মাকে দেখে লিখেছিলাম 'আগুনপাখি'

>

মা, পরিবার, পরিচিত গণ্ডি—নিজের জীবনের খুব ঘনিষ্ঠ ছবি আছে হাসান আজিজুল হকেরআগুনপাখিতে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহিত হাসান

মুহিত হাসান: বেশ কটা গল্পগ্রন্থ বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই নানা সাক্ষাৎকারে আপনাকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়েছে তা হলো, এখন উপন্যাস লিখছেন না কেন। একটু হালকা প্রশ্ন হলেও এটা জিজ্ঞেস করতে চাই, এমন নাছোড় তাগাদা কি কোনোভাবে আগুনপাখি লিখে ফেলার ক্ষেত্রে প্ররোচনা জুগিয়েছিল?

হাসান আজিজুল হক: একদমই নয়। লোকে কী বলছে, তা শুনে লিখব, এমন মানুষ আমি নই। লেখকজীবনের শুরু থেকে আমি আসলে শুধু উপন্যাসই লিখতে চেয়েছি। পরে কী করে যেন গল্প লেখায় মেতে উঠলাম। প্রথমে উপন্যাস লিখব ভেবে বসেছিলাম, পরে দেখেছি একটা বড় গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে—এমনটাও কম ঘটেনি। উপন্যাস হয়ে ওঠার জন্য দরকারি যে বিস্তার, তা শেষমেশ আর আনতে পারিনি দেখে লেখাগুলো ওরকম হয়ে গিয়েছিল। আগুনপাখি লেখার আগে তরলাবালা নামের একটি উপন্যাস শুরু করেছিলাম, সেটিও একই কারণে পরে থেমে গেল, বিস্তার ঘটাতে পারছিলাম না। এরপর হঠাৎই মনে হলো, বর্ধমানে আমার যে ফেলে আসা বসতবাড়ি, শৈশব-তারুণ্যের স্মৃতি, পারিবারিক-সাংসারিক চালচিত্র, রাঢ়ের গ্রাম্য মুসলমান গৃহস্থ পরিবারের উত্থান-পতন, মা-বাবার কথা, দেশভাগের নির্মমতা, সাধারণ মানুষের ওপর এর অভিঘাত—এই সবকিছু প্রেক্ষাপটে রেখে একটি উপন্যাস আমার লেখা উচিত। এভাবেই আগুনপাখি লেখার শুরু। তবে এর আগে একটা গল্প লিখেছিলাম, ‘একটি নির্জলা কথা’ নামে। ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোতে, সেখানে এর কাহিনির বীজ সুপ্ত ছিল। তবে পুরোটা নয়।

মুহিত: যেমনটি বললেন, আগে উপন্যাস লেখার জন্য যেসব কাহিনিকে বেছে নিয়েছিলেন, সেসবকে বড় গল্পে রূপান্তরিত করতে বাধ্য হলেও আগুনপাখির বেলায় আপনি সফল হলেন। এর নেপথ্যে কি কাহিনির সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নৈকট্য সহায়তা করেছিল?

হাসান: দেখো, যদি বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোনো নিবিড় সংযোগ না থাকে, তাহলে উপন্যাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎপ্রবাহ বইয়ে দেওয়া অসম্ভব। এই কারণে আগুনপাখি লিখতে বসার পর, যখন দু-এক অধ্যায় লিখে ফেলেছি, নিজে সেই অংশটুকু পড়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম যে, নাহ, ভালোই তো এগোচ্ছে। প্রথমত এর প্রেক্ষাপট আমার দেখা ও চেনা; দ্বিতীয়ত, এর পরিপার্শ্বকে আমি যতটা নিখুঁতভাবে পারা যায় ধরতে পারছি, কিন্তু তা স্মৃতিকাতরতাতেও জর্জরিত হচ্ছে না। তা-ও সংশয় কাটানোর জন্য পরিচিত কয়েকজনকে পড়তে দিয়েছিলাম একটা অধ্যায়। বেশির ভাগই বললেন, কেমন যেন লাগছে, বড় বেশি জটিল।Ñ শুধু আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু সনৎকুমার সাহা খুব উৎসাহ জোগালেন। মজার কাণ্ড এই, তখন যাঁরা আগুনপাখি বিষয়ে কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, বই আকারে প্রকাশের পর তাঁদের অনেকেই আবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। পৃথিবীর বহু মহৎ উপন্যাস কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক গল্প। আগুনপাখি যদি মহাকালের বিচারে টেকে, তাহলে এ জন্যই টিকবে বলে আমার ধারণা। কারণ, একমাত্র নিজের পরিবারকেই আমি হাতের শিরা-উপশিরার মতো চিনতে পেরেছি।

মুহিত: রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায় লিখলেন গোটা উপন্যাস...

হাসান: এটা খুব ভেবেচিন্তে করেছিলাম, এমনটা নয়। আকস্মিকভাবেই চলে এসেছে। আর এটাকে রাঢ়বঙ্গের ভাষা বলতেও আমার আপত্তি আছে। এটা আদতে আমার মায়ের মুখনিঃসৃত ভাষা। উপন্যাসের কথক-চরিত্র তথা মূল প্রটাগনিস্ট (নায়ক) যে আদতে তিনিই, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। তিনি যেভাবে কথা বলতেন, সেই বাকভঙ্গিতে আমি লিখেছি। তাঁর দেহভাষা, তাঁর ব্যবহৃত বুলি—এইসব ধরার একটা প্রচেষ্টা ছিল। উনি যেভাবে কথা বলতেন, আমার ফুফুরা বা চাচিরা তো সেভাবে বলতেন না। এমনকি গ্রামভেদে কথা বলার ঢংও একেক রকম।

মুহিত: আগুনপাখি মায়ের প্রতি আপনার একটি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্যও, এমনটি যদি বলি?

