ফওজিয়ার আম্মা

ফওজিয়ার আম্মার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বড় জ্যাঠার কুলখানির সময়। সঙ্গে তাঁর মা—ফওজিয়ার নানিও ছিলেন। আমার বড় জ্যাঠা ছিলেন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। রাজনীতির সঙ্গে তিনি সক্রিয় না থাকলেও শহরের অনেক নেতাই তাঁকে মান্যগণ্য করতেন। জ্যাঠার মৃত্যুর সময় আমি বেশ ছোট—ক্লাস ফাইভে পড়ি। কে কত বড় নেতা, তা বোঝার সামর্থ্য তখন আমার ছিল না। কিন্তু দেখতে পেয়েছিলাম অনেকেই এসে বৈঠকখানায় মলিন মুখে বসে আছেন, জ্যাঠার সমবয়সী কেউ কেউ রুমালে চোখ মুছছেন—এমন দৃশ্যও মনে পড়ে। আমাদের বাড়িটা পুরোনো আমলের উঠোনঅলা বাড়ি। বাইরের যে লম্বা ঘরটাতে আমরা প্রাইভেট টিউটরদের কাছে পড়তাম আর কেউ এলে বসতে দেওয়া হতো, আমরা সেটাকে বলতাম ‘বৈঠকখানা’। আর ভেতরের দিকের সারি সারি ঘরগুলোতে আমরা থাকতাম।

ফওজিয়ার আম্মা যে ফওজিয়ারই আম্মা, সেটাও তখন জানতাম না আমি। শুধু দেখছিলাম অতি সুন্দরী এক মহিলা ততোধিক সুন্দরী এক বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে জেঠিমার ঘরে বসে আছেন। আমরা বড় জ্যাঠাকে ডাকতাম জেঠু আর জেঠিকে জেঠিমা। জেঠু মারা যাওয়ার পর জেঠিমা অতটা ভেঙে পড়েননি, দাদি মোটামুটি শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। ফওজিয়ার আম্মা আর তার নানি বসে ছিলেন জেঠিমার ঘরের খাটে, পা ঝুলিয়ে। ফওজিয়ার আম্মা একবার উঠে দাদির ঘরে গেলেন, দাদিকে দেখতে। দাদির ঘরের পালঙ্কটা অনেক উঁচু, তাতে কেউ পা ঝুলিয়ে বসতে পারে না। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল একটা চেয়ার নিয়ে তাঁকে সেখানে বসার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই ফওজিয়ার আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাচি, আমারে চিনছেন?’ দাদি শান্তভাবে বললেন, ‘তুমি রহমতের বইন না?’

দাদির ঘর পার হয়ে জেঠিমার ঘরের মধ্য দিয়ে খাবারঘর থেকে চেয়ার আনার সময় আমি শুনলাম ফওজিয়ার নানি জেঠিমার সঙ্গে আক্ষেপ করছেন অনেক কিছু নিয়ে, থেকে থেকে ওড়নার আঁচলে চোখ মুছছেন, শাড়ির ওপর সাদা একটা ওড়না পেঁচিয়ে পরে এসেছিলেন উনি। আম্মা দাদির পানের বাটা এনে জেঠিমার পাশে বসে পান বানাচ্ছেন আর মেজ ফুফু জেঠিমার মাথায় ঠান্ডা তেল মালিশ করে দিচ্ছেন। এ সময় আমার মনে হলো, বৃদ্ধার কথা বলার ধরন একটু অন্য রকম। বাংলা হলেও উচ্চারণটা ঠিক আমাদের মতো না। তখন আমি ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমাদের পাশের বাসার হালিমা আর সলিমার আম্মাও একটু অন্যভাবে কথা বলেন, ওনার বাপের বাড়ি নাকি উত্তরবঙ্গে। ফওজিয়ার নানিরাও হয়তো অন্য কোথা থেকে এসেছেন। তাই অন্য টানে কথা বলেন। কুলখানির সময় মরা বাড়ির চেহারা আর গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হতে থাকা বাড়ির আনুষ্ঠানিকতায় তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না। ফাই-ফরমাশ করার জন্য সবাই বাচ্চাদেরই ডাকতে থাকে।

