পাখির উড়ে যাওয়া

বেলাল চৌধুরীর প্রতিকৃতি মাসুক হেলাল
বেলাল চৌধুরীর প্রতিকৃতি মাসুক হেলাল

২৪ এপ্রিল ২০১৮। তিনি এক নতুন ভ্রমণে নামলেন। সেই ভ্রমণের দিশা এ প্রান্তের কারও জানা নেই। তবু সবাই তাকিয়ে আছে দূরবর্তী কোনো বিন্দুর দিকে, যা শুধু কুহকই সৃষ্টি করে। গমনের মুহূর্তে হয়তো বা উচ্চারিত হয়, চললাম। অনন্তের সেই পথে যাত্রা শুরু করলেন কবি বেলাল চৌধুরী। অদৃশ্য, অনির্দিষ্ট, অলৌকিক সে ভ্রমণের শুরুতে যে নিশ্বাসের পতন, তা কি পঞ্চভূতে অন্য কোনো অন্বেষণ?

শুরু যেখান থেকেই হোক, আমি তো সেই স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের দৃশ্যমান এক পথিক। আবদুল্লাহ ফারুক, মুক্তিযোদ্ধা, রেডিওতে আছেন—এলেন ঢাকা স্টেডিয়ামের প্রভিন্সিয়াল রেস্টুরেন্টে। সঙ্গে অতিশয় সুদর্শন এক পুরুষ। পরিচয় করিয়ে দিলেন—বেলাল চৌধুরী। বিরিয়ানির ঘ্রাণ এবং উষ্ণ হাওয়া মিলেমিশে যেন ঢাকা-কলকাতা হয়ে গেল। জলে ও ডাঙায় তখন বেলাল চৌধুরীর হরেক গল্প ছি-পলানটি খেলছে! কুমিরের চাষ করবেন বলে খুলনায় খামার করেছিলেন। তারপর একদিন জাহাজে চেপে উধাও। সে জাহাজ নোঙর করল কলকাতায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে সেই যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখকে ছেঁকে-ছেনে কৃত্তিবাস কী কবিতা পত্রিকার শিকল-কড়া নেড়ে কবরস্থান ও শ্মশানে ঠাঁই করা—তারই তো জের—‘ও-বাড়িটায় কেউ থাকে না শুধু হাওয়ার কুহক’।

বেলাল ভাই। কলকাতার মায়া কাটিয়ে ঢাকা ফিরলেন। একদিন যেমন হুট করে চলে গিয়েছিলেন, তেমনি এলেন মায়ের ডাকে। মাটির টানে। জড়িয়ে গেলেন নানান উদ্যোগে। হাত লাগালেন বিবিধ কর্মকাণ্ডে। এ পাশ-ও পাশ করে থিতু হলেন সচিত্র সন্ধানীতে। নয়াপল্টনের গাজী ভবনের নিচতলায় দপ্তর। সাপ্তাহিক পত্রিকা। মধ্যদুপুর থেকে গাঢ় সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ততা। আড্ডা, লেখালেখি, গল্প, মুখশুদ্ধ করা কেচ্ছা-গিবত—সব যেন জড়াজড়ি করে আছে। পত্রিকার মালিক-কর্ণধার গাজী শাহাবুদ্দীন আহমদ থেকে কাইয়ুম চৌধুরী পর্যন্ত ফুরসত পেলেই ঢুঁ মারেন।

এর মধ্যেই একদিন শুরু হয়ে গেলপদাবলীর আয়োজন। দর্শনীর বিনিময়ে কবিতাপাঠ। ১৯৮০ সালের কথা। শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতীকুল্লাহকে সামনে রেখে কাঠি নাড়ছেন বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ। রবিউল হুসাইন, হায়াৎ সাইফ, অরুণাভ সরকার, মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ আরও অনেকেই ঢোল হয়ে সে উৎসবে আওয়াজ দিলেন। সন্ধানীর অফিস টগবগ করছে, আর বেলাল চৌধুরী তপ্ত উনুনে ঘি ঢালছেন। মাহমুদুল হক, রশীদ হায়দার অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। নাসির আলী মামুন ব্রোসিয়রের জন্য কবিদের ছবি তুলছেন। নাম উল্লেখ না করেই বলছি, তরুণদেরও সাড়া ছিল আশাব্যঞ্জক। প্রকাশিত হলো পদাবলী কবিতা সংকলন, সম্পাদনা করলেন বেলাল চৌধুরী। তিনি যেমন প্রিয় ছিলেন তাঁর ‘স্যার’ শামসুর রাহমানের, তেমনি আপনজন ছিলেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর।—‘একটি রং তৈরির কারখানা গড়ছি আমি—’