হাসান: মায়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা তো নিছক শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নয়, এটা হলো অস্তিত্বের সম্পর্ক। মা ছাড়া আমি তো নেই। কিন্তু রাঢ়বঙ্গের একান্নবর্তী পরিবারগুলোতে ছেলেমেয়েদের কাছে মা ছিলেন নেহাতই একজন ‘মিসিং পারসন’। ছেলেমেয়েরা বাইরে সারা দিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাড়িতে এলে খেতে দিচ্ছেন সংসারের প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত নারী বা বিধবারা আর অবস্থাপন্ন পরিবারের বেলায় বাড়ির চাকরেরা। সারা দিনে মায়ের মুখদর্শনও হয়তো সন্তানদের হচ্ছে না। এইরকম প্রেক্ষাপটে, দেশ-কালের বাঁধনগুলো ঝোড়ো হাওয়ার মুখে যখন ভেঙে পড়ছে, তখন একজন নিঃসঙ্গ নারীর—যিনি বিরাট এক সংসারের মধ্যে থেকেও একা—তাঁর মনে কী ঘটে যাচ্ছে, তা আমরা কেউ জানতে চাইনি। আগুনপাখির মাধ্যমে আমি দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে আমার মা ও তাঁর মতো হাজারো নারীর অস্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। তাঁদের যে নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য,Ñতাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। উত্তম পুরুষে উপন্যাসের বয়ান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ কারণেই। কিন্তু বইটি নিয়ে লেখার সময় খুব বেশি সমালোচক এই বিষয়টি নজরে আনতে পারেননি। একমাত্র ইমতিয়ার শামীমই তাঁর আলোচনায় বিষয়টি ধরতে পেরেছিল এবং মূলত উপন্যাসটির এই দিকটি নিয়েই সে লিখেছে।

মুহিত: দেশভাগ নিয়ে যে খেদ উপন্যাসের মূল নায়কের মুখে শুনতে পাই, তা তো তাহলে আপনার মায়েরই মনের কথা?

হাসান: আদতে তা-ই। আমার মা দেশভাগের অর্থহীনতা, এর ফলে সৃষ্ট অপচয় নিয়ে তাঁর খেদ যে রকম যৌক্তিকভাবে প্রকাশ করেছিলেন, তা আমাদের বাড়ির অন্য লোকে দূরে থাক, আমাদের বেশির ভাগ ঐতিহাসিকও আজ অব্দি বুঝেছেন কি না, জানি না। তাঁদের কথাবার্তা এমন যে দেশভাগ খুব একটা অস্বাভাবিক, ভয়াবহ কিংবা বিশ্রী বিষয় নয়,Ñশুধু রক্তপাতটুকু এড়ালেই হতো! বুর্জোয়া ঘরানার রাজনীতিকদের কথা বাদই দিলাম, আমার সমভাবাপন্ন সাম্যবাদী রাজনীতি করা বন্ধুরাও দেশভাগের এই নির্মম অর্থহীনতা, সীমাহীন মানবিক অপচয় নিয়ে খুব বেশি ভাবেননি। তাই আরেক দিক থেকে, আগুনপাখি দেশভাগের অর্থহীনতার বিরুদ্ধে আমার একটা প্রতিবাদও বটে।

মুহিত: উপন্যাসটির অর্ধেকাংশ ২০০৫ সালে প্রথম আলো ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘অপ-রূপকথা’ নামে। বই আকারে প্রকাশের সময় নাম পাল্টে দিলেন কেন?

হাসান: প্রথম নামটা একদমই ভেবেচিন্তে দেওয়া নয়! আসলে ঘটনা কী, প্রথম আলোয় প্রকাশের জন্য যে অংশটুকু দেব বলে ঠিক করেছিলাম, তা আর শেষই হচ্ছিল না। পত্রিকা সংশ্লিষ্টরা চিন্তিত, সময়মতো পুরো লেখা হাতে না এলে তো সংখ্যাটা বের করা যাবে না। আমিও বিড়ম্বিত বোধ করছিলাম। এমন সময় একদিন প্রথম আলো অফিসে গিয়েছিলাম। জাফর আহমদ রাশেদ এসে বলল, ‘আপনি উপন্যাসটা শেষ করে দিন এখনই। নইলে আর পারা যাচ্ছে না।’ ওকে বললাম, তাহলে আমাকে একটা ঘরে তালাচাবি দিয়ে আটকে রেখে যাও। তারপর দেখি কিছু আসে কি না মাথায়। এইভাবেই লেখাটা শেষ করে ওর হাতে দিলাম। তখন ওই ‘অপ-রূপকথা’ নামটা দেওয়া। পরে আগুনপাখি নামটাই বেছে নিলাম। কারণ, এখানে ধ্বংসের মধ্যে থেকে পুনর্জাগরণের একটা আভাস পাওয়া যায়। আর ‘অপ-রূপকথা’ নামের মধ্যে হতাশার ছায়া আছে। আর আমার এই উপন্যাসের কাহিনি তো মোটেও রূপকথা নয়,Ñবরং নির্জলা বাস্তব।