ফওজিয়ার আম্মা যে আসলে ফওজিয়ার আম্মা, সেটা আমি জানতে পারি স্কুলে। আমাদের স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার পরে একটা বার্ষিক ভোজ হতো প্রতিবছর। আমরা বলতাম ফিস্ট। একবার ফিস্টে খাবার দিতে অনেক দেরি হলো। অনেক অভিভাবকই মেয়েদের নিতে স্কুলে চলে এলেন সেবার। তখন আমি ফওজিয়ার আম্মাকে দেখলাম গেটের এক পাশে দুই হাত জড়ো করে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। খাবারের প্যাকেট হাতে পাওয়ার পর সবাই যখন যার যার মা-বাবা কিংবা বড় ভাইবোনদের কাছে যাচ্ছে, তখন দেখলাম ফওজিয়া জোরে হাঁটা আর দৌড়ের মাঝামাঝি একটা গতিতে ‘রহমতের বইন’-এর কাছে গিয়ে তাঁর হাত ধরল। সাধারণ একটা শাড়ি পরেছিলেন, সাজগোজ একেবারেই করেননি, কিন্তু তাঁকে দেখতে আর সব খালাম্মার চেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল।

পরদিন আমি ফওজিয়াকে বললাম যে তার মা আমাদের বাসায় গিয়েছিলেন কয়েক মাস আগে। ফওজিয়া কোনো উচ্ছ্বাস দেখাল না। আমাদের পাড়ার যে বাড়িটা দেখতে বেশ পুরোনো আর ‘আরমান ভাইদের বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত, সেটা যে তার নানার বাড়ি—এই তথ্য তখন সে আমাকে দিল, একটু বিরস বদনেই। সঙ্গে বলল যে ওই বাড়ির সঙ্গে তাদের তেমন সম্পর্ক নেই, তার মা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন বলে মামারা বোনকে বাড়িতে যেতে-টেতে বলেন না, তার আম্মাই মাঝেমধ্যে যান নানিকে দেখতে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে আমি তখন পরিচিত (যদিও সিক্সে পড়া বয়সে প্রকাশ্যে ‘প্রেম’ শব্দটা উচ্চারণ করতাম না আমরা), তাই বিস্মিত হইনি। যেহেতু মামার বাড়ির আবদারের মতো ব্যাপারের সঙ্গে ফওজিয়া অভ্যস্ত নয়, তাই আমি আর এ নিয়ে তাকে কিছু বললাম না। বেচারার জন্য আমার একটু কষ্টই হলো। বার্ষিক পরীক্ষার পরে আমরা মামার বাড়ি যেতাম, ফওজিয়া তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও যায় না, পরীক্ষার পর বাড়িতেই থাকে।

বাসায় এসে আমি আম্মাকে বললাম যে জেঠুর কুলখানির সময় যে অন্য রকমভাবে কথা বলা বৃদ্ধা এসেছিলেন আর তাঁর সঙ্গে যে ভদ্রমহিলা ছিলেন, তাঁরা আমার এক সহপাঠীর নানি আর মা। আম্মা বললেন, ‘ও রুখসানা? রুখসানার মাইয়া তগোর লগে পড়ে নাকি? কী নাম অর? কয় ভাই-বইন?’ ফওজিয়ার আম্মার নাম রুখসানা, সেটাও আমি সেদিন জানলাম। ফওজিয়ার কোনো ভাইবোন আছে বলে জানতাম না। বললাম সে কথা। দুপুরের দিকে আব্বা অফিস থেকে এসে প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরছেন, সে সময় আম্মা আলনার কাপড় ভাঁজ করতে করতে আব্বাকে বললেন, ‘রুখসানার মাইয়া নাকি তানিয়াগোর লগে পড়ে।’ আব্বা দাঁতে লুঙ্গির একটা প্রান্ত কামড়ে ধরে প্যান্ট থেকে আন্ডারওয়্যার বের করে আলনার এক কোনায় রাখতে রাখতে ‘হু’ ধরনের একটা আওয়াজ করলেন।

আমি তখন পেছনের লম্বা বারান্দায় বসে কারও কাছ থেকে ধার আনা একটা বই পড়ছিলাম। পরের দিন সেটা ফেরত দিতে হবে বলে গোগ্রাসে গিলছিলাম আসলে। এরই মধ্যে আম্মা-আব্বার কথাবার্তা শুনতে পেলাম কিছু।

