ছিটমহলেযেতে খুব কষ্ট হয়েছিল

>

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে ঘুরে ঘুরে তারপর লেখা হলো ভূমি ও কুসুম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাসেল রায়হান

রাসেল রায়হান: ঠিক কখন মনে হলো, ছিটমহলবাসীকে নিয়ে আলাদা উপন্যাস লেখা যায় বা লিখবেন?

সেলিনা হোসেন: যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনই শুনেছি ছিটমহলের কথা। তবে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা সে সময় ছিল না। আমার মাথায় সে সময় একটাই বিষয় ছিল—রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র, কী অদ্ভুত ব্যাপার! নিজের রাষ্ট্র থেকে আবার নিজের রাষ্ট্রে আসতেই নাগরিকদের পাসপোর্ট-ভিসা লাগছে। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ভেতর বিপন্ন এই মানুষগুলো বেদনাহত করতে থাকে আমাকে। শুরু থেকেই বিষয়টি আমার মাথায় গেঁথে ছিল। ২০০৩ সালে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা দেখতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। পরে একটি সাহিত্য পত্রিকার আমন্ত্রণে ভূমি ও কুসুম নামে ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি লিখতে শুরু করি।

রাসেল: লিখতে কত দিন লেগেছে?

সেলিনা: সাড়ে তিন বছর। ধারাবাহিক ছিল তো। সময় নিয়ে নিয়ে লেখার সুযোগ ছিল। ফলে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দেখে নিতে পেরেছি। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি, সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি-সম্পর্কের সূত্রগুলো দেখার চেষ্টা করেছি। সেই বিশ বছর আগেই তো ভেবেছিলাম, ছিটমহলবাসীর বন্দিজীবন নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব। তারপর ওখানে গেলাম।

রাসেল: বিশ বছর মাথায় নিয়ে ঘুরেছেন যে এটা লিখবেন! এত দেরি হলো কেন শুরু করতে?

সেলিনা: লেখার জন্য নিজেকে ঠিক তৈরি করতে পারছিলাম না। ওখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানান কড়াকড়ি ও জটিলতা ছিল। পরে ২০০৩-এর ২৬ জুলাই দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা যাওয়ার সুযোগ হলো। যাত্রাটা বড্ড কঠিন ছিল। কেমন যেন গোলকধাঁধা পার হয়ে ঢুকতে হয়।

রাসেল: কোন কোন ছিটমহলে গিয়েছিলেন আপনি?

সেলিনা: ওই যে বললাম, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় গিয়েছি। পঞ্চগড়ের দু-একটি ছিটেও গিয়েছিলাম পরে। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ছিট যেমন দেখেছি, উল্টোটাও দেখেছি।

রাসেল: যাতায়াতে গোলকধাঁধার কথা বললেন...সেটা কী রকম?

সেলিনা: নানান জটিলতা ছিল যাতায়াতে। যেতেই কষ্ট হয়েছিল খুব। সে যে কী কষ্ট... গাড়িঘোড়া তো নেই। অবশ্য আমি কিছু সহযোগিতা পেয়েছিলাম। লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা সদর থেকে দশ মাইলের মতো দূরে দহগ্রাম ছিটমহল। ভারতের তিনবিঘা করিডর পার হয়ে পরে ঢুকতে হয় এখানে। ওই রাস্তাটুকু পাকাই ছিল। পাটগ্রাম সীমান্তে বিজিবি (তখন নাম ছিল বিডিআর) ক্যাম্প আছে। আবার তিনবিঘা সীমান্তে বিএসএফ ক্যাম্প। পুরো বিষয়টিই কেমন যেন গোলকধাঁধা!

রাসেল: গোলকধাঁধা পার হওয়ার পরের অভিজ্ঞতা কেমন? কেমন দেখলেন ছিটমহল?

সেলিনা: আমার সামনে ছিল আকাশ, তিস্তা, থই থই জল। ছিল রাইফেল, সীমান্তরক্ষীদের নির্বিকার মুখ, বুট, সীমান্তের লোহার গেট, দুদেশের পতাকা ও দিগন্ত। সেদিন শুধু মানুষের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। ওদের বঞ্চনার কথা শুনেছি। ভারতীয় ছিটেও একই চিত্র। ওদের কাজকর্ম, লেখাপড়া বাংলাদেশে হচ্ছে, কিন্তু নাগরিক অধিকার নেই। চাকরি পায় না। নিজের জমিও বিক্রি করতে পারে না পর্যন্ত। ফেরার সময় মনে হচ্ছিল ওদের বুকের উষ্ণতা, সাহস, বেঁচে থাকার তৃষ্ণা, রাষ্ট্রের প্রতি অনুভব—সবÑস্পর্শ নিয়ে আসছি আমি।

রাসেল: ভূমি ও কুসুম-এর চরিত্রগুলো যে রাষ্ট্রকে দেখছে, এটি কতটুকু ওই চরিত্রের চোখে দেখা, আর কতটুকু আপনার নিজের চোখে দেখা?

সেলিনা: আমি মনে করি, সবটুকুই চরিত্রের চোখে দেখা। আমি ওখানে ওদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। সাংবাদিকদেরও অসংখ্য লেখা আমার সংগ্রহে ছিল। সেখান থেকেও মানুষ খুঁজেছি আমি: কীভাবে তারা দেখছে, কথা বলছে, দৃশ্য বর্ণনা করছে...নিজের অভিজ্ঞতা তো আছেই। এটা সম্পূর্ণ সত্যের জায়গা থেকেই দেখা। আমি কখনোই কিছু বানিয়ে লেখার চেষ্টা করিনি।

রাসেল: এ উপন্যাসে নারী স্বাধীনতার কথা আছে। যেমন, গোলাম আলির মা বিদ্রূপের সুরে স্কুলমাস্টারকে বলছে, ‘স্কুলের খাতায় যদি মায়ের নাম ওঠান, তাহলেই তো শাসন করতে পারি। নইলে শাসন করব কেন?’ কথা হলো, উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১। ছিটমহলের নারীরা কি তখন এতটা অগ্রসর ছিলেন চিন্তাভাবনায়?

সেলিনা: এটা সত্যি যে অতখানি ছিলেন না। আবার ছিলেনও। এখানে আমি তাঁদের কিছুটা তৈরি করেছি। হয়তো আমি তাঁদের ভেতর থেকে চল্লিশ ভাগ পেয়েছি, ষাট ভাগ আমার চিন্তা থেকে যুক্ত করেছি। কাহিনি নির্মাণের সময় এটা হওয়া যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। বেঁচে থাকার জন্য অনেক আপস তাঁদের করতে হয়েছে। উপন্যাসে এই আপসের বেড়িটা আমি ভেঙে দিয়েছি।

রাসেল: উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রমিত বাংলায় কথা বলে। ছিটমহলবাসীরা কি এভাবেই কথা বলে?

সেলিনা: না না। আসলে অত অল্প সময়ে ওদের মুখের ভাষা ধরার উপায় আমার ছিল না। যাতে ভুল কিছু না বলি, তাই এটাই আমার কাছে নিরাপদ মনে হয়েছে। আরেকটা কারণ ছিল, আমি চেয়েছি, তাদের সংলাপগুলো যেন সহজবোধ্য হয়। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন যে এটা তাদের মুখের ভাষা নয়।

রাসেল: ভূমি ও কুসুম-এ আপনি কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এখন তো ছিটমহল সমস্যা আর নেই। প্রশ্ন হলো আসলেই কি ছিটমহলের সব সমস্যা দূর হয়েছে? পরে আর গিয়েছেন কখনো?

 সেলিনা: না। আর যাওয়া হয়নি পরে। আমার ঠিক সুযোগ তৈরি হয়নি যাওয়ার, আগ্রহও তৈরি হয়নি। সমাজপ্রেক্ষিতের ভাবনা থেকে, আমার রাষ্ট্রচিন্তা থেকে, লেখার প্রয়োজনে আমার যতটুকু অনুধাবন করার প্রয়োজন ছিল, সেটুকুই আমি করেছি। ওখানে একটা স্কুল হয়েছে কি না, বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে কি না কিংবা নারীরা কতটুকু অগ্রসর হলো, এসব আর দেখা হয়নি। এসব অবশ্য সময়ের ধারাবাহিকতায় আপন নিয়মেই গড়াবে।