বেলাল চৌধুরীর কবিতা। ১৯৭২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত।

‘নিবিড় বেদনা কিছু ঝরে গেল নীরবে প্রথম রক্তপাতে।’ প্রথম রক্তপাতের বেদনা কবিতার প্রথম উচ্চারণের মতোই। বেদনার আনন্দময়তা। আনন্দের মধ্যে এই যে নিহিত বেদনা, তাই যেন বেলাল চৌধুরীকে দাবড়ে বেড়ায়। ‘হলদে তামাটে বালির ওপর তাহাদের পায়ের ছাপ।’ তামাটে বালিতে পায়ের ছাপ নিয়েই এগিয়ে চলা। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় কবিতার বই সেলাই করা ছায়াস্বপ্নবন্দী ১৯৮৫ সালে, আর ১৯৮৬ সালে প্রতিনায়কের স্বগতোক্তি। পরপর তিন বছর তিনখানা কবিতার বই। কিন্তু মেজাজে ও উচ্চারণে পৃথক। সময় তাঁকে নানান উপলব্ধি দিয়েছে এবং কখনো নিজেকে সমর্পণও করেছেন সময়ের করতলে। তারই একটি প্রতিচিত্র মেলে কবিতাগুলোতে—

 ১. ‘একটি ডিমের ভেতর কি আছে?

       গান, রাসায়নিক স্বরলিপি

      অদৃশ্য জঠরে ঠাসা

      বিস্তারিত নীড় বাঁধার নির্দেশ

      সুষম খাদ্যতালিকা, নক্ষত্রের মানচিত্র—’

 ২. ‘কুমিরের রাত ছিল কাল, অনেক কুমির এসেছিল

      রাতভর শুধু, কুমিরেরা—আমি জানি নৈশাতাঙ্কের

      নিজস্ব বৈধতাতেই এসেছিল তারা, যে বৈধতা আছে

      দাসত্বে, যুদ্ধে, বর্ণবৈষম্যবাদে।’

 ৩. ‘বরফকুচির মতো, চৈত্রের পেঁজা তুলোর মতো

      রাশি রাশি ভুল উড়ছে আকাশে অজস্রÊভুলের

                                                পতাকা উড়িয়ে

      ...

      নির্ভুল শুধু একটাই, কবি ও কবিতা।’

সেলাই করা ছায়াগুলো যখন স্বপ্ন হয় এবং স্বপ্নগুলো যখন নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে স্বগতোক্তি করে, তা তো ভুল হতেই পারে। কিন্তু কবি এবং তাঁর কবিতাগুলো নির্ভুল। ‘প্রাণ কোকিলা’ ডাক দিলে ‘আমাদের এই পুরোনো পাঁচিলে বড় বেশি রোদ’ লাগে। বেলাল চৌধুরীর কবিতা মানে এক দমে রোদ ও রাত্রির পাহারা অতিক্রম করে জলাশয়ের সন্ধান করা। মানুষের কঠিনকে কোমল করা কিংবা কোমলকে তরল করার দৈনন্দিন আরক!

আমাদের ফেলে আসা যে দিনগুলো বাতাসে উড়ছিল, সেই সব দিনের বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। ফলে তার মধ্যে নানা রং, নানা গঞ্জ অবলীলায় ঢুকে পড়েছে। সর্বাবস্থায় বেলাল চৌধুরী ছোট-বড় সবাইকে কাছে টেনেছেন। আড্ডায়, আহ্লাদে মেতেছেন দিনের পর দিন। অবসাদ কী জিনিস, ক্লান্তি কাকে বলে, তা যেন তাঁর অভিধানে ছিল না। সেগুনবাগিচায় কেশব দত্তগুপ্ত, এলিফ্যান্ট রোডে মোয়াজ্জেম হোসেন যেমন ভেতর মহলকে আলগা করেছেন, আবার তেমনি খুলনায় কবিতালাপ-এর অনুষ্ঠানে অনু ইসলাম দিয়েছেন হাতপাখার প্রশান্তি। রাশিয়ান দূতাবাসের নিমন্ত্রণ শেষে বিদায়বেলায় মিলিটারি অ্যাটাসের মেডেলগুলো বেলাল ভাইয়ের আঙুলের স্পর্শে বেজে উঠে যেন মাঝেমধ্যে বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেবের সানাইকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। লন্ডনে ইকবাল হোসেন বুলবুলের বাড়ির বারান্দায় যে জ্যোৎস্না ফুটেছিল, তা মেখে নিয়েই তো বেলাল ভাই ‘সংহতি কবিতা উৎসব’ শেষে দেশে ফিরেছিলেন।