‘অগোর না বিয়া হইছিল আমগর বিয়ার পরপরই? তাইলে পোলাপান অত ছোড ক্যান?’ আম্মার কথায় মনে হচ্ছিল, বিয়ের পরপরই সন্তান জন্ম দেওয়াটা যেন বিধেয়।

‘রুখসানার মনে হয় বাচ্চা নষ্ট হইছিল কয়েকটা।’ আব্বা আয়েশ করে খাটে বসে পেপার চোখের সামনে ধরে বললেন।

আমি বারান্দায় ভাঙা আলনা আর অনেক জঞ্জালের পেছন থেকে বসে জানালা দিয়ে চোখ রাখছিলাম একটু একটু, লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার সময় ধরা পড়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। বড় ভাই আমাকে এই জায়গাটা চিনিয়ে দিয়েছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় যখন তাঁকেও লুকিয়ে বই পড়তে হতো, আবার একই সঙ্গে আব্বা-আম্মা কী করছেন, তা-ও খেয়াল রাখতে হতো, তখন তিনি নিরাপদ জায়গা হিসেবে এটা আবিষ্কার করেছিলেন।

‘ফারুক কী করে এখন? আগের লাহান বদ অভ্যাস আছে নাকি?’ আম্মা একটা পান চিবাতে চিবাতে হালকাভাবে বললেন। ‘বদ অভ্যাস’ বলতে কী বোঝাচ্ছিলেন তা না বুঝলেও অনুমান করে নিয়েছিলাম যে ফারুক নামের ব্যক্তিটি হয়তো ফওজিয়ার আব্বা।

‘কী আর করে? ব্যবসাপাতির শেয়ার তো সব বেইচা খাইছে। ভাইয়েগোর ওপরেই চলে।’ ফারুক নামের লোকটি সম্পর্কে আব্বা-আম্মা দুজনেরই কিছু মায়া অবশিষ্ট আছে বলে মনে হলো।

ফওজিয়া স্কুলে সুন্দরী মেয়ে হিসেবে সুপরিচিত ছিল। বিশেষ অতিথি কেউ স্কুলে এলে ম্যাডামরা ফুলের তোড়া দেওয়ার জন্য যাদের ডাকতেন, ফওজিয়া সেই মেয়েদের মধ্যে একজন। তার জামাকাপড়ের পছন্দও খুব ভালো। সেগুলো নাকি তার বড় বোনেরা—মানে চাচাতো বোনেরা ডিজাইন করে দেয়। আমাদের মধ্যে নীলা ছিল একটু হিংসুক ধরনের। সে বলত, আসলে সেগুলো ওর বড় বোনদেরই, স্কুলের ইউনিফর্ম ছাড়া আমরা স্কুলে যেতাম শুধু ঈদের পর স্কুল খোলার দিন আর ফিস্টের দিন। ঈদে তো কেউ নিশ্চয়ই অন্যের জামাকাপড় পরবে না। আমি নীলার কথা বিশ্বাস করিনি তখন। ফওজিয়া সবার সঙ্গে মেশে না বলে অনেকেই তাকে দেমাগি মনে করে ওর নামে আজেবাজে কথা বলে। আব্বার কথায় মনে হলো, ফওজিয়ার জামাকাপড়ের চটক দেখে তো বোঝার উপায় ছিল না যে তার বাবার নিজস্ব ব্যবসা আর নেই এখন। কিন্তু এমনিতেও তো কেউ বড় বোনদের কাপড় শখ করে পরতেই পারে, আমি নিজেও পরি তো মাঝেমধ্যে।

আমরা কলেজে ওঠার পর নীলার সঙ্গে ফওজিয়ার একবার সরাসরি লাগল। তখন আমাদের শহরের বিখ্যাত এক পরিবারের কেউ একজন ১৪ আগস্টে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছে নিজের বাড়ির আঙিনায়, স্থানীয় ছেলেরা তাতে প্রতিবাদ করায় সেই লোক বন্দুক বের করে গুলি করার ভয় দেখায়। গুলি ছুড়েছিল কি না তা ঠিক মনে নেই, তবে কেউ মারা গেছে বা হতাহত হয়েছে বলে শুনিনি। এ নিয়ে শহরের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। এমন সময়ে কী একটা ক্রিকেট ম্যাচ চলছে, পাকিস্তান দল তাতে খেলবে না দেখে অধিকাংশেরই সেই ম্যাচে (সম্ভবত এলজি কাপ) আগ্রহ নেই। আমাদের বান্ধবী পিয়া ক্যানটিনে বসে তার প্রিয় খেলোয়াড় রাহুল দ্রাবিড়ের পক্ষ নিয়ে গলা ফাটাচ্ছিল। রাহুল দ্রাবিড় যে শুধু মডেলিংই করেন না, ব্যাটিংটাও ভালো করেন, সেটা প্রমাণ করার জন্য চেচাচ্ছিল। পিয়া আর ফওজিয়া খুব ভালো বন্ধু। পিয়া যখন দল ভারী করার জন্য ফওজিয়াকে সাক্ষী মানতে শুরু করল, তখন নীলা ফস করে বলে বসল, ‘ও আর ইন্ডিয়ার খেলা লইয়া কী কইব? এলজি কাপ দেখছে ও? ওর আত্মীয়রা তো পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায়।’

সেই খান্দানি খান পরিবারের সঙ্গে ফওজিয়ার কোনো সম্পর্ক কোনোকালে ছিল না। নীলা এই কথা বলেছিল নেহাত হিংসা থেকেই। সূত্রটা হলো ফওজিয়ার মামা রহমত চাচা, বরকত চাচা আর শওকত চাচারা আসলে বিহারি, যাঁদের অনেক সময় বলা হয় স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানি, ওনারা তা-ই। ভারতের বিহার প্রদেশে তাঁদের আদি বাড়ি কি না, তা-ও আমি জানি না তখন। শুধু এটা জানতে পেরেছিলাম, ফওজিয়ার নানি জেঠুর কুলখানিতে এসেছিলেন জেঠুকে দোয়া করতে। জেঠু না থাকলে নাকি এলাকার লোকেরা তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দিতেন দেশ স্বাধীনের পরদিনই।

আমাদের এলাকা খুব পুরোনো আর ঘনবসতি বলে প্রায় রোজই কোনো না কোনো বয়স্ক মানুষ মারা যান। ‘একটি শোক সংবাদ’ বলার পর কান খাড়া করলে বোঝা যায় কার বাবা বা মা, ছেলে বা নাতি কিংবা কার স্ত্রী মারা গেল, নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণত ছেলে বা স্বামীর নামেই পরিচয় দেওয়া হয়। রহমত চাচার মা, মানে ফওজিয়ার নানির ইন্তেকালের মাইকিং আমি শুনেছিলাম। সকালে উঠে বিস্মিত হয়ে দেখলাম, দাদি লাঠিতে ভর দিয়ে লাশ দেখতে যেতে চাইছেন। আমি একটু অবাকই হলাম। দাদি একাধিক মুক্তিযোদ্ধার মা, জেঠুর কুলখানিতে তাঁরা এসেছিলেন বলেও কেউ কেউ নাখোশ হয়েছিলেন। ফওজিয়ার আম্মা যদিও একেবারে আমাদের মতো করেই কথা বলতেন, বৃদ্ধা নিজের টানটা পাল্টাননি কখনো। অবাঙালি বলে বোঝাই যেত। আমি শৈশবে অনভিজ্ঞতার দরুন বুঝিনি।

‘বেডির মনে দুক্কু আছিন, মাইয়াডা বাংগালি বিয়া করছে দেইখ্যা।’ জেঠিমা খাঁটি সহানুভূতি নিয়ে বললেন। শাশুড়িকে ধরে ধরে নেবার সময় বোঝা গেল উনি নিজেও তত সবল নন।

কিছুদিন পর রহমত চাচাদের বাড়িটা মেরামত করে রং করা হলো। শুনতে পেলাম বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। রহমত, বরকত আর শওকত নামের সেই ব্যক্তিরা কে কোথায়—বেঁচে আছেন না মরে গেছেন—সেই খবর আমি জানতাম না। কারণ তত দিনে আমি থাকি রাজশাহীতে। এই তিন চাচা দেখতে সাধারণ বাংলাদেশি মানুষের মতোই, তাঁদের ছেলেরাও গড়পড়তা বাঙালি যুবকদের মতো—স্বাস্থ্যবান, হাসিখুশি। কথা কখনো বলা হয়নি। তাই জানি না তাঁদের ভাষায় কোনো লক্ষ করার মতো পার্থক্য আছে কি না। একটা ছেলেকে দেখতাম কখনো ভাইয়ার সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে, তার নাম আরমান নাকি ওয়াকিল, তা-ও ঠিক জানতাম না, সেটাও বহু বছর আগের কথা। তখনো আলাদা করে তাদের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কোনো কারণ ঘটেনি।

কিন্তু নীলার ওই মন্তব্যের পর ফওজিয়া আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর হয়তো মনে হয়েছে যে তার মাতুল বংশের বিহারি হওয়ার খবর ক্লাসে ফাঁস করেছি আমিই। আদতে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। নীলা রিউমার মংগার ধরনের মেয়ে। পরিচিত-অর্ধপরিচিত সবার হাঁড়ির খবর তার জানা। কলেজে থাকার সময়ই একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল ফওজিয়ার। ছেলে আর্মি কিংবা নেভিতে জয়েন করেছে তখন। বিয়ের অনুমতি পাওয়ামাত্রই বিয়ে হয়ে যাবে—এমনই জানতাম।

মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর অনেক দিন বাদে বাদে বাসায় গেলে সহপাঠীদের কারও কারও খবর জানতে পারতাম আমি। এভাবেই নীলারই আরেক বন্ধু শিউলির কাছে জানতে পারলাম, ফওজিয়ার সেই প্রেমটা টেকেনি। ছেলের বাপ-মা নাকি বিহারি পরিবারের কোনো মেয়েকে বিয়ে করাবে না বলে দিয়েছিল। ফওজিয়াকে তার চাচাতো বোনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সিডনিতে। সেখানেই এক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার।

আমি তখন এত খবরাখবরে তেমন আগ্রহী ছিলাম না। নিজের জীবনেই সেই সময় বহু ঝামেলা আমার—সেকেন্ড প্রফ পরীক্ষা ছাড়া জগতের আর কোনো কিছু নিয়েই আমার মাথাব্যথা নেই ওই সময়ে। শিউলির সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে সে নিজে থেকেই কে কোথায় কী করছে—সব খবর হড়বড় করে বলতে শুরু করেছিল। স্কুলে আমাদের ব্যাচের পুনর্মিলনী আয়োজন করছে সে আর নীলা, আমি যেন অবশ্যই থাকি সে কথা বলে ফোন নম্বরও নিয়েছিল শিউলি। ফেরার সময় ফওজিয়ার নানির বাড়িতে নতুন রং দেখে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম। আম্মা বললেন, ওনারা কেউ নাকি এখন আর এই শহরেই থাকেন না। বাড়িতে এখন যাঁরা থাকেন, তাঁরাও মালিক নন, ভাড়া থাকেন—বিক্রমপুর কিংবা নারায়ণগঞ্জে তাঁদের বাড়ি। আসলে কে বা কারা কিনেছে ওই বাড়ি, সেটা এক রহস্য। আব্বার বরাত দিয়ে আম্মা জানালেন যে রুখসানা যদি ফারুককে বিয়ে না করতেন, তাহলে তাঁরা বহু আগেই বাড়ি বিক্রি করে চলে যেতেন। ‘পাকিস্তান আমলে তো হেগর ডাঁটই আলাদা আছিল, বুঝস না?’ আম্মার নিজেরও অত কিছু মনে থাকার কথা নয়। তখন নিতান্ত স্কুলবালিকা তিনি, এ বাড়ির বউ হয়েও আসেননি। তবে আম্মা ‘হেগর’ শব্দটা দিয়ে যে শুধু রহমত, বরকত, শওকতদের বোঝাননি, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম।

আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ফওজিয়ার বিয়ে নিয়ে। তিনি বললেন, তেমন কিছু জানেন না। ফারুক মানে ফওজিয়ার আব্বা হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিলেন মেয়ের বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর। তারপর থেকে ফওজিয়াও আর চাচাদের বাড়িতে থাকে না। শুধু মামারা উর্দুভাষী রিফিউজি হওয়ার দোষে কোনো মেয়ের প্রেম বা বিয়ে ভেঙে যেতে পারে—এটা ভেবে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম আমি। ফওজিয়ার আম্মার কথা জিজ্ঞেস করার কথা আর মনে পড়ল না।

রহমত চাচাদের মতো লোকদের বাড়ি বেচে, ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে হলো ‘কেউ জানে না কোথাও’; আর পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো পরিবারটি তো দিব্যি আছে, দশ তলা দালান তুলছে, টিকে থাকার জন্য তাদের কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয় পর্যন্ত দরকার হয়নি। জগৎ বুঝি এমনই।

বিষণ্নতা আর টেনশন কমানোর জন্যই স্কুলের পুনর্মিলনীতে গেলাম। নীলা বেশ গিন্নিবান্নি হয়েছে, চাকরি-বাকরি কিছু করে না, করবেও না। এখনো আছে আগের মতো। সবার সব খবর তার নখদর্পণে। অনুষ্ঠানের বড় সময়জুড়ে সে ফওজিয়ার সেই আর্মি না নেভির অফিসারের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া, এক সপ্তাহ পরে ফিরে এসে বাড়িতে লাঠিপেটা হওয়া এবং পরে সিডনি চলে যাওয়ার আগের সব কেচ্ছাকাহিনি বলে বেড়াল। একপর্যায়ে পিয়া শুধু একা আমাকে বলল, ‘মাইয়াডা মইরাও শান্তি পাইল না।’ চমকে উঠলাম আমি। ফওজিয়ার আত্মহত্যার খবর ইচ্ছা করেই পিয়া সবাইকে বলেনি। ওকে সবাই হিংসা করত, নীলার মতো স্পষ্ট না হলেও নীলার বলা গল্প উপভোগের মাধ্যমে বোঝা গেছে যে ওদেরও মনোভাব নীলার মতোই। স্বামীর মানসিক নির্যাতন, পালিয়ে যাওয়ার খোঁটা, এবরশনের মিথ্যা অপবাদ আর নিতে পারছিল না সে।

বছরখানেক পর ইন্টার্নি শেষ করে শহরে ফিরলাম আমি। একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ নিয়ে এফসিপিএসে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আমার মফস্বলি প্র্যাকটিস দেখতেই হয়তো ঢাকা থেকে এসেছিল আমাদের শহরে। তারা চলে যাওয়ার সময় ওদের ট্রেনে তুলে দিয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজছিলাম। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় দুই হাতভর্তি অনেকগুলো ধাতব চুড়ি পরা এক ভিখিরিনি এক ইলেকট্রিকের দোকানের সামনে এক দলা থুতু ফেলে বলল, ‘শুয়ার কা আওলাদ।’ সম্ভবত ভিক্ষা না পেয়ে কাউকে গালি দিচ্ছিল সে। থুতু আমার পায়ের কাছে পড়েছিল। আরেকটু হলেই স্যান্ডেলে লাগত। আমি বেশ বিরক্ত হয়ে তাকাতেই দেখলাম, ভিখিরিনির চেহারা চেনা লাগছে।

খুব নোংরা কাপড়, কাঁধে ঝোলানো চটের ঝুলি আর সস্তা মেটালের কানের মাকড়ির পরেও চিনতে পারলাম। ইনি রুখসানা, ফওজিয়ার আম্মা। আমি অভ্যাসবশেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘কী হইছে?’

ফওজিয়ার আম্মা রাগ, ক্ষোভ আর কান্না মাখানো গলায় অবিকল তাঁর মায়ের ভাষায় বললেন, ‘সুবহা থাইকা কুছু খায় নাই, শাম হয়ে গেল।’

ফওজিয়ার আব্বার হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর পর তার চাচারা তাকে সিডনি পাঠিয়ে দিয়ে তার মাকে বাপের বাড়ি ফেরত যেতে বলেছিল। ফওজিয়ার আম্মা, মানে রুখসানার তখন বাপের বাড়ি বলে কিছু আর নেই।