এ লেখা লইয়া কী করিব?

>

বহু কাল আগের কথা। ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ শিরোনামে নতুন লেখকদের প্রতি কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আসছে ৮ এপ্রিল তাঁর মৃত্যুদিন। এ দিন স্মরণে আজ খুঁজে দেখা হয়েছে অনেক কাল আগের সেই উপদেশমালার প্রাসঙ্গিকতা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২৭ জুন ১৮৩৮–৮ এপ্রিল ১৮৯৪) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২৭ জুন ১৮৩৮–৮ এপ্রিল ১৮৯৪) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

জীবন নিয়ে কমলাকান্তের আর্তনাদ/আত্মজিজ্ঞাসার পরিধিটা একটু বিস্তৃত করলে, এবং কমলাকান্তকে এ যুগের একজন লেখক কল্পনা করলে, শিরোনামের প্রশ্নটি একটি যথার্থতা পায়। খারাপ লেখা হলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলুন, বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন কমলাকান্তকে, ভালো হলে এ নিয়ে ভাবতে থাকুন—যেমন, কাকে শোনাবেন লেখাটা? কোথায় ছাপাবেন? কেন ছাপাবেন? ইত্যাদি। এগুলোর নিষ্পত্তি করেই এগিয়ে যাবেন কমলাকান্ত, বঙ্কিমচন্দ্র তাই ধরে নিচ্ছেন।
তারও আগে অবশ্য কমলাকান্তকে লেখার কলাকৌশল আর কলকবজা নিয়ে ভাবতে হবে। লেখার অলংকার বিষয়ে তাঁকে পাকা জহুরি হতে হবে। তাঁর চিন্তায় জটিলতা থাকলেও প্রকাশে সারল্য থাকবে। কাউকে তিনি অনুকরণ করবেন না। কবিতা লিখতে বসলে জীবনানন্দ তাঁকে আচ্ছন্ন করলে চলবে না, উপন্যাস লিখতে বসলে গারসিয়া মার্কেজের এক শ হাত দূরে থাকতে হবে।
এই সব।
১৮৮৫ সালে (মাঘ, ১২৯১ বঙ্গাব্দ) বঙ্কিমচন্দ্র ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের’ প্রতি একটি উপদেশমূলক নিবেদন হাজির করেন, যাতে ১২টি সূত্রে তিনি লেখালেখি নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তাকে সাজান। ১৮৮২ সালের দিকে বঙ্কিমচন্দ্রের মনোজগতে একটা বড় পরিবর্তন হয় বলে তাঁর জীবনীকাররা আমাদের জানান। তিনি পশ্চিম থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতীয় দর্শন, ধর্মচিন্তা ও ভাবধারায় নিজের অবস্থানটি খুঁজে পান। পশ্চিমকে তিনি অবশ্যই ফেলে দেননি, পশ্চিমা সাহিত্য ও দর্শনের তিনি নিবিষ্ট পাঠক থেকে যান, কিন্তু স্বজাতিচিন্তা ও ভারতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর একটি অহংকার জাগে, তিনি ইতিহাস ও সমাজ নিয়ে আংশিক উত্তর-উপনিবেশী অবস্থানে নিজেকে স্থাপন করেন।
কমলাকান্তকে বাদ দেওয়া যাক—১৮৮৫ ও ২০১৮-এর মধ্যে বিস্তর ফারাক। আমাদের নব্য লেখকেরা যে সময়ে আছেন, তা ১৮৮৫-এর আফিমসুখী কমলাকান্তের কল্পনাতেও হয়তো আসত না। তবে বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশগুলো তো আর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েনি। অর্থাৎ, এর অনেকগুলো এখনো সচল মুদ্রা। এবং মুদ্রাগুলো কেন সচল অথবা কেন অচল—এ বিষয়ে আমাকে লিখতে বলেছেন প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক মহোদয়।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, কোন লেখক—নব্য অথবা অনব্য—কী লিখবেন, কীভাবে লিখবেন, তা নিয়ে কারও উপদেশ দেওয়াটা আমার পছন্দ নয়। লেখক যত বড়ই হন, তাঁর উপদেশ মেনে কেউ যে ভালো লেখক হয়ে যেতে পারেন, তা আমি মনে করি না। তবে দু-এক উপদেশ মনে রাখা ভালো, তাতে লেখার আগে কিছু চিন্তা পরিষ্কার হয়, লেখার সময় কিছুটা উপকার হয়তো পাওয়া যায় এবং লেখা শেষ হলে তার প্রকাশ ও অন্যান্য বিষয়ে একটা পথনির্দেশনা হয়তো মেলে। অর্থাৎ, লিখতে বসে যতটা না সহায়তা করবে উপদশেগুলো, লেখা শুরুর আগে ও লেখা শেষ হলে—লেখা-ব্যবস্থাপনায়—করবে তার চাইতে বেশি।
এজরা পাউন্ডের একটি উপদেশসূত্র আমি আধুনিক পশ্চিমা সাহিত্যের ক্লাসে কয়েক বছর পড়িয়েছি। লেখাটি হচ্ছে ‘আ রেট্রোস্পেক্ট’ এবং এটা ১৯১৩ সালে পোয়েট্রি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। এতে পাউন্ড কবিদের বলেন, বিষয়ের সরাসরি উপস্থাপনা করবেন; কবিতার প্রকাশে যেসব শব্দ কোনো ভূমিকা রাখে না, সেগুলো একেবারেই পরিহার করবেন এবং সাঙ্গিতিক শব্দবন্ধে কবিতা লিখবেন। ইত্যাদি। খুব ভালো উপদেশ। কিন্তু এগুলো মেনে কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন, এমন কবির সন্ধান আমি পাইনি।
বঙ্কিমচন্দ্র নিজে তাঁর দেওয়া উপদেশ কতটা মেনেছেন, তা গবেষণার বিষয় বটে, তবে তিনি তো ১৮৮৫ সালে আর নব্য লেখক ছিলেন না। যখন ছিলেন, তখন এসব উপদেশ তাঁর মাথায় ছিল কি না কে জানে, থাকলে তাঁর লেখা নিশ্চয় আরও সরল হতো, তিনি হয়তো ‘ইংরেজ ভারতবর্ষের পরমোপকারী’ অথবা শেক্সপিয়ারের উপনিবেশী ঠাকুর প্রসপেরো যে ‘ঋষিতুল্য’—এসব কথা লেখার আগে দুবার ভাবতেন। তবে উপদেশ দেওয়ার একটি আনন্দ হলো, নিজে তা অনুসরণ না করলেও চলে, যেহেতু উপদেশদানকারী একটি উঁচু আসনে বসেই সৎকর্মটি করেন।
বঙ্কিমচন্দ্র অবশ্য সৎকর্ম হিসেবেই ১২ সূত্রের উপদেশ দিয়েছেন। এ জন্য একে সম্মান করতে হবে।
২০১৮ সালের নব্য লেখক তাঁর কয়েকটি উপদেশ মনে রাখতে পারেন, যেমন ‘যশের জন্য লিখিবেন না।’ এবার ফেব্রুয়ারির বাংলা একাডেমির বইমেলায় যাঁদের বই ছাপা হলো, তাঁদের অনেকের মধ্যে যশাকাঙ্ক্ষা তীব্র ছিল। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বইয়ের বাজারে একটা শোরগোল তোলা অনেকের উদ্দেশ্য ছিল।
বইয়ের সঙ্গে যখন নিজের রঙিন ছবিটিও (বইয়ের প্রচ্ছদ থেকেও কলাম-ইঞ্চিতে যা বড়) ছাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন ধরে নিতে হবে তিনি বইভিত্তিক ও চেহারাভিত্তিক স্বীকৃতি ও যশ—উভয় প্রত্যাশা করেন। ফেসবুকে বই নিয়ে যে প্রচার চলে, তাতেও যশ-প্রত্যাশার আকাঙ্ক্ষা প্রবল।
বঙ্কিম বলেন, ‘তাহাতে যশও হয় না, লেখাও ভালো হয় না।’ এই উপদেশের পাশে V. V. Imp লিখে রাখুন।
বঙ্কিমচন্দ্র আরও বলেন, যদি ‘বুঝতে পারেন যে লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।’ কথাটা এ সময়ের নব্যলেখকদের নিশ্চয় ধন্দে ফেলবে। দেশ বা মনুষ্যজাতির মঙ্গল একজন লেখক কতটা এবং কীভাবে করবেন? তিনি তো কবিতা-গল্প-নাটক লেখেন, প্রবন্ধ রচনা করেন, মরণব্যাধির ওষুধ তৈরি করেন না। বই পড়ে এখন মানুষ কি বদলে যায়, খারাপ মানুষ ভালো মানুষ হয়ে যায়? কে জানে। একজন লেখক লেখেন লিখতে ইচ্ছে হয়, আনন্দ হয় বলে। এত বিশাল বঙ্কিমী উদ্দেশ্য নিয়ে লিখতে গেলে লেখাটা ভাববাদী হয়ে যাবে, এর ভেতরের আনন্দ সংকটে পড়বে। হিতকারী লেখালেখির দিন কি এখনো আছে?
‘টাকার জন্য লিখবেন না।’ বঙ্কিম বলেন। নব্য লেখক তাঁর সময়ে যেমন ছিলেন, আমাদের সময়েও তেমন, বাজারের বিচারে প্রান্তজন। টাকা যে আদৌ পাবেন, সেই নিশ্চয়তাও তো কোনো নব্য লেখকের নেই। টাকা পাবেন কি, গাঁটের পয়সা খরচ করে বই ছাপান অনেক নব্য লেখক। বাংলাদেশে লিখে টাকা পান হাতে গোনা কয়েকজন লেখক, প্রকাশকেরা টাকার ব্যাপারে যেহেতু খুবই সতর্ক। বঙ্কিমচন্দ্র প্রকাশকদের জন্য কোনো উপদেশবাণী রেখে গেছেন কি না, জানি না। ‘লেখকদের টাকা মারিয়া দেবেন না, ইহাতে জ্ঞানজগতের যেমন ক্ষতি, তেমনি মনুষ্যসমাজেরও’—এমন কথা তিনি বললে হয়তো কিছু প্রকাশক লেখকবান্ধব হতেন।
খুব ভালো একটি উপদেশ হলো ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না।’ এক তরুণ লেখক গত বইমেলায় আমাকে জানালেন, তাঁর পাঁচটি উপন্যাস মেলায় এসেছে। এক বছরে পাঁচটি উপন্যাস! তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশ শুনে উপন্যাসগুলো কয়েক বছর ফেলে রেখে সংশোধন করলে হয়তো এক বছরের ৫টি x কয়েক বছর=অসংখ্য উপন্যাস একটি বা দুটি উপন্যাস হিসেবে ছাপতে দিতেন।
বৃক্ষেরা তাঁকে সাধুবাদ দিত। পাঠকেরাও।
বঙ্কিম বলেন, যে বিষয়ে যার অধিকার নেই, সে বিষয়ে তার হস্তক্ষেপ করাটা অকর্তব্য। এটি মনে রাখার মতো একটি উপদেশ। তিনি আরও বলেন, বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করবেন না, বিদ্যা আপনিতেই প্রকাশ পায়।
১৮৮৫ আর ২০১৮ সালের বাস্তবতার মধ্যে তাহলে এই একটা ব্যাপারে ফারাক নেই।
অলংকার নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র কয়েকটি উপদেশ দিয়েছেন—‘অলংকার প্রয়োগে রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না।’ তিনি বলেন এবং বুঝিয়েছেন, ব্যঙ্গ কৌতুক ও অন্যান্য ‘সামগ্রী’ যার আছে, তার আছে; না থাকলে চেষ্টিত হয়েও লাভ নেই।
খাঁটি কথাই বটে।
অলংকারের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, অলংকারের সুন্দর একটা প্রয়োগ হয়েছে ভেবেও তা বারেবারে বাজিয়ে দেখবেন, বন্ধুবর্গকে কয়েকবার পড়ে শোনাবেন। যদি প্রকৃতই সুন্দর হয়, আপনার পড়তে লজ্জা করবে না। প্রকৃত না হলে পড়তে লজ্জা হবে। অর্থাৎ ‘এ অলংকার লইয়া আমি কী করিব’ ধরনের গ্লানি আসবে। বঙ্কিমের ‘বন্ধুবর্গের’ জায়গায় লিখুন ‘ফেসবুকের বন্ধুবর্গ’, যেহেতু আপনার কবিতা-গল্প শোনার মতো ধৈর্য কাছের বন্ধুটিরও আর নেই।
তারপর বঙ্কিম বলেছেন সরলতার কথা। সরলতার কোনো বিকল্প নেই। এই একটি উপদেশ বড়ই খাঁটি, যদিও মানাটা সবচেয়ে কঠিন।
দুটি নীতিধর্মী উপদেশ বঙ্কিমচন্দ্র দিয়েছেন—একটি হলো, যা অসত্য, ধর্মবিরোধী, যা পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধনের কাজে লাগে, তা পরিহার্য। এই উত্তরাধুনিক যুগে সত্য-অসত্য, পরনিন্দা-পরবয়ানে যে ঠোকাঠোকি লাগে, ধর্মের ব্যাখ্যা নিয়ে ধাঁধার সৃষ্টি হয়, তাতে এই উপদেশ একটা জটিল ব্যাখ্যার বিষয় হয়ে ওঠে। তা ছাড়া, তিনি যখন লেখেন, ‘সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য’, তখন প্রশ্ন জাগে, কার সত্য ও কোন ধর্মের কথা তিনি বোঝান?
দ্বিতীয় নীতিকথাটি হলো, ‘যে কথা প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না।’ প্রবন্ধ বা সংবাদপত্রের কলামের ক্ষেত্রে কথাটি হয়তো খাটে, কিন্তু কবিতা-গল্প-উপন্যাসের বেলায়?
জাদুবাস্তবতা তাহলে কোথায় পালায়? কবিতার অতিকথন বা hyperbole?
এক জায়গায় বঙ্কিমচন্দ্র ‘যাত্রাওয়ালাকে’ ‘নীচ’ ব্যবসায়ী বলেছেন। তাঁর এই কথায় মনে কষ্ট পেয়ে হয়তো এ যুগের যাত্রাওয়ালারা যাত্রানাটকে প্রিন্সেসদের নাচ দেখিয়ে টু পাইস কামাই করতে চেষ্টিত হয়েছেন। বেচারাদের কেন তিনি নীচ বলছেন?

দুই.
আমি নব্য লেখক নই, আমি বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশমালাকে, এজরা পাউন্ডের নসিহতনামার পাশে রেখে পড়লেও সেগুলোকে তেমন গ্রাহ্য না করলেও পারি। কিন্তু নব্য লেখকেরা যদি এগুলো পড়েন, এগুলো নিয়ে ভাবেন এবং যেটুকু যুক্তিযুক্ত মনে করেন, সেটুকু গ্রহণ করেন, ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে’ (বঙ্কিমের শেষ কথা) কি না কে জানে, কিন্তু কিছু সুসম্পাদিত লেখা হয়তো জাতি পাবে; অনেক খারাপ লেখা অপ্রকাশিত থেকে যাবে।