তাঁর দীর্ঘ বন্ধু-তালিকায় কাঠুরে-কৈবর্ত্য যেমন ঠাঁই পেয়েছেন, একইভাবে তাঁর সঙ্গ পেয়েছেন মন্ত্রী থেকে মহাজন পর্যন্ত। উল্লাসের ছলকানিতে খোরশেদ বাহার কিংবা তাপস মজুমদার, বিপ্লব দাশ একাকার হলেও বুড়ো ভাই (মুশাররফ রসুল) তো ছিলেন অভিনন্দন জানানোর ভূমিকায়। বয়স তাঁকে চোখ রাঙানোর সাহস দেখায়নি, কোনো সংগীতই তাঁকে হেলা করার অবকাশ দেয়নি। অপার এক প্রেম, বিশুদ্ধ এক বিনয় তাঁর জানালাগুলো খুলে দিয়ে কেবল ডেকেছে, আয়!

ভালো ছিলেন তিনি—বেলাল ভাই। কৃত্তিবাস সম্পাদনা থেকে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনে ছিলেন নিষ্ঠাবান। দীর্ঘদিন ভারত বিচিত্রার সম্পাদক ছিলেন। ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কের তাঁর অফিসটি ছিল শিল্পী-সাহিত্যিক-ছাত্রবন্ধুদের মিলনমেলা। ভারতীয় হাইকমিশন পরিচালিত পত্রিকাটিকে তিনি উন্নীত করেছিলেন বাংলা ভাষার একটি আধুনিক মাসিকপত্রে। কি লেখার সমাহার, কি অঙ্গসৌষ্ঠব—সব মিলিয়ে তা আদৃত হয়েছে বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে। জাদু জানতেন তিনি। তাই তো তাঁর ঘরে সব সময় সমবেত হতে দেখেছি শ্রোতৃমণ্ডলীকে। দুই হাতে লিখতে পারতেন; যেকোনো বিষয়ের ওপর ছিল যথেষ্ট দখল। একসময় সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ সম্পাদনা করেছেন। জড়িত ছিলেন তারকালোক-এর সঙ্গে। বই এবং পাঠ একজন বেলাল চৌধুরীকে আম-দুধের মতো জড়িয়ে ছিল। আম ও দুধের বাইরে আঁটি থাকে। পড়ে থাকা সে আঁটিতেও একদিন নতুন গাছ জন্মাবে, ফুল হবে, ফল হবে—এ বিশ্বাস তাঁর ছিল।

প্রবাস থেকে একার্থে তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিল মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু সে দেশের নানান উত্থান-পতন তিনি গভীরভাবে অবলোকন করেছেন। সহমর্মিতা জানিয়েছেন সংকটে, আনন্দ প্রকাশ করেছেন বিজয়ে।

বেলাল চৌধুরী একটি নাম, যা মিশে আছে ছায়ার কাঠামোতে, যা মিলে গেছে, মায়ার মোহনজালে। একজন মুহম্মদ খসরু, যেমন তাঁর পাঁজর স্পর্শ করে যান, তেমনি একজন গুন্টার গ্রাসও পাঁচ আঙুলে অনুভব করেন বেলাল চৌধুরীর হৃদয়ের উত্তাপ।

১৯৩৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আশি বছরের জীবনে সংসারের মধ্যে স্থাপন করেছেন অন্য এক সংসার। টিপু সুলতান রোডের ফুটপাত থেকে পার্কস্ট্রিটের খোলা রাস্তায় তাই তো শহীদ কাদরী থেকে আয়ান রশীদ তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘বেলাল, ভালো আছ?’

তাঁকে পশ্চিমে দেখেছি, তাঁকে পুবে পেয়েছি। উত্তর-দক্ষিণে তিনি ছিলেন হিমালয় ও বঙ্গোপসাগরের মুখোমুখি। আকাশ ও মাটির কাছে বন্ধক রেখেছিলেন জমা-খরচের খাতা—

‘একটি পাখির উড়ে যাওয়া

থেকে—আমি পেলুম

একটি ঝরা পালক

সুবাতাস একঝলক

একটি শিশির

এক ফোঁটা মধু’।

বেলাল চৌধুরী। বেলাল ভাই, আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন।