করত না, আমাদের মুখের বচনকেও ‘পাক’-পবিত্র করে দিত!

তারিক মনজুর

